ওয়াশিংটন থেকে বিশেষ সংবাদদাতা, ২৩ ডিসেম্বর (জাস্ট নিউজ): বাংলাদেশে একটি স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির সঠিক পথে ফিরে যাবার রাস্তা এটি। নির্বাচনের সপ্তাহখানেক বাকি থাকলেও চলমান পরিবেশ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের উপযুক্ত নয়। আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু না করা গেলে পরিণাম হবে ভয়াবহ। আর তাতে মুখ থুবড়ে পড়বে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভবিষ্যত ও গতি-প্রকৃতি।
বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন-২০১৮ এর আশা, সম্ভাবনা, ঝুঁকি আর আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তার প্রভাব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা নীতিনির্ধারন প্রনোয়নকারি প্রতিষ্ঠান- উইলসন সেন্টার ব্রডকাস্টিং সেন্টার সম্প্রচারিত এক প্যানেল আলোচনায় এই অভিমত তোলে ধরেন আলোচকবৃন্দ।
যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস ১৯৬৮ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের নামে প্রতিষ্ঠা করে উইলসন সেন্টার। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে নীতি নির্ধারণে সহায়তা প্রদান ছাড়াও আলোচনা, সেমিনার, গবেষণা পরিচালনা করে আসছে স্বনামধন্য এই প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশের নির্বাচন এবং প্রত্যাশা নিয়ে বুধবার এক প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে উইলসন সেন্টার। প্যানেল আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেন সেন্টারের সিনিয়র স্কলার ও বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলাম বি মাইলাম এবং সেন্টারের উপ পরিচালক ও সাউথ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র এসোসিয়েট মাইকেল কুগেলম্যান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশি সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী।
অনুষ্ঠানে আলোচকরা বলেন, পাঁচ বছর আগে ২০১৪ সালে যে কায়দার নির্বাচন হয়েছে তার চাইতে ভিন্ন রকমের একটা নির্বাচন অনুষ্ঠান দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র । বাংলাদেশে যা ঘটছে সেদিকে গভীর পর্যবেক্ষণ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। সম্প্রতি কংগ্রেস বাংলাদেশ ইস্যুতে যে বিলটি সর্বসম্মতভাবে পাস করেছে সেটি অন্য যেকোনো বিলের চাইতে খুবি স্পষ্ট এবং তাৎপর্যপূর্ণ। এটি প্রমাণ করে দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ কতটা অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত।
বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে? নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং বিশ্বাসযোগ্যভাবে আয়োজন করার জন্য সম্প্রতি একটি বিলও পাস করেছে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস।নির্বাচন নিয়ে পাস হওয়া এই সর্বসম্মত বিল প্রসঙ্গে মাইলাম বলেন, আমি বিশ্বাস করি এই বিলটি বাংলাদেশে একটি অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজনে সহায়ক হবে। বাংলাদেশে যা ঘটছে, যা আমরা শুনতে পাচ্ছি, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে দেশটি এ অবস্থা থেকে উত্তরণ পাবে। যুক্তরাষ্ট্র দৃঢ়ভাবে চায় যে বাংলাদেশে একটা অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক। আর এর মাধ্যমে দেশটি তার সঠিক পথ ফিরে পাবে। নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠুভাবে হলে তার একটা ইতিবাচক প্রভাব তৈরি হবে। নির্বাচন কে জিতবে সেটা বড় কথা নয়, আমি সে বিষয়টি নিয়েও কোনো কথা বলতে চাচ্ছিনা। যদি একটা সুষ্ঠু নির্বাচন বাংলাদেশে সম্পন্ন হয় তবে তা হবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি বড় ধরনের ইতিবাচক বিষয়।
নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাস হওয়া বিলটি কতটা তাৎপর্যপূর্ণ এবং এশিয়া অঞ্চলে এর মাধ্যমে দেশটির কী ধরণের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে?-এমন প্রশ্নের জবাবে উইলসন সেন্টারের উপ পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, বিলটির প্রভাব কতটা রয়েছে তা দ্রুত হিসেব করে বলাটা খুবি কঠিন। তার চাইতে বরং বাংলাদেশে নির্বাচনটা কিভাবে হচ্ছে সে দিকে নজর রাখাটা উত্তম হবে। আমি মনে করি যে বিলটা পাস করা হচ্ছে সেটা প্রাথমিকভাবেই আমাদের বলে দিচ্ছে-বাংলাদেশে যা ঘটছে তার দিকে নজর রাখছে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস। এটা খুবি গুরুত্বপূর্ণ। দেশটিতে আসন্ন নির্বাচনের প্রাক্কালেই বিলটি পাস করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিলটি আনা হয়েছে একদম সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনার উপর-যাতে করে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। সেটা করা হয়েছে দ্বি-পাক্ষিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়টি মাথায় রেখেই। এই রেজ্যুলেশন পাস করার পূর্বেও কংগ্রেসে বেশ কয়েকটি রেজ্যুলেশন আনা হয়েছে, তবে সর্বশেষ যেটা আনা হয়েছে সেটা একেবারেই আলাদা রকমের, নিরপেক্ষ এবং স্পষ্ট।
বাংলাদেশে ২০১৪ সালের মতো আরা কোনো একতরফা নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্র দেখতে চায় না উল্লেখ করে উইলসন সেন্টারের সিনিয়র স্কলার উইলাম বি মাইলাম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বতর্মান প্রশাসন বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টিতে খুব বেশি জোর দিচ্ছে বলেই আমি দেখতে পাচ্ছি। তারা চায় না পাঁচ বছর আগে ২০১৪ সালে যে রকমের নির্বাচন হয়েছে সেরকম একটা কিছু আবার হোক। সে নির্বাচনের সময়টাতে আমিও চেষ্টা করেছিলাম প্রশাসনের হয়ে একটা কিছু করতে, এ নির্বাচনটা ছিলো অন্য কায়দার, যেটা ভিন্ন রকমের কাহিনী বলা যায়। কী ধরনের নির্বাচন হয়েছে সেটা সবাই দেখেছে। ২০১৪ নির্বাচন কী ফল নিয়ে এসেছে আমি সেটা নিয়ে এখন বলবো না। বতর্মান প্রশাসন কী চাচ্ছে সেটা নিয়েই বলবো- স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাউথ এশিয়া ব্যুরো এই নির্বাচন ইস্যুতে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে বেশ কড়া বার্তা দিয়েছেন। বাংলাদেশে সুষ্ঠু একটা নির্বাচন হোক-বিষয়টাতে যুক্তরাষ্ট্র যেমন আগ্রহী, তেমনিভাবে সহায়তাও করতে চায়।
কংগ্রেস রেজ্যুলেশনের শুধু বাংলাদেশ নিয়ে নয়, আমরা একরম বেশ কয়েকটি রেজ্যুলেশন দেখেছি ইরান এবং উত্তর কোরিয়া ক্ষেত্রেও। হাউসে এগুলো পাস করা হয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন সে আলোকেও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এরকম কার্যকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে কিনা? এরকম প্রশ্নের জবাবে মাইলাম বলেন, কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে কীভাবে কাজ করবে সেটা নিয়ে আমি এখনই কিছু বলতে যাচ্ছিনা, কারণ এই বিলটিতে কোন পদক্ষেপ নির্দেশনা যোগ করা হয়েছে কিনা অবগত নই। বিলটিতে যেটা বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকে বাংলাদেশের ইস্যুতে সক্রিয় হতে। রেজ্যুলেশনটি পাস হবার অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন এ ইস্যুতে সক্রিয় ছিলো, আমি তাদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই ধারণা পেয়েছি। আর এটা অব্যাহত একটি প্রক্রিয়া, কোনো দেশ প্রসঙ্গে সক্রিয় হওয়া মানে হলো দ্বি-পাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট একটি বিষয়।
