যুক্তরাষ্ট্রের সাহসী নারীর পুরস্কার পেলেন রাজিয়া

‘ক্ষমতা এবং লোভের কারণে রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞ’

‘ক্ষমতা এবং লোভের কারণে রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞ’

স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে মুশফিকুল ফজল আনসারী

রোহিঙ্গা এবং মানবাধিকারের পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা রাখার স্বীকৃতিস্বরুপ এ বছরের আন্তর্জাতিক নারী সাহসিকতা (ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ-আইডব্লিউওসি) পুরস্কার পেয়েছেন রোহিঙ্গা বংশোদ্ভূত বাংলাদেশি নাগরিক রাজিয়া সুলতানা। এছাড়া শান্তি, মানবাধিকার, লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রাখার স্বীকৃতিস্বরুপ এ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন বিশ্বের আরও নয় সাহসী নারী।

বৃহস্পতিবার স্টেট ডিপার্টমেন্টে আয়োজিত এক বর্ণিল অনুষ্ঠানে সাহসী এই ১০ নারীকে পুরস্কৃত করেন যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও।

অন্য নয় সাহসী নারি হলেন-মিয়ানমারের নও কিয়াও পও, জেবুতির মওমিনা হোসেন দারার, মিসরের মামা ম্যাগিই, জর্দানের কর্ণেল খালিদা খালাফ হান্না, আয়ারল্যান্ডের সিস্টার ওরলা ট্রেসি, মন্টেনিগ্রোর ওলিভেরা লেখিক, পেরুর ফ্লোর দে মারিয়া ভেগা জাপাতা, শ্রীলংকার মারিনি দে লিভেরা এবং তানজানিয়ার আন্না অ্যালোস হেঙ্গা।

নারীদের সাহসিকতার ভূয়সী প্রশংসা করে অনুষ্ঠানে ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া বলেন, “নারীদের এই সাহসটুকুই আমাদের আজকের সমাজ ব্যবস্থার জন্য খুবি গুরুত্বপূর্ণ।” তিনি বলেন, "কেবল সাহসই আমাদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়।"

মাইক পম্পেও বলেন, “বড় ধরনের বাধা মোকাবিলা করেও যারা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন তাদের জন্য আজকের এই পুরস্কার।”

তিনি বলেন, “সাহসী নারীরা আজ সর্বত্রই বিচরণ করছে।”

শান্তি, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বিশেষ সাহস ও নেতৃত্ব প্রদর্শন করেছেন এমন অসাধারণ নারীদের ২০০৭ সাল থেকে এই পুরস্কারের মাধ্যমে স্বীকৃতি প্রদান করে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট।

রাজিয়া সুলতানা ১৯৭৩ সালে মিয়ানমারের মংডুতে রোহিঙ্গা পরিবারে জন্ম নেন। মিয়ানমারে নিজের সম্প্রদায় ও সকলের মানবাধিকারের অগ্রগতির জন্য তিনি তার পুরো কর্মজীবন উৎসর্গ করেছেন।

সুলতানা জীবনের বেশিরভাগ সময় আইনজীবী, শিক্ষক এবং মানবাধিকার পরামর্শক হিসেবে কাটিয়েছেন। ২০১৪ সাল থেকে তিনি রোহিঙ্গা, বিশেষ করে নারী ও মেয়েদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছেন। তিনি রোহিঙ্গা নারী ও মেয়েদের নির্যাতন, গণধর্ষণ, পাচার, প্রভৃতি বিষয় নিয়ে গবেষণা ও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন।

পুরস্কার পাওয়ার পর জাস্ট নিউজের সঙ্গে নিজের অনুভূতি আর অর্জন নিয়ে কথা বলেছেন রাজিয়া।

আইডব্লিউওসি পুরস্কার পাওয়ার পর আপনার অনুভূতিটা কেমন- এমন এক প্রশ্নের জবাবে রাজিয়া জানান, “মনে হয় না ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো? শুধু আমি না, পুরো কমিউনিটি এটা অ্যাচিভ (অর্জন) করছে, এটা রোহিঙ্গা কমিউনিটির অর্জন। আমি শুধু গর্ব বোধ করছি। আজ বাংলাদেশ প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আমি আমার কমিউনিটির জন্য কিছু করতে পেরেছি। খুব ভালো লাগছে এটা ভেবে যে-অন্তত এই রোহিঙ্গা নামটা পৃথিবীর কাছে পৌঁছে গেছে।”

তিনি বলেন, “আপনারা জানেন- রোহিঙ্গা নামটা ভ্যানিস (ধ্বংস)করে দেয়ার জন্য অনেক চেষ্টা হচ্ছে, এখনো করা হচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা রোহিঙ্গাই, তারা আরাকানের বাসিন্দা।”

