স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে বাংলাদেশ: আল জাজিরাকে শহীদুল

স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে বাংলাদেশ: আল জাজিরাকে শহীদুল

দেশে গণতন্ত্র নেই, যা আছে তা কেবল স্বৈরতান্ত্রিক শাসন বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী এবং মানবাধিকারকর্মী শহীদুল আলম।

তিনি আরো বলেন, “ মানুষ নিজের মতো করে মতপ্রকাশের সুযোগ পাচ্ছেনা, ভিতরের পরিস্থিতি ভয়ংকর।”

সম্প্রতি আল-জাজিরার ফ্রন্ট লাইনে দেয়া এক সাক্ষাতকারে এ মন্তব্য করেন। সাক্ষাতাকার সঞ্চালনা করেন মেহদি হাসান। সাক্ষাতকারে বাংলাদেশে মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং মুক্ত মত নিয়ে আলোচনা উঠে আসে।

তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নানা নিপীড়ন, মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করে চলেছেন খ্যাতিমান আলোকচিত্রী শহীদুল আলম। সম্প্রতি নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নিয়ে আল-জাজিরায় একটি সাক্ষাতকার দেয়ায় গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। রিমান্ডে অকথ্য নির্যাতনের শিকার হন টাইম ম্যাগজিন কর্তৃক পারসন অব দ্য ইয়ার খ্যাত এই আলোকচিত্রী ও সাংবাদিক।

জাস্ট নিউজ পাঠকের জন্য আপফ্রন্টে দেয়া সাক্ষাতকারের ভাবানুবাদ তুলে ধরা হলো:

গত বছরের আগস্ট মাসে সড়ক আন্দোলন নিয়ে আল-জাজিরায় সাক্ষাত দেবার পর কী ঘটেছিলো? এমন এক প্রশ্নের জবাবে শহীদুল আলম বলেন, “ আমি তখন খবর এবং তার ছবি আপলোড করছিলাম। বাসায় তখন একাই ছিলাম। যখন দরজা খুললাম দেখলাম বাসার চারপাশ লোকজন ঘিরে ছিলো, তারা আমাকে তোলে নিয়ে যায়।তারা ছিলো সাদাপোশাকে।”

তিনি আরো বলেন, “ কি ঘটতে যাচ্ছে তা আঁচ করতে পেরেছিলাম। আমি যেটা করতে চেয়েছিলাম সেটা হলো লোকজন অন্তত জানতে পারে এখানে কী ঘটছে।আর তাই প্রতিবাদ করছিলাম আর আওয়াজ দিচ্ছিলাম জোরেসোরে। আমাকের হাতকড়া পরিয়ে, চোখে বেঁধে বাসার নিচে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে একটা গাড়ি অপেক্ষমান ছিলাে। চোখ বাঁধা থাকায় বুঝতে পারছিলাম না কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যখন আমাকে নামানো হলো তখন শুরু হলো জিজ্ঞাসাবাদ এবং নির্যাতন। তারা আমাকে প্রহার করে, শরীর থেকে রক্ত ঝরছিলো। চোখ বাঁধা থাকায় বুঝতে পারিনি কী দিয়ে এমন নির্যাতন করা হচ্ছিলো। আমার মুখ, নাক থেকে তখন রক্ত ঝরছিলো, কাপড় রক্তে ভিজে যাচ্ছিলো। তারা আমাকে পানিতে চুবানো, পিন দিয়ে আঘাত করাসহ নানান হুমকি দেয়।”

আল-জাজিরার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভীর একটি সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছিলো যেখানে তিনি আপনার উপর নির্যাতনের বিষয়ে অবগত নন বলে জানান। ‘মিথ্যা তথ্য ছড়ানো এবং সহিংসতা উসকে দেবার কারণে’ আপনাকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো বলে দাবি করেন গওহর। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন।

এ প্রশ্নের জবাবে শহীদুল বলেন,“যা ঘটছিলো তার ডকুমেন্ট করছিলাম আমি। সহিংসতা উসকে দেয়ার বিষয়টা হলো কোন কিছু ঘটার পর তাতে প্রভাব বিস্তার করা। তখন যা ঘটছিলো আমি শুধু তার ডকুমেন্ট তৈরি করছিলাম। এখন আমি এমন কিছু করিনি যেটা নিজ থেকে কোন কিছু তৈরি করা। যা ঘটছে আমি শুধু তাই প্রকাশ করছিলাম। অবশ্যই সহিসংতা উসকে দেবার মতো কিছুই আমি করিনি। একজন সাংবাদিক যা করে আমি তাই করছিলাম।”

