দুর্নীতি মামলাকে ‘অনৈতিক’ বললেন সিনহা

‘সরকারের পছন্দমতো রায় না লেখায় গৃহবন্দি রাখা হয়েছিল’

‘সরকারের পছন্দমতো রায় না লেখায় গৃহবন্দি রাখা হয়েছিল’ দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া রওয়ানা দেবার আগ মুহূর্তে নিজের সরকারি বাসভবনের গেটে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। ১৩ অক্টোবর ২০১৭-বেনারনিউজ

জনসম্মুখে হেয় প্রতিপন্ন করতেই ক্ষমতাসীন সরকার দুর্নীতির মামলা দায়ের করেছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।

ঢাকায় সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হওয়ার একদিন পর ওই মামলা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটন ভিত্তিক মুক্ত গণমাধ্যম বেনারকে তিনি এই কথা বলেন।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনী ‘অ্যা ব্রোকেন ড্রিম- রুল অব ল, হিউমেন রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’র সূত্র ধরে তিনি তাঁর ওপর ঘটে যাওয়া অবিচারের উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, “আমাকে ১৫ দিন গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল।”

আত্মজীবনীতে সরকারের পছন্দমতো রায় লিখতে রাজি না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখা এবং চাপ দিয়ে দেশত্যাগ ও পদত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ করেছেন এস কে সিনহা।

বর্তমান সরকারের অধীনে ন্যায়বিচার আশা করা যায় না বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি । “এটি অনৈতিক, অন্যায়। তারা আমাকে জনসম্মুখে হেয় প্রতিপন্ন করতে চায়,” বেনারকে বলেন বিচারপতি সিনহা।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণকে কেন্দ্র করে সরকারের সাথে মতবিরোধ সৃষ্টি হয় এস কে সিনহার। এরই জের ধরে ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর প্রথমে ছুটি নিয়ে বিদেশ যান তিনি। পরে সেখান থেকেই রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত বিচারপতি সিনহা গত কয়েক দিন ধরে নিজের ছোট মেয়েকে দেখতে স্ত্রীসহ কানাডায় রয়েছেন। সেখান থেকে টেলিফোনে বেনারের সাথে কথা বলেন তিনি।

দুর্নীতি মামলা হওয়ার সংবাদটি তাঁর স্ত্রী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখে তাঁকে বলেছেন জানিয়ে বিচারপতি সিনহা বলেন, “আমি হাসব না কাঁদব, সেটাই ভাবছি!”

ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে জালিয়াতির মাধ্যমে ৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে এই মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বুধবার সংস্থাটির জেলা সমন্বিত কার্যালয় ঢাকা-১ এ সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বাদী হয়ে মামলাটি করেন।

বাংলাদেশে সাবেক কোনো প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে মামলার ঘটনা এটাই প্রথম।

“আপনার কি মনে হয় আপনি এই মামলায় ন্যায়বিচার পাবেন?” বেনারের এমন প্রশ্নে সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, “যখন আমি কর্মরত প্রধান বিচারপতি ছিলাম, তখনই ন্যায়বিচার পাইনি। তাহলে এখন কীভাবে আশা করব?”

তাঁকে চাপ ও হুমকি দেওয়ার জন্য সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকেও (ডিজিএফআই) আত্মজীবনীতে অভিযুক্ত করেন তিনি।

“শেষ পর্যন্ত, আমার পরিবারের ওপর সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইর চাপ ও হুমকির মুখে আমি দেশের বাইরে থেকে পদত্যাগপত্র জমা দেই,” আত্মজীবনীর ভূমিকায় জানিয়েছেন বিচারপতি সিনহা।

তবে তাঁর অভিযোগগুলোকে ‘ভিত্তিহীন ও মনগড়া’ হিসেবে উল্লেখ করে তাঁর ওপর কোনো ধরনের নির্যাতনের কথা অস্বীকার করেছে সরকার।

আত্মজীবনী প্রকাশের প্রায় এক বছরের মাথায় তাঁর বিরুদ্ধে বুধবার দুর্নীতির দায়ে মামলা দায়ের করল দুদক। যদিও মামলাটি এখনো প্রাথমিক স্তরে রয়েছে বলে বেনারকে জানান দুদকের আইনজীবী খুরশেদ আলম খান।

“এটা একটা মানি লন্ডারিং মামলা। এটা তথ্য উপাত্তের ওপর ভিত্তি করেই হয়েছে। এটা খুব ইনিশিয়াল স্টেজে আছে। এখন তদন্ত হবে, তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে। এটা সময়ের ব্যাপার,” বেনারকে বলেন খুরশেদ আলম।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “আমরা আশা করব সাবেক প্রধান বিচারপতি ন্যায় বিচার পাবেন। ন্যায় বিচারে মাধ্যমেই তিনি দোষী কিংবা নির্দোষ সাব্যস্ত হবেন।”

দুর্নীতি মামলা

দুদক সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে এ অনুসন্ধান শুরু হয়। ফারমার্স ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনা অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিষয়টি নজরে আসে। পরে দায়িত্ব পেয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে প্রতিবেদন জমা দেন সংস্থার পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন ও সহকারী পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত দল। এর পরে দুদকের অনুমতিতে এই মামলাটি করা হয়।

মামলার অন্য আসামিরা হলেন ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) সাবেক এমডি এ কে এম শামীম, সাবেক এসইভিপি গাজী সালাহউদ্দিন, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সাফিউদ্দিন আসকারী, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, টাঙ্গাইলের বাসিন্দা মো. শাহজাহান, একই এলাকার নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা, রনজিৎ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী সান্ত্রী রায়।

“দেশের ইতিহাসে এই প্রথম একজন সাবেক বিচারপতি দুর্নীতি মামলার মুখোমুখি হলেন, এটা ভালো লক্ষণ নয় এবং বিচারব্যবস্থার জন্য এটা হুমকি,” বেনারকে বলেন সুপ্রীম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন।

জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী বলেন, এসকে সিনহা নিজেই বলেছেন যে, তাঁকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। তিনি স্বেচ্ছায় দেশ ছাড়েননি। তাই এই মামলার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

“দুদকের মানি লন্ডারিং মামলাগুলো সাধারণত তথ্য এবং রেকর্ডের ওপর ভিত্তি করে হয়। তাই এই মামলার মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন, এটা বলার সুযোগ নেই,” বেনারকে বলেন দুদক আইনজীবী খুরশেদ আলম।

জিএস/