মাইকেল কুগেলম্যান এ প্রসঙ্গে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে অনেক রকমের রেজ্যুলেশন পাস হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশে নির্বাচনের সপ্তাহ দু'য়েক পূর্বে পাস হওয়া রেজ্যুলেশনটি দেশটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা কি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক? লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বার বার তাগাদা দিয়ে আসছে অথচ সেটি এখন অনুপস্থিত। এমনকি বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনাররাও রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। ক'দিন আগেও একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন -নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলে কিছু নেই। সরকারের যোগসাজশে পুলিশ বিরােধী দলের প্রার্থী-সমর্থকদের গ্রেফতার করছে। দেশটির প্রধান বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে বন্দি করে রাখা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কী গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন আয়োজন সম্ভব?- এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত মাইলাম বলেন, এ বিষয়গুলোর আলোকে এটা বলে দেয়া যায় যে এগুলো অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন বলে মনে হচ্ছেনা।
তিনি বলেন, নির্বাচন সপ্তাহের মত সময় বাকি আছে। হয়তো কিছুদিন আগে নামানো হবে সেনাবাহিনীকে। কিন্তু আপনি যে বর্ণনা দিলেন, আর আমি যা জানি, দেখছি, তাতে এটাকে সুষ্ঠু নির্বাচন বলা যায় না। বাংলাদেশের আমার অনেক বন্ধুদের কাছ থেকেও আমি এগুলো শুনতে পেয়েছি। তবে কংগ্রেস যে রেজ্যুলেশন পাস করেছে এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাউথ এশিয়া ব্যুরো নির্বাচন ইস্যুতে যে বার্তা দিয়েছেন ঢাকাকে, আমি মনে করি সরকারের সিদ্ধান্ত বদলে তা সহায়ক হবে। বাংলাদেশ সরকার নির্বাচন নিজেদের অনুকূলে নেবার জন্য যা করতে চাচ্ছে তা থেকে সরে দাঁড়াবে। নির্বাচন নিয়ে যে অভিযোগের কথা বলা হলো সেগুলোর তথ্য আমার কাছে আছে। তবে সার্বিক দিক থেকে এটাকে সুষ্ঠু নির্বাচন বলা যাবে না।
বাংলাদেশের এই নির্বাচন পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করছে এশিয়ার প্রতিবেশিরা? বিশেষ করে ভারত এবং চীন বিষয়টিকে কীভাবে নিচ্ছে? ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা ভিন্ন একটা অবস্থান দেখেছিলাম। -এ প্রশ্নের জবাবে সাউথ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র এসোসিয়েট মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ভারত বিষয়টিকে খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। দেশটির রক্ষণশীল হিন্দুত্ববাদী সরকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে বেশ ভালো একটা সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এটা রেখেছে তাদের স্বার্থেই। বিরোধী নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ইসলামপন্থীদের একটি যোগসূত্র রয়েছে, তারা সরকারে আসলে কেমন হবে-এসব বিষয় মাথায় রেখেই এবারের নির্বাচনটা গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেছে দেশটি। আর চীনা চায় বাংলাদেশে তাদের সম্পর্ক এবং প্রভাব বিস্তার বাড়াতে। যে দলই ক্ষমতায় আসুক সেটা নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যাথা নেই চীনের। তারা সব সরকারের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত। এশিয়া অঞ্চল বিষয়টি নিয়ে খুব মাথা ঘামাচ্ছে এটা বলা ঠিক হবেনা তবে ভারত বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। সে তুলনায় চীনেরটা কিছু কম।