এসময় সঞ্চালক বলেন, যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা বানোয়াট। জবাবে শহীদুল বলেন, আসলেই তাই।

প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী আপানর গ্রেফতারের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন এবং এ-ও বলেছেন তিনি আপনার বন্ধু। আসলে কী তাই? সঞ্চালক মেহদীর এমন প্রশ্নের উত্তরে শহীদুল বলেন, “এই ভদ্র লোককে আমি চিনি। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে দেখা হয়েছে। বন্ধুত্ব নিয়ে আমার একটু ভিন্ন রকমের ব্যাখ্যা আছে। সেটা হলো- যেমন তারা (শাসকগোষ্ঠী) এটাও বলতে পারে যে প্রতিবেশী দেশ ভারত আমাদের বন্ধু। দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়গুলোতো আমরা দেখছি। এমন বন্ধুত্বে চিন্তার কারণ রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনাকে “মানসিকভাবে অসুস্থ' বলেছেন। কেনো তিনি আপনাকে একটা হুমকি হিসেবে দেখছেন। সঞ্চালকের এমন প্রশ্নে শহীদুল বলেন-“সেটা কী কারণে আমি বুঝতে পারছিনা। আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করি, স্পষ্টভাষী, যেটা বলি বলিষ্টভাবে বলি। এটাতো কোনো সরকারের জন্য হুমকি হতে পারেনা। তবে এক্ষেত্রে সরকার হুমকি মনে করছে। কেবল আমি নই, সরকারের আক্রোশের শিকার হয়েছেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, প্রধান বিচারপতিকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। আমাকেও তারা এরকম একটি পথের কাঁটা মনে করেছে। এসময়টাতে নির্বাচন অত্যাসন্ন ছিলো। আমি তখন সত্য বলছিলাম। এটা সহ্য না হবার কারণ হতে পারে।”

আদালতে শহীদুল আলমের চলমান মামলার প্রসঙ্গ তোলে সঞ্চালক মেহদি হাসান বলেন, এ মামলায় আপনার ১৪ বছরের জেল হবার ঝুঁকি আছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই পুলিশ যেকাউকে আটক করতে পারে। এটির কড়া সমালোচনা করেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলোও। আপনি আপনার মামলার আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেছেন। এ মামলায় হেরে গেলে আপনার বা যে সকল সাংবাদিক লড়ছেন তাদের পরিণতি কি হতে পারে বলে আপনার ধারণা।
এমন প্রশ্নে শহীদুল বলেন, “বিষয়টা হলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এটা যেকোনো গণতন্ত্রের জন্য অত্যাবশ্যক বিষয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্র আছে কি না? এটাই আজকে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।এ মামলায় হেরে যাওয়া হবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় পরাজয়। বড় পরিসরে বললে সাধারণ মানুষের জন্য এটা হবে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক।”

