টেলিগ্রাফকে সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহা

বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাচ্ছেন শেখ হাসিনা

বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাচ্ছেন শেখ হাসিনা

ঢাকা, ২৪ ডিসেম্বর (জাস্ট নিউজ): শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে কার্যত পাকিস্তান বানাচ্ছেন। আর এ জন্য যত রকমের পন্থা অবলম্বন করা যায় তিনি তাই করছেন।

ভারতের প্রভাবশালী গণমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে এ মন্তব্য করেছেন ক্ষমতাসীন সরকারের রোষানলে পড়ে দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন সাংবাদিক সোনিয়া সরকার।

'হোয়াই বাংলাদেশ ইজ দ্য মিরর ইমেজ অব পাকিস্তান' শিরোনামের ঐ প্রতিবেদনে সরকারের চাপে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসন নেয়া ছাড়াও কথা বলেছেন আসন্ন সংসদ নির্বাচন, শেখ মুজিবুর রহমানের সংবিধান সংশোধন, ষোড়শ সংশোধনী রায় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার কারণসহ বিভিন্ন বিষয়ে নিয়ে।

সিনহা বলেন, স্বাধীন মত প্রকাশের কণ্ঠ রোধ করে আর সেনাবাহিনীকে অপ্রয়োজনীয় ক্ষমতা দিয়ে বাংলাদেশটাকে একটা পুলিশী রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন শেখ হাসিনা।

আসন্ন সংসদ নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগর বিষয়টি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা নির্বাচন কমিশন নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলাে তিন মাসের জন্য নির্বাচন পেছানোর জোর দাবি জানানোর পরও কমিশন ৩০ ডিসেম্বর ভোটের দিন নির্ধারণ করেছে। অনেকেরই ধারণা সামনের নির্বাচন ২০১৪ সালের মতো প্রহসনের নির্বাচন হতে পারে। আর তার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহা বলেছেন, "এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন কোনোভাবেই অবাধ এবং সুষ্ঠু হতে পারেনা।"

বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতার জন্য লালায়িত ছিলেন বলে বিশ্বাস করেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। এ প্রসঙ্গে সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, "তিনি (শেখ মুজিবুর রহমান) কখনোই গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেননি। শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং বর্ণবৈষম্য ঘুচাতেও তিনি কাজ করেননি। বিশ্বের অন্যান্য মহান নেতারা যেমন মহাত্মা গান্ধি এবং নেলসন ম্যান্ডেলা যেভাবে এর জন্য কাজ করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান সেভাবে পারেননি।"

শেখ হাসিনাও তার বাবার কাজের মধ্যে কোনো তফাত নেই মন্তব্য করে সিনহা বলেন, ১৯৭৪ সালে হাতে গুণা কয়েকটি পত্রিকা ছাড়া আর বাকিসব বন্ধ করে দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তার সমালোচনা করে যেসব সাংবাদিকরা লিখতেন তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি করা হয়েছিলো। হাসিনা এখন যেভাবে রাষ্ট্র চালাচ্ছেন তার সঙ্গে তার বাবার কাজের কোনো তফাত নেই।

শেখ হাসিনাও একি কায়দায় মিডিয়া দমন করছেন, সাংবাদিক গুম হচ্ছে, বে-আইনী গ্রেফতার করা হচ্ছে-এসব উল্লেখ করে সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেন, খুব সম্প্রতি যদি উদাহরণ টানতে হয় তাহলে বলতে হবে স্বনামধন্য ফটোসাংবাদিক শহীদুল আলমকে গ্রেফতারের ঘটনাটি। হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের সমালোচনা করায় গত আগস্টে গ্রেফতার করা হয়েছিলো শহীদুলকে।

সিনহা বলেন, "শেখ হাসিনা মানসিক ভারসাম্যহীন। কেউ তার সমালোচনা করুক এটা সহ্য করতে পারেন না। তার নীতি হলো- হয় প্রশংসা করো নতুবা তুমি জানে শেষ।"

আদালতের রায় যতদিন শেখ হাসিনার অনুকূলে ছিলো ততদিন তার সঙ্গে সম্পর্কে কোনো ঘাটতি ছিলোনা বলে জানান সিনহা। এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর হত্যার বিচারের কথা তোলে ধরেন তিনি। এরি ধারবাহিকতায় ২০১৫ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম হিন্দু হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে সিনহাকে নিয়োগ দেন শেখ হাসিনা। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনী রায়ের পর মোহভঙ্গ ঘটে হাসিনার। যে বিচারপতি ছিল আস্থাভাজন তিনি বনে যান প্রধান বিরোধীতাকারি।

সিনহা অভিযোগ করেন সেনাবাহিনীর গোয়ান্দাদের দিয়ে তাকে দেশে হয়রানি করিয়েছেন হাসিনা এবং শেষমেষ বাধ্য করেছেন দেশ ছেড়ে চলে যেতে।

প্রধান বিরোধী নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে দমিয়ে রাখতে আদালতকে ব্যবহার করছেন শেখ হাসিনা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিচার ব্যবস্থাকে বাগিয়ে নিয়ে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নিজের ক্ষোভ মেটাচ্ছেন শেখ হাসিনা অনেকেরই এটা ধারণা। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুটি মামলার রায় হয়েছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট নির্বাচনের পূর্বেই তাঁর মুক্তি দাবি করেছিলো। কিন্তু তিনি এখনো কারাবন্দি রয়েছেন।

শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের বীজ বপন করেছিলেন বলে মন্তব্য করেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি।

সিনহা বলেন, সংবিধানের চুতর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের বীজ বপন করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এছাড়া শেখ মুজিবুর রহমান কীভাবে আর্টিকেল ১১৬ কে দুর্বল করেছিলেন আর আর্টিকেল ১১ কে রদবদল করেছিলেন সাক্ষাতকারে তাও উল্লেখ করেন সিনহা।