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে আমি অনেকটা বিস্মিত হয়েছি। তারা কংগ্রেস নির্বাচন নিয়ে রেজ্যুলেশ পাস করেছে, এমনকি ৩২ জনের মতো পর্যবেক্ষক পাঠাবে। বিষয়টি ইতিমধ্যে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র দূত জানিয়ে দিয়েছেন। অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষক পাঠাবেনা। যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থানই বলে দিচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচনকে তারা কতটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছে।
প্যানেল সঞ্চালক এসময় বলেন- নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব বলেছেন, পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন ‘মূর্তির মতো’ দাঁড়িয়ে, কোনো মন্তব্য করা যাবেনা। মিডিয়ায় বিষয়টি ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মিডিয়ার সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারবেন না, পোলিং স্টেশন থেকে সরাসরি কোনো-কিছু সম্প্রচার করতে পারবেন না সাংবাদিকরা। যদি কোনো কিছু বলাই না গেলো, কোনো কিছু নিয়ে মিডিয়ায় কথাই না বলা গেলো, তাহলে সেটা পর্যবেক্ষণ কীভাবে হবে? এ বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন।
এ প্রসঙ্গে মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, বিষয়টা খুবি গুরুত্বপূর্ণ। এরকম সিদ্ধান্তটা অনেকটা হাস্যকর। এর মাধ্যমে ব্যালট জালিয়াতি বা অনিয়ম করার সুযোগ তৈরি হয়। তবে যেটা খুবি তাৎপর্যপূর্ণ সেটা হলো নির্বাচনে কী হচ্ছে তা দেখার জন্য ওয়াশিংটন বড় একটি পর্যবেক্ষক দল পাঠাচ্ছে বাংলাদেশে।
রাষ্ট্রদূত মাইলাম এতে যোগ করে বলেন, শুধু যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পর্যবেক্ষকরা যাবেন সেটা কিন্তু নয়, বরং ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের উদ্যেগে স্থানীয় পর্যবেক্ষকরাও নির্বাচন পর্যবেক্ষণে অংশ নিবেন। তবে আমি মাইকেলের সঙ্গে এ বিষয়ে একমত যে, বিধি-নিষেধের কড়াকড়িতে কাজে ব্যাঘাত ঘটবে এবং এটা মানসিক একরকমের চাপ সৃষ্টি করবে। এটি আরো আগ্রহকে বাড়িয়ে দেবে। যুক্তরাষ্ট্র এটা ভালোভাবেই খতিয়ে দেখবে যে কোন প্রক্রিয়ার ভিতরে নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজন করছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ।
পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহনীর সদস্যরা পক্ষপাতিত্ব করছে। তারা সরকারের পক্ষ হয়ে মাঠে নেমেছে। একটি বিষয় সবাই জানে যে বাংলাদেশে সেনা সদস্যরা খুবি সাহসী। জাতিসংঘের শান্তি মিশনের হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় শান্তিরক্ষার মিশনে তারা কাজ করে যাচ্ছে। শুধু সাধারণ মানুষই নয় সুশীল প্রতিনিধিরাও দাবি তোলেছেন যেন ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনীকে ভোটের মাঠে নামানো হয়। তবে এরকম সুবিধা দেবার বিরোধীতা করছে সরকার এবং নির্বাচন কমিশন। একটি নিরপেক্ষ, অবাধ নির্বাচনের জন্য সেনাবাহিনীর ভূমিকাটা কেমন হওয়া উচিত?- এই প্রশ্নে উইলসন সেন্টারের সিনিয়র স্কলার মাইলাম বলেন- নির্বাচন কমিশন কীভাবে নির্বাচনটা করতে চাচ্ছে, কমিশনারদের ভূমিকা কী সে বিষয়টা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। একজন কমিশনার বলেছেন অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই।