বাংলাদেশে গণতন্ত্র সচল আছে কি না-এমন এক প্রশ্নের জবাবে টাইম ম্যাগজিনের বর্ষসেরা এই আলোকচিত্রী বলেন, “যেভাবে এটা চলছে তাতে গণতন্ত্র নেই। যা হচ্ছে তা স্বৈরতান্ত্রিক। এটা যে সবসময়ের বাংলাদেশের চিত্র তা কিন্তু নয়। যেটা সত্য সেটা হলো এ সময়ের কিছু বিষয় আসলেই অবনতিশীল। সব মিলিয়ে যদি বলি- ১৯৭২ সালে যখন বাংলাদেশ থেকে বের হই তখন সেটা ছিলো স্বাধীন একটা দেশ। যখন ফিরলাম তখন দেখলাম সেনাবাহিনীর একনায়কতন্ত্র। তারা নির্বাচন দিয়েছিলো কিন্তু প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ ছিলোনা, মানুষের তাতে আগ্রহ ছিলোনা।”
৩০ ডিসম্বরের জাতীয় নির্বাচন আর তাতো ভোট জালিয়াতির অভিযোগ এবং শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার প্রসঙ্গে করা এক প্রশ্নের জবাবে শহীদুল বলেন, “আমি নিজেকে (সরকার সমালোচক হিসেবে) কখনো সংখ্যা লঘু মনে করিনা।এটা ঠিক যে তাঁর (শেখ হাসিনা) কিছু সমর্থক আছে। কিন্তু আসল কথা হলো দেশে এখনো ধর-পাকড় অব্যাহত আছে। আমি যখন রাস্তায় বের হই তখন লোকজন আমাকে জড়িয়ে ধরে। তাদের কান্না আমি দেখেছি। তারা তাদের কষ্ট আমার কাছে বলে কিন্তু তারা তাদের কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেনা। বাইরের (সরকার ব্যাতীত) পরিস্থিতিটা আসলেই ভয়ংকর। আমি মনে করি এরকম একটা পরিস্থিতি এখন পরিচালনা করা হচ্ছে, নেতৃত্ব দেয়া হচ্ছে।”
সরকারের শাসনামলে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আয়ুষ্কাল বৃদ্ধিসহ যাবতীয় উন্নয়নকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন। এটা কি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়ন নয়?-এমন প্রশ্নে শহীদুল বলেন-“এটাকে অস্বীকার করার সুযোগ নয়। বাস্তব হলো দেশের এ সমৃদ্ধির জন্য প্রকৃতপক্ষে যাদের সত্যিকারের অবদান তারা হলেন অভিবাসী, পোশাক শ্রমিক আর মাঠের কৃষকেরা। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে খুব দ্রুত একটি ধনিক শ্রেণী গড়ে উঠেছে । গত ১১ বছরে দেশের বাইরে ৮৩ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। এটাকা অর্জন করেছে যারা তারা সুফল পাচ্ছেনা অথচ এটাকে ইচ্ছেমতো অপব্যবহার করছে গুটিকয় মানুষেরা।”

আপনি বাংলাদেশে অবস্থান করা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন আলোকচিত্রী। নিজের কাজের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উত্তরণে কতটা অবদান রাখতে পারছেন বলে মনে করেন। যেখানে সমালোচকরা বলছেন বাংলাদেশ স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগুচ্ছে। এমন প্রশ্নে শহীদুল বলেন, “এক্ষেত্রে দুধরণের প্রত্যাশা থাকে। প্রথমটা হলো-জবাবদিহিতা আর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। এটা যেকোনো সিস্টেমের জন্য জরুরি। তিনটা জায়গায় কাজ করি-গণমাধ্যম, শিক্ষা আর সংস্কৃতি। চলমান রাষ্ট্র এগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ তিন জায়গার মাধ্যমে আমরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রটাতে চাপ তৈরির সুযোগ পাই যাতে করে এটা পথ না হারায়। দেশের গণতান্ত্রিক প্রথা ও প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের পথে সব সরকারের সময়ই কমবেশি ঘটেছে। তবে এসময়টাতে যা ঘটছে এর আগে এতোটা খারাপ ছিলোনা।”

দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অন্যদের প্রতি আপনার বার্তা কি এমন প্রশ্নে শহীদুল বলেন, “যারা একনায়কতন্ত্রের ভূমিকা রয়েছেন সেটা একটা বিপদসংকুল বিষয়। বিদেশীরা মুখে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের কথা বলে কিন্তু বাস্তবে তাদের আন্তরিকতা দেখছিনা। তারা নিজস্বার্থে স্বৈরাচারদেরও পৃষ্ঠপোষকতা করে । রোহিঙ্গা ইস্যু এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমরা সিদ্ধান্তগত সমস্যার প্রকটতা দেখতে পাচ্ছি।”

আল-জাজিরায় সাক্ষাত দেবার কারণে জেল খেটেছেন। এখন আবার সাক্ষাতকার দিচ্ছেন। আপনি নিসন্দহে একজন সাহসী মানুষ। দেশে ফেরার পর কি হয় তা নিয়ে শংকিত কিনা-এমন প্রশ্নে শহীদুল বলেন-“আমি স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমাদের সংবিধান স্বাধীন চলাচল ও মতপ্রকাশের অধিকার দিয়েছে। আমি অধিকারের চর্চা করবো আর তাতে কারো সমস্যা হলে সেটা তাদের সমস্যা, আমার নয়।”

জিএস/