তিনি বলেন, "মূল সংবিধানে লেখা ছিলো- প্রজাতন্ত্র হিসেবে বাংলাদেশ সর্বাবস্থায় জনগণের গনতান্ত্রিক মূল্যবোধসমূহ নিশ্চিত করবে, ব্যক্তি মর্যাদা ও স্বাধীনতার বিষয়টি সমুন্নত রাখবে এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। কিন্তু চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচন পদ্ধতির বিষয়টিকে সরিয়ে দেয়া হয়। আর এর মাধ্যমে সংবিধান থেকে গণতন্ত্রের দর্শনকে বিলুপ্ত করা হয়।"

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী 'অবৈধ' ঘোষণা করে রায় দেবার কারণেই ২০১৭ সালে প্রধান বিচারপতি সিনহার উপর রাজনৈতিক খড়গ নেমে আসে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সরকারের হাতে দিয়ে ২০১৪ সালে এই সংশোধন আনা হয়। বিষয়টি নিয়ে ২০১৬ সালের মে মাসে রায় দেয় হাইকোর্ট। রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে আপিল বিভাগে আবেদন করে সরকারপক্ষ। কিন্তু একই বছরের জুলাই মাসে সিনহার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে সরকারের এই আবেদন নাকোচ করে দেয়। রায়টি সরকারের পক্ষে দেবার জন্য হাসিনার পক্ষ থেকে সিনহাকে একের পর এক চাপ দেয়া হয়েছিলো।

রায়ের জন্য প্রেসিডেন্টের বঙ্গভবনে তলব করার ঘটনাটি উল্লেখ করে সিনহা টেলিগ্রাফকে বলেন, "দিনটি ছিলো ২০১৭ সালের ১ জুলাই। প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে একজন লোক নিজেকে মিলিটারি সেক্রেটারি পরিচয় দিয়ে আমাকে ফোন দেন। ঐ দিন সন্ধ্যা ৭.৩০ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করার জন্য অনুরোধ জানান। যখন সেখানে গেলাম প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী এবং অ্যাটর্নি জেনারেলকে দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম।"

নিম্ন আদালত নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত সংবিধানের আর্টিকেল ১১৬ কে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রীকে আহবান জানান সিনহা। এর ফলে নিম্ন আদালতের উপর প্রেসিডেন্টের পরিবর্তে সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সিনহা বলেন, "আমার এই আহবানের প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা বলেন-আর্টিকেল-১১৬ তে কোনো প্রকারের হাত দেয়া যাবেনা। কারণ চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এটা সংশোধন করেছেন তার বাবা। শেখ হাসিনা আমাকে ষোড়শ সংশোধনীর রায়টি সরকারের ইচ্ছা অনুসারে দেবার অনুরোধ করেন।" সিনহা বিষয়টি সম্ভব নয় বলে তা নাকোচ করে দিয়েছিলেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করার জন্যই সিনহার প্রতি হাসিনা ক্ষেপে যাননি। ক্ষেপেছেন রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়েও। আর এটাকে ক্ষমার অযাগ্য মনে করেন শেখ হাসিনা। এর অন্যতম একটা কারণ হলো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছাড়া অন্য কোনো নেতার অবদান স্বীকৃতি দিতে পছন্দ করেন না হাসিনা।

সিনহা তার পর্যবেক্ষণে বলেন, "মুজিবুর রহমান জাতির জনক হিসেবে পরিচিত।কিন্তু তিনি ছাড়াও আরো অনেক প্রতিষ্ঠাকালীন জনক রয়েছেন যেমন- ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমিরুল ইসলাম..."

নির্বাসনে কেমন আছেন সে বিষয়ে সিনহা টেলিগ্রাফকে জানান, "এখানে আমি স্বাধীন দিন কাটাচ্ছি, প্রাণখুলে কথা বলতে পারছি। এই যে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলছি কেউ তা গোপনে রেকর্ড করছে না। যুক্তরাষ্ট্রে ডিজিএফআই এর গোয়েন্দারা নেই, কেউ আর ফোন কল রেকর্ড করছেনা, ইনবক্সে নজরদারি করছে না।"

সাবেক প্রধান বিচারপতি তার আত্মজীবনী "এ ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস এন্ড ডেমোক্রেসি" বইতে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে যেসব হুমকি এবং আতংকের সম্মুখীন হয়েছেন তা নিয়ে সবিস্তারে লিখেছেন।বইটিতে তিনি লিখেছেন কোন পরিস্থিতিতে দেশ ছেড়েছেন, কানাডা যাবারে পথে সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে কীভাবে তাকে পদত‌্যাগে বাধ্য করা হলো এসবসহ নানান বিষয়। 

সিনহার বিরুদ্ধে সরকারের আনা ১১ টি দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "দুর্নীতির বিষয়টা শেখ হাসিনা আমাকে ঘায়েল করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন।" এ প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বর্তমান সরকারের একের পর এক দুর্নীতির বিষয়টি তোলে ধরেন। তিনি বলেন, "এ বিষয়গুলো (দুর্নীতি) নিয়ে যদি কেউ হাসিনা সরকারকে প্রশ্ন করে তাহলে তাকে বলা হবে দেশ বিরোধী।"

জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দলের সঙ্গে সিনহার ঘনিষ্ট একটা যোগাযােগ রয়েছে- হাসিনার অনুগতদের এমন অভিযোগের জবাবে সিনহা বলেন, "হাসিনার অনুগত পদলেহীরা আমার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে এসব বলে বেড়াচ্ছে।"

(জাস্ট নিউজ/জিএস/১৪৪৬ঘ)