তিনি বলেন, আমি মনে করি এবং আশাও করি সেনাবাহিনী এমনভাবে নামানো উচিত যাতে তারা পেশাদারিত্বের সঙ্গে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। তাদের এমন সুযোগ দিতে হবে যেনো তারা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারে। এটা নাও হতে পারে, তবে আমরা এটার প্রত্যাশা করি। সেনাবাহিনীকে এমন ক্ষমতা দিয়ে নামাতে হবে যাতে তারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশ জাতিসংঘের একটি অন্যতম অংশীদার সদস্য। নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংস্থাটি কেমন ভূমিকা রাখতে পারে? সঞ্চালকের এমন এক প্রশ্নের জবাবে মাইকেল বলেন, নিরপেক্ষ সংস্থা হিসেবে জাতিসংঘের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের তাগাদা দিয়ে সংস্থাটি ইতিমধ্যে বেশ কিছু বিবৃতিও দিয়েছে। আমি মনে করি এ বিবৃতিগুলো একটা গুরুত্ব বহন করে। শুধু জাতিসংঘ এ বিষয়ে তাগাদা দিচ্ছে তা না, বিবৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যদেশগুলো। আন্তর্জাতিক পক্ষগুলো নির্বাচন নিয়ে এই যে বার্তা দিচ্ছে এর একটা তাৎপর্য রয়েছে বলে আমি মনে করি। সবাই চাচ্ছে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হোক এবং এটা চাইলে আয়োজন করা সম্ভব।
আওয়ামী লীগ সেক্যুলার রাজনীতির কথা বলে অথচ হেফাজতে ইসলামের সঙ্গেও তারা সখ্যতা গড়ে তোলেছে। এমন এক প্রশ্নে মাইলাম বলেন- রাজনীতিতে অনেক সময় ভন্ডামি দেখা যায়। হেফাজতের সাথে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠতা ভন্ডামির একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমি যেটা জানি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা বলে বিএনপি বা অন্যদলগুলোকে দোষারোপ বা আক্রমণ করে থাকেন শেখ হাসিনা এবং তার দল। এতে ইসলামপন্থার দিকে ঝুকে পড়ার কথা বলা হয়। কিন্তু স্বার্থসিদ্ধির জন্য শেখ হাসিনা অতীতেও এমনটি করেছেন।
এ প্রসঙ্গে মাইকেল বলেন, ধর্মীয় দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগটা ঘটে থাকে রাজনৈতিক বহুমাত্রিকতা থেকে এবং সুযোগ-সুবিধা নেবার জন্য। বাংলাদেশে সামনে নির্বাচন আসন্ন, আর এ জন্য জিততে হলে ভোটের সুবিধা নেয়া প্রয়োজন দলগুলোর। আওয়ামী লীগ সরকার হেফাজতের দাবি মেনে নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট থেকে মূর্তি অপসারণ করেছে। আর এটা করেছে তাদের ভোট সুবিধা পাবার আশায়।
২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো যুক্তরাষ্ট্র এবং তারা বাংলাদেশে দ্রুত আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজনের আহবান জানিয়েছিলো। যদি আগের নির্বাচন মতোই আরেকটি নির্বাচন হয় দেশটিতে, এর ফলাফল কি দাঁড়াবে-এমন প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত মাইলাম বলেন-এ প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর আমার হাতে নেই। আমি যেটা মনে করি, এরকম কিছু একটা হলে এর বেশ কিছু পরিণতি সামনে আসতে পারে। কংগ্রেসের রেজ্যুলেশনই বলেন কিংবা স্টেট ডিপার্টমেন্টের বার্তাই বলেন-এগুলো সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের আহবান। ২০১৪ সালে যেটা হয়েছে সেখানে ১৫০ এর বেশি আসনে ভোট ছাড়াই জয় হয়েছে, একদলের সরকার হিসেবে তারা ৫ বছর দেশ শাসন করেছে। একিরকম কিছু ঘটলে তা হবে একদলের শাসন ব্যবস্থার নামান্তরই। সেই একতরফা নির্বাচনে সত্যিকার অর্থেই বিরোধীতা করেছিলো যুক্তরাষ্ট্র।
বাংলাদেশে অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কিনা বিষয়টি নির্ভর করছে দেশটির জনগণের উপর, বলেন মাইলাম। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আমার অনেক বন্ধু আছে, বিষয়টি নিয়ে আমি অনেক বলেছি এবং লিখেছি। আঞ্চলিক মিত্র বা পশ্চিমা পক্ষ যাই বলা হোক না কেনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাংলাদেশের জনগণকেই।এটা তাদেরকেই করতে হবে। বাইরে থেকে কেউ সেটা করে দিবেনা।
