‘অগণতান্ত্রিক নির্বাচনী পরিবেশ’ নিয়ে ১৬ সংস্থার উদ্বেগ

বাংলাদেশে বিশ্বাসযোগ্য, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই

বাংলাদেশে বিশ্বাসযোগ্য, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই

ঢাকা, ২৯ ডিসেম্বর (জাস্ট নিউজ): চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে বিশ্বাসযোগ্য, সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। নির্বাচনে ঘটে যাওয়া সহিংসতা আর ভয়-ভীতির পরিবেশই বলে দিচ্ছে ভোটের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড অনুপস্থিত।

নির্বাচনের ঠিক একদিন আগে বাংলাদেশের ‘অগণতান্ত্রিক নির্বাচনী পরিবেশ’ নিয়ে এই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন (আনফ্রেল)সহ আন্তর্জাতিক ১৬ সংস্থা। শনিবার আনফ্রেলের ওয়েবসাইটে এই যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার পাশাপাশি এতে স্বাক্ষর করেছে মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলোও।

চলমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, রাষ্ট্রীয় সকল সংস্থাই বিরোধী প্রার্থী, মিডিয়া, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের উপর দমন-পীড়ন অব্যাহত রেখেছে।

আনফ্রেলের মাধ্যমে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন পর্যবেক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। সরকার ভিসা না দেয়া সে প্রক্রিয়া আগেই ভেস্তে যায়।

নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ বিরাজ করছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য ১১তম সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশটিতে যে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে তা নিয়ে আনফ্রেলসহ ১৬ নির্বাচন পর্যবেক্ষক এবং মানবাধিকার সংস্থা উদ্বিগ্ন। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই বাংলাদেশ সরকার সুশীল সমাজ, বিরোধীদল এবং মিডিয়ার উপর দমন-নিপীড়ন শুরু করেছে, যা একেবারেই গণতান্ত্রিক চর্চার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। এ পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলোকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার নামান্তর। আর এর মাধ্যমে আসন্ন নির্বাচনের ঐকান্তিকতার বিষয়টি নিয়েও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

নির্বাচনের পূর্বে বিরোধী দলের প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকদের উপর হামলা-গ্রেফতারের চিত্র তোলে ধরে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, সত্যিকারের গণতান্ত্রকি প্রক্রিয়ায় নির্বাচনী সহিংসতা এবং ভয়-ভীতির পরিবেশ তৈরির কোনো সুযোগ নেই। ডিসেম্বরের ২৬ তারিখ পর্যন্ত মিডিয়ায় প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, ডিসেম্বরের ১০ তারিখ প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে বিরোধীপ্রার্থীদের গাড়ি বহরে অন্তত ৩০ টি হামলার ঘটনা ঘটেছে, ১৫৯ টি সংসদীয় আসনে সহিংসতা ঘটেছে ২০৭ টি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্তত ৪৩ জন প্রার্থীর উপর হামলা করা হয়েছে, এর মধ্যে ১৩ জন গুরুতর আহত। বিরোধীদলের ১৭ প্রার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, হাইকোর্ট বিএনপির ২৩ প্রার্থীকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেছে। এখন পর্যন্ত নির্বাচনকালীন সহিংসতায় নিহত হয়েছে ৫ জন আর আহত হয়েছে ২৬৮২ জন।

শুধু তাই নয় এমনও খবর পাওয়া গেছে যে বিরোধীদলের প্রার্থী-সমর্থকদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, নির্বাচনী অফিস মাটির সঙ্গে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, বিরোধী দলগুলোর প্রচারণায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে। এই আক্রমণগুলোর উদ্দেশ্যই হলো বাংলাদেশের ভোটারদের মনে ভয় তৈরি করা এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের পরিবেশকে অবজ্ঞা করা।

ক্ষমতাসীন সরকার বিচার বিভাগ এবং আইনশৃঙ্খলাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে অভিযোগ করে বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের বিরোধীদলগুলোর ভাষ্যমতে নভেম্বর মাসে তফসিল ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত পুলিশ তাদের ২১,০০০ নেতা-কর্মীকে আটক করেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে ২০১৮ সালের শুরু থেকেই বিরোধীদের নামে গায়েবি মামলা করছে সরকার। আর এটি নাটকীয় হারে বাড়ছে। এরি মধ্যে মানহানির মামলায় বিরোধীদলের অন্যতম নেতা ব্যরিস্টার মইনুল হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, চাঁদাবাজি, ষড়যন্ত্র এবং মাছ চুরির অভিযোগে মামলা হয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নামে।বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে লাগামহীন মামলাই আভাস দিচ্ছে দেশটিতে সমান সুযোগের কোনো পরিবেশ নেই। বিচার ব‌্যবস্থা এবং আইনশৃঙ্খলাবাহিনী প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর ক্ষমতাসীন সরকারের নিয়ন্ত্রণ বলে দিচ্ছে পুরো দেশে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। এ বিষয়টি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পরিবেশের সঙ্গে কিছুতেই মেনে নেয়া যায়না।

বিবৃতিতে বলা হয়, প্রতিযোগী কতো জন হলো আর কাঠামোগত আয়োজন সম্পন্ন হলেই একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনকে সংজ্ঞায়িত করা যায়না। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো নির্বাচনের গুণগত পরিবেশ কতটুকু রয়েছে সেটা বজায় থাকা। বাংলাদেশে নির্বাচন অত্যাসন্ন হবার পরও সুশীল সমাজ ও তাদের প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থা এবং মিডিয়াসমূহ তাদের কার্যক্রম পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছে।