৯০’র দশক থেকে এখন পর্যন্ত দশ লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এ সমস্যার সমাধানে কি ভাবছেন আপনি? বাংলাদেশে থাকাটা তো সমাধান না, তাদের নিজ আবাসভূমিতে ফিরে যাওয়াই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ।- এমন প্রশ্নের জবাবে রাজিয়া বলেন, “অবশ্যই না, অবশ্যই। জাতির ভবিষ্যত কোথায় তা ভাবতে হবে। ওরা অন্য একটা দেশে এভাবে শরণার্থী ক্যাম্পে দিন কাটাচ্ছে। এটা কল্পনা করাও কঠিন। প্রতিদিনই আমার কাজের একটা পার্ট হচ্ছে ক্যাম্পে যাওয়া। যাই ঘটুক কথা হলো শরণার্থী ক্যাম্পে একটা মানুষ বেড়ে উঠতে পারেনা। তারা নিজ আবাসে ফিরে যাবে এবং যেতে হবে। এবং এজন্য কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটি অনেক কিছু করতে পারে।”

তিনি আরো বলেন,“শুধুমাত্র মানবিক সহায়তা দিয়ে এটা সমাধানের চেষ্টা হচ্ছে, আর এটাকে মনে করা হচ্ছে যথেষ্ট। আমি মনে করি এটা যথেষ্ট না, শুধু বিষয়টাকে সামনে আনা হচ্ছে এই যা। রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমিতে ফিরে যেতে হবে, সেখানেই তাদের ভবিষ্যত।”

রাজিয়া বলেন, “রোহিঙ্গারা বার্ডেন (বোঝা) হয়ে থাকবে বাংলাদেশের কাছে, আমি চাই না আমার কমিউনিটি আরেকটা দেশের উপর বার্ডেন হয়ে থাকুক। আমি জানি, সবাই একটা কথা বলে যে, এখন আশ্রয় নিলেও পরে সারাজীবনের জন্য রোহিঙ্গারা থাকবে। না এটা হয়না, তারা ফিরে যাবে। কারণ এদের যেতে হবে। এটা সমাধানের জন্য ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটিকে বুঝাতে হবে।”

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যথাযথ ভুমিকা রাখছে কিনা জাস্ট নিউজের এমন প্রশ্নের জবাবে এই মানবাধিকার কর্মী বলেন, “না, এটা আমি কখনোই বলবো না। তারা যা করছে সেটা সামান্য। এই যে দেখছেন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফেয়ার হচ্ছে মানুষ ওখানে গিয়ে বিনিয়োগ করছে। মানুষ মরছে একদিকে, অন্যদিকে ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটি টাকা বানাবার মেশিন তৈরি করতে চাচ্ছে। কীভাবে? আমি কি বলবো এটা যথেষ্ট, অবশ্যই যথেষ্ট না। একটা শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবরোধ দরকার। ১৯৪৮ সালের কনভেনশন, জেনোসাইড কনভেনশনে মিয়ানমারকে দাঁড় করাতে হবে। আইসিসি ট্রায়ালে আমরা এর বিচার চাই। বিচার চাওয়াই কিন্তু আমাদের শেষ না। ফুল রাইট, ফুল সিটিজেনশিপ নিয়ে রোহিঙ্গাদের ফিরে যেতে হবে।”

বাংলাদেশের মানুষ তো প্রাণ খুলে রোহিঙ্গাগোষ্ঠির পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের গ্রহণ করেছে। কিন্তু প্রতিবেশি ভারত এবং চীনের এ বিষয়ে নীরবতাকে আপনি কিভাবে দেখছেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “এদের এই নিরবতাটা ওই যে ইনভেস্টম্যান্ট। ওদের দরকার টাকা, তেল কিংবা ক্ষমতা। মানুষ ওদের কাছে কিছুই না। মানুষ হচ্ছে একটা মানি (টাকা)। এই যে...মানুষকে যেভাবে মারলো...ওটা মনে হয়, আমার মনে হয় না যে এটা...একটা পোকা-মাকড়কে যেভাবে স্প্রে দিয়ে শেষ করে দিয়ে ঠিক সেভাবেই কিন্তু শেষ করা দেয়া। এবং এদের কাছে ল্যান্ডটা, আরাকান ভূমিটা ওদের কাছে মূল্যবান, মানুষের জীবন না। এরা মানুষের জীবন নিয়ে চিন্তা করে না। আর এরা কখনো কখনো খুব হিউম্যানরাইটসের কথা বলে, হোয়্যার ইজ দ্য হিউম্যানরাইটস? শুধুমাত্র ক্ষমতার এবং লোভের জন্য ওরা এতোগুলো মানুষকে মেরে ফেলছে। এতোগুলো মানুষকে এভাবে নির্বাসিত করেছে, এটা কিন্তু খুব অন্যায়।”

এমআই/জিএস