রাষ্ট্রদূত মাইলাম বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশে একটা ভালো নির্বাচন হোক। আশা করি সেটা হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের বিকাশের ক্ষেত্রে বিশ্বে অবদান রাখছে। আমরা সহায়তা করতে পারি তবে কোনো সুনির্দিষ্ট দলকে সমর্থন দিতে পারিনা।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গণতন্ত্র চায় উল্লেখ করে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, আমরা চাই বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসুক। কোন দল বা কে বিজয়ী হলো সেটা বড় কথা নয় গুরুত্বপূর্ণ হলো গণতন্ত্র এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি। আমরা এমন এক সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাই যারা বাংলাদেশের জনগণের ভোটে বৈধভাবে নির্বাচিত। এ জন্য অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রসঙ্গটা গুরুত্বপূর্ণ।
স্থিতিশীলতার জন্য অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন জরুরি মন্তব্য করে মাইকেল বলেন, সবচাইতে জরুরি এবং বড় বিষয় হলো স্থিতিশীলতা। নির্বাচন হলো কিন্তু তা সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছ হলোনা, আবারো বিরােধী নেতা-কর্মীরা রাজপথে নামলো বিক্ষোভ করতে, সরকার ধর-পাকড় শুরু করলো-এটা ওয়াশিংটনের দৃষ্টিতে একটা উদ্বেগের কারণ হয় দাঁড়াবে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ায় যেন স্থিতিশীলতা বজায় থাকে সেটাই চায় যুক্তরাষ্ট। এ নির্বাচনের পর যদি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতাই দেখে তাহলে তারা কৌশলগত সিদ্ধান্তে হয়তো পরিবর্তন নিয়ে আসবে। কয়েক বছর পূর্বে ঘটে যাওয়া সহিংসতা, সন্ত্রাসী হামলায় যুক্তরাষ্ট্র নাগরিক নিহত হবার ঘটনায় বাংলাদেশকে আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
তিনি বলেন, নির্বাচন কি হয় সেজন্য পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। যদি দেশটি আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠে, বিক্ষোভ বাড়তে থাকে তবে সেটা হবে বড় উদ্বেগের কারণ।
রাষ্ট্রদূত মাইলাম বলেন, সরকার যেভাবে সবকিছু এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করছে তাতে মনে হয় সেটার সহিংস প্রতিক্রিয়াও হতে পারে। বাংলাদেশের সহিংস রাজনীতির অবসান ঘটেছে এটা অনেকে ধরে নিয়েছিলো, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সে দিকটা ইংগিত করছেনা।
আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আশংকা প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের এই কূটনীতিক বলেন, সরকার দাবি করছে বা ভান করছে সুষ্ঠু একটি নির্বাচন হবে। তবে মুদ্রার অপর পীঠ বলছে নির্বাচন আয়োজন চুরি করতে পারে সরকার। আর যদি সেটাই হয় তবে পরিস্থিতি হবে আরো ভয়াবহ। আবারো একদলীয় শাসনে ফিরে যাবে দেশটি এবং পরিণত হবে একতান্ত্রিক রাষ্ট্রে। যেমনটি বিগত ৫ বছর ধরে চলে আসছিলো। বিরোধীরা রাজপথে নামতে চাইবে, প্রতিবাদ করতে চাইবে আর সরকার তা দমনে ধরপাকড় ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিবে। মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটবে রকেট গতিতে। বিরোধীদলকে নি:শেষ করে দিতে চাইবে। সেটি হবে খুবি উদ্বেগের। আর মানবাধিকারের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ব সম্প্রদায় কেবল নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে না।
(জাস্ট নিউজ/জিএস/০৪২৫ঘ)