একনায়কের বিদায়, গদিতে বসা আরেক একনায়ক

একনায়কের বিদায়, গদিতে বসা আরেক একনায়ক

শেখ হাসিনা যেভাবে দেশ চালাচ্ছেন তা স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতির শাসন ছাড়া আর কিছুনা। এমন স্বৈরতান্ত্রিক চিন্তা এরশাদের মাথাতেও আসেনি।বাংলাদেশে একনায়কের বিদায় হয়েছে। আর সে বিদায়ের পর ক্ষমতার গদি আঁকড়ে আছে আরেক একনায়ক।

এশিয়ান টাইমসে প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর হালচাল নিয়ে এমনি সোজাসাপ্টা অভিমত ব্যক্ত করেছেন জন কনারস। “এস বাংলাদেশ বুরাইজ ওয়ান ডিকটেটর, এনাদর হোল্ডস ফার্ম,” শিরোনামের এই সম্পাদকীয়টি প্রকাশিত হয় ৩১ জুলাই। জাস্ট নিউজ পাঠকদের জন্য তার ভাবানুবাদ প্রকাশ করা হলো:

১৯৮০ পরবর্তী দশকে যে জেনারেল এরশাদ বাংলাদেশ শাসন করেছেন গত ১৪ জুলাই তিনি ইন্তিকাল করেছেন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিরক্তিকর একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে। সদ্য যৌবনে পা রাখা দেশটির সবচাইতে বিতর্কিত শাসনামল ছিলো সেটা। বাংলাদেশিরা তার বিদায়ে পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পাবে কীভাবে একজন স্বৈরশাসন চালিয়েছিলো আর পরবর্তীতে কীভাবে সে রাজনীতির ছায়ায় পালিত হলো। এরশাদের এই রাজনৈতিক প্রভাবকে আজো খেলো হিসাবেই দেখা হয়।

বাংলাদেশের রাজনীতির হিসেব-নিকেশে একমাত্র স্বৈরশাসকে হিসেবে যাকে দেখা হয় তিনি হলেন এরশাদ।

অতীতের যারা সাক্ষী তারা ১৯৮২ সালে সাবেক এই ক্ষমতাধর শাসকের (এরশাদ) মার্শাল ল জারিকে উঠতি বাংলাদেশের গণতন্ত্র ধ্বংসের নকশা মনে করেন। তরুণ বাংলাদেশিরা তাকে শুধুমাত্র একজন সুবিধাবাদী হিসেবেই চিনে। অধিকন্তু এরশাদ ছিলেন স্বৈরশাসক, স্বৈরতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

এরশাদকে আমরা যেভাবেই স্মরণ করিনা কেন বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনীতির হিসেবে তাকে কিছুতেই অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। অন্ততপক্ষে তিনি ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনাকে যেভাবে সমর্থন যুগিয়েছেন সেটার জন্য হলেও তাকে মনে রাখতে হয়। ১৯৭৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত একের পর এক যতো সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে তাতে এরশাদের কল-কাঠি নাড়ায় শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ উপকৃত হয়েছে। সেই ফলের ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে দলটি ভালো একটা বিজয় পেয়েছে!

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা অর্জনের পর বাইরের দিক থেকে সবার প্রত্যাশা ছিলো বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক উপায় এবং পন্থাগুলো বিকশিত হবে। দেশ স্থিতিশীল হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, হাসিনা যেভাবে দেশ পরিচালনা করে যাচ্ছেন তা স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতির বাস্তবায়ন। এরকম স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতি এরশাদের মাথাতেও আসেনি।

প্রধান সব বিরোধীদলগুলো ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বয়কট করেছিলো। ২০১৮ সালেও স্পষ্টত অস্বচ্ছ নির্বাচন হয়েছে যেটাকে নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে “প্রহসন”।

ক্ষমতায় ঠিকে থাকার জন্য হাসিনাকে কোনো অভ্যুত্থান করতে হয়না। কিন্তু বিরোধীদলকে শেষ করে দেবার যে নির্ভার পন্থা তিনি বেছে নিয়েছেন তাতে করে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র বিকাশের আশা অংকুরে মরে যাচ্ছে। ২০১৮ সালের ভোটে অংশ নিয়েছিলো বিএনপি। কিন্তু মিথ্যা অভিযোগে দলটির হাজারো নেতা-কর্মী আর নির্বাচনী প্রার্থীকে গ্রেফতারের মুখোমুখি হতে হয়। ভোটের দিনেও ৪০ এর বেশী প্রার্থী নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলো।

