নিউইয়র্ক টাইমস সম্পাদকীয়

‘বাংলাদেশে প্রহসনের নির্বাচন’

‘বাংলাদেশে প্রহসনের  নির্বাচন’

আরো এক দফায় ক্ষমতায় ফিরেছেন শেখ হাসিনা, ইতিমধ্যে বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এখন আরো বেশী নিয়ন্ত্রণ নেবার পথেই হাঁটবেন তিনি (শেখ হাসিনা)।

সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে এ অভিমত তোলে ধরা হয়। সম্পাদকীয়টি প্রকাশিত হয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস’র সম্পাদকীয় বোর্ডের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে।

‘বাংলাদেশ’স ফারসিক্যাল ভোট’ শিরোনামের এই সম্পাদকীয়তে ভোট কারচুপি করে পুনরায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের কড়া সমালোচনা করা হয়, উপস্থাপন করা হয়েছে ৩০ ডিসেম্বরের ভোটে অনিয়মের চিত্র, উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি নিয়েও। জাস্ট নিউজ পাঠকদের জন্য সম্পাদকীয়টির ভাবানুবাদ তোলে ধরা হল।

নির্বাচনে অনিয়মের চিত্র তোলে ধরে সম্পাদকীয়তে বলা হয়, “৩০শে ডিসেম্বর নির্বাচনের কয়েক মাস ও সপ্তাহ আগে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠনগুলো বিরোধী দলগুলোকে ভীতি প্রদর্শন, সহিংসতা থেকে শুরু করে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের গ্রেপ্তার, তাদের সমর্থকদের ওপর নজরদারি ও বহুল সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিষ্ঠুর ব্যবহার নিয়ে ধারাবাহিকভাবে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে ‘আগ্রাসী অথবা ভীতিকর’ কোনো উপাদান পোস্টের জন্য জেলের বিধান রাখা হয়েছে।

এতে বলা হয়, “নির্বাচনী প্রচারণায় সহিংসতায় নিহত হয়েছে কমপক্ষে ১৭ জন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তার এক রিপোর্টে জানায়, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রতিবাদী কণ্ঠসরগুলোর মধ্যে একধরনের আতংকের পরিবেশ বিরাজ করছে। চাপে রাখা বিচারব্যবস্থা এবং নির্বাচন কমিশনকেও এ ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি।”

কারচুপির নির্বাচনের পর বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যাবে এমন আশংকা প্রকাশ করে সম্পাদকীয়তে বলা হয়, “কেন অপ্রয়োজনীয় নির্বাচনী ফল তৈরি করা হলো? এখন শেখ হাসিনার কতৃর্ত¡বাদী শাসন আর নিস্পেষণমূলক ব্যবস্থা কলঙ্কিত করবে সব অর্জনকে। তার সমালোচক, যারা নির্বাসনে কিংবা আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে বাধ্য হয়েছেন, তারা আরো বেশী অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠবেন। তার বিদেশি সমর্থক যারা আছেন তারা আরো সতর্ক হবেন।”

এতে বলা হয়, “ডিসেম্বরে দ্য টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ হলো একটি প্রান্তিক বিষয়। তিনি বলেন, ‘যদি আমি খাদ্য, কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্য সেবা দিতে পারি সেটাই হলো মানবাধিকার। বিরোধীরা বা নাগরিক সমাজ অথবা আপনার এনজিওরা যা বলছে তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমি আমার দেশকে জানি এবং আমি জানি কিভাবে আমার দেশের উন্নতি করতে হয়’।”

নির্বাচনের ফলাফলের সমালোচনা করে সম্পাদকীয়তে বলা হয়, “টানা প্রায় ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থেকে শেখ হাসিনা কাজ করেছেন। বিশ্বের অন্যতম দরিদ্রতম ও সবচেয়ে কম উন্নত দেশের অন্যতম এ দেশটিতে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা প্রায় ১৫০ ভাগ। চরম দারিদ্র্যে বসবাসকারী মানুষের হার শতকরা ১৯ ভাগ থেকে কমে এসেছে প্রায় ৯ ভাগে। তবে সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো- সরাসরি কর্তৃত্বপরায়ণতার দিকে ঝুঁকে যাওয়া ও এমন একটি নির্বাচন, যাতে শেখ হাসিনার দল জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টিতেই জয় পেয়েছে। শতকরা ৯৬ ভাগ জয় পাওয়া এক অসম্ভব ব্যাপার। এই ফলাফল অর্জনকে খর্ব করেছে।”

দেশ একদলীয় শাসনের পথে হাঁটছে উল্লেখ করে এতে বলা হয়, “বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন পর্যন্ত পালাক্রমে ক্ষমতায় এসেছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় পরিবর্তনের প্রতিবাদ করে ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। এর ফলে শেখ হাসিনাকে একটি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নতুন ক্ষমতার মেয়াদ দেয়া হয়। গত বছর দুর্নীতির অভিযোগে জেল দেয়া হয়েছে খালেদা জিয়াকে। শেখ হাসিনা আরো এক দফায় ক্ষমতায় ফিরেছেন, যা এরই মধ্যে কার্যত একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এখন আরো বেশী নিয়ন্ত্রণ নেবার পথেই হাঁটবেন তিনি (শেখ হাসিনা)।”

নির্বাচন নিয়ে বহিঃবিশ্বের উদ্বেগের কথা তোলে ধরে সম্পাদকীয়তে বলা হয়, “যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিদেশি বিনিয়োগকারী ও সবচেয়ে বড় সিঙ্গেল-কান্ট্রি বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচনী প্রচারণার সময় হয়রানি, ভীতি প্রদর্শন ও সহিংসতার বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্টে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং একই সঙ্গে এসব সমস্যা সমাধানে সব পক্ষকে নিয়ে কাজ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে নির্বাচন কমিশনের প্রতি। যেসব সহিংসতা ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছিল, যা প্রচারণা ও ভোটকে কলঙ্কিত করেছে, সে বিষয়ে তদন্তের জন্য একই রকমভাবে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।”

মানবাধিকার উন্নয়নে বাংলাদেশের মিত্রদের সোচ্চার হবার তাগিদ দিয়ে এতে বলা হয়, “শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত গতিবিধি বলে দেয়, এমন মৃদু ভর্ৎসনায় তিনি পাল্টে যাবেন বলে মনে হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে যেসব দেশের নেতারা ব্যবসা করছেন এবং এ দেশে দারিদ্র্য থেকে উত্তরণের জন্য উল্লসিত, শেখ হাসিনাকেও তার মিত্রদের তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া উচিত, মানবাধিকার বহির্জাগতিক কোনো আরোপিত সংস্কৃতি নয়। এটা হলো উন্নয়ন ও অগ্রগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।”