এতে বলা হয়, এ বছরের নভেম্বর মাসে সাংবাদিকদের উপর ৭২ টি হামলার ঘটনা ঘটেছে এবং গ্রেফতার করা হয়েছে ৩৯ জনকে।মামলাগুলো করা হয়েছে তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুুক্তি আইনে, যার মধ্যে ৯ টি মামলা হলো ডিজিটলা সিকিউরিটি অ্যাক্টে। স্বাধীন সমালোচকদের উপর সরকারের আক্রমণাত্মক আচরণের বর্হিঃপ্রকাশ ঘটেছে খ্যাতিমান ফটোসাংবাদিক এবং সমাজকর্মী শহীদুল আলমকে আটকের ঘটনায়। স্বাধীনতা, মুক্তগণমাধ্যম এবং মুক্ত সুশীল সমাজের সম্মিলিত প্রয়াসই হলো একটি স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজনের মূল চাবিকাঠি। সরকার যখন জনগণের কাছে জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখতে চায় না তখনি এই সুযোগগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরকম ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতার বিষয়টিকেই ক্ষতিগ্রস্থ করবে।

মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রতি সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করে বিবৃতিতে বলা হয়, নোংরা প্রচারণার শিকার হয়েছে বাংলাদেশের প্রধান সারির মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক সংগঠন অধিকার। সংগঠনটির বিরুদ্ধে রাষ্ট্র এবং সরকার বিরোধী কার্যক্রমের অভিযোগ আনা হয়েছে এবং বলা হচ্ছে এটি দেশে বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আসন্ন নির্বাচনে পর্যবেক্ষণ এবং পর্যবেক্ষক নিয়োগে সংগঠনটির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। এর রেজিস্ট্রেশন ছাড় নিয়েও অনুসরণ করা হয়েছে ধীরগতি।

নিয়ন্ত্রণ আরোপের কারণেই বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংখ্যা কমছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, এই ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপের কারণে নির্বাচনে আসতে ইচ্ছুক পর্যবেক্ষকের সংখ্যা স্পষ্টতো কমে যাচ্ছে। প্রতিবেদন অনুসারে জানা গেছে, ১৯ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসার জন্য আবেদন বা আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন ৩৪,৮৩৮ জন পর্যবেক্ষক। নির্বাচন কমিশনের এক কর্মকর্তার বরাত অনুসারে মোট আবেদনকারি থেকে ২৬,০০০ পর্যবেক্ষককে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হবে। গত দুই দশকে এই রেকর্ডটা হলো দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৮,৮৭৮ জন দেশি এবং চারজন বিদেশি পর্যবেক্ষকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে ১,৫৯,০০০ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে ২,১৮,০০০ পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছিলেন। নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের এরকমের ক্রমাবনতি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক পরিবেশ, নানা ধরণের প্রতিবন্ধকতা, সুশীল প্রতিনিধিদের বাছাই করে অনুমতিপত্র প্রদানের কারণে মানুষ উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা সহিংসতার যে পরিবেশ তৈরি করেছে, আইন এবং বিচারপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বিরোধীদের বিপক্ষে যে আতংক তৈরি করেছে, সুশীল সমাজের বিপক্ষে যে আক্রমণাত্মক অবস্থান দেখা যাচ্ছে এবং মিডিয়াগুলোকে যে চাপা রাখা হয়েছে তাতে কার্যত বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রিত একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিষয়টি জনগণের মুক্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্থ করার নামান্তর। একিসঙ্গে এটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন আয়োজনের মূলনীতির সঙ্গে খাপ খায় না।

আসন্ন নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে এতে বলা হয়, বাংলাদেশে যে পরিস্থিত এখন বিরাজ করছে তাতে আসন্ন নির্বাচনের ঐকান্তিকতা বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আমরা সন্দিহান। কোনো যুক্তির মাপকাঠিতেই নির্বাচন প্রক্রিয়াকে অবাধ এবং সুষ্ঠু বলা যাবেনা।

বিবৃতিতে সাক্ষরকারী সংগঠনগুলো হলো: এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন, গ্লোবাল নেটওয়ার্ক ফর ডেমেস্টিক ইলেকশন মনিটরস, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস, সেন্টার ফর মনিটরিং ইলেকশন ভায়োলেন্স, শ্রীলংকা; ফ্রী এন্ড ফেয়ার ইলেকশনস নেটওয়ার্ক, পাকিস্তান; খোমিতে ইনডিপেনডেন পেমানথাও পেমিলো, ইন্দোনেশিয়া; মালয় ইলেক্টোরাল সাপোর্ট নেটওয়ার্ক, মালয়; মারোয়া, সিঙ্গাপুর; ন্যাশনাল সিটিজেনস মুভমেন্ট ফর ফ্রি ইলেকশন, ফিলিপাইন;পিপলস অ্যালায়েন্স ফর ক্রেডিভল ইলেকশনস, মিয়ানমার; পিপলস একশন ফর ফ্রী এন্ড ফেয়ার ইলেকশনস, শ্রীলংকা; পারকুম পুলান আনতুক পেমিলু দেন ডেমোক্রাসি, ইন্দোনেশিয়া; ট্রান্সপারেন্সি মালদ্বীপ, মালদ্বীপ; জিম্বাবুয়ে ইলেকশন সাপোর্ট নেটওয়ার্ক, জিম্বাবুয়ে এবং কমিটি ফর ফ্রী এন্ড ফেয়ার ইলেকশনস ইন কম্বোডিয়া।

(জাস্ট নিউজ/জিএস/১১০০ঘ)