হাসিনা সরকারের অধীনে রাজনৈতিক বিরোধী কর্মী এবং সমালোচকদের সহিংসভাবে দমন করা হয়। আইনের ইচ্ছামতো বদল করে সমাজকর্মী, সাংবাদিক এবং শিল্পীদের আটকে এবং জেলে পুরা হয়। বাংলাদেশে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বাহানা করে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে ব্যবহার করে শতাধিক লোককে হত্যা করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে হাজারো মানুষকে। রাজপথে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পুলিশি হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে।

যারা অনলাইনে সরকার, প্রধানমন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর স্বজনদের যারা সমালোচনা করে তাদের আটক করতেই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বানানো হয়েছে। ২০১৮ সালের আগস্টে ফেসবুকে এবং আল-জাজিরায় মানবাধিকার লংঘন নিয়ে কথা বলার অপরাধে সাংবাদিক এবং সমাজকর্মী শহীদুল আলমকে ১০৭ দিন জেলে থাকতে হয়েছে।

সবচাইতে অন্যায় আচরণের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে বিএনপি এবং তার নেতাকর্মীদের। দুর্নীতি দমন কমিশনের আবদনের প্রেক্ষিতে দেশটির প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সাজা ৫ বছর থেকে দ্বিগুণ করে সেটা ১০ বছর বানানো হয়েছে। গত বছরের শুরু দিকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে সাজা দেয়া হয়। এটাকে ২০১৮ সালের নির্বাচন থেকে খালেদা জিয়াকে বঞ্চিত করার কৌশল বলেছেন সমালোচকরা। আর শেষমেষ সে বুদ্ধিই কাজে লাগানো হলো।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেছেন, “২০১৮ সালের বাংলাদেশ নির্বাচনে যেটা খোলাখুলিভাবে দৃশ্যমান হলো তা হলো সরকার শক্ত হাতের ভয় দেখিয়ে তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করছে।”

“সরকারের উচিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মুক্ত মতপ্রকাশ, আইনের স্বাধীনতা এবং গতিশীল সুশীল সমাজকে স্বীকৃতি দেয়া।”

হাসিনার সমর্থকরা তার নেতৃত্বকে বৈধতা দিতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বুলি কপচায়।

হাসিনার একনায়কতান্ত্রিক শাসনে অস্থিরতা ক্রমশ বড়ছে। আর সেটা এখনকার জন্য যেমন, তেমনি দীর্ঘ মেয়াদের জন্যও একটা ঝুঁকি। তার সরকার যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলছে সেটা একটা ঝুঁকি হিসেবে থেকেই যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা যখন রাজপথে নেমে আসে তখন থ্রিজি এবং ফোরজি নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয় সরকার।

উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ায় বাংলাদেশের অংশীদার যারা রয়েছে তাদের উচিত সরকারের এসব নীতির বিরুদ্ধে মুখ খোলা।

শেখ হাসিনা ধারাবাহিকভাবে কঠোর হস্তে নির্যাতন করে তার সমালোচকদের মুখ বন্ধ রাখতে চাইছে। এতোকিছু করেও তিনি জাতিসংঘ থেকে “চ্যাম্পিয়নস অফ দ্যা আর্থ” পুরস্কার বাগিয়ে নিয়েছেন। পরিবেশ নিয়ে সংবিধান ধারা সংশোধন করার কারণে জাতিসংঘ যখন তাকে স্পষ্টত পুরস্কৃত করছে ঠিক সেই সময়টাতেই গণতন্ত্র সুরক্ষার প্রতি তার যে অবজ্ঞা সে বিষয়টি কিন্তু দৃষ্টিসীমার বাইরে ফসকে যাচ্ছে।

যখন মিয়ানমার, থাইল্যান্ড এবং হংকংয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা নিয়ে কথা হয় তখন কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবনতির বিষয়টি নিয়ে কথা হয়না। ভালো পরিবেশে রাজনীতি থেকে মানুষ কী প্রত্যাশা করতে পারে -এরশাদের মৃত্যু সে বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবিয়ে তুলছে।

জিএস/