যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার রিপোর্ট: মন্ত্রীর প্রশংসাপত্র বিলি ও বাস্তবতা

যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার রিপোর্ট: মন্ত্রীর প্রশংসাপত্র বিলি ও বাস্তবতা

মুশফিকুল ফজল আনসারী

মানবপাচার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে গেলো সপ্তাহে। ২০১৯ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০২০ মার্চ ৩১ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের সরকার মানবপাচার রোধে কতটা ভূমিকা পালন করেছে তার একটা খতিয়ান তুলে ধরা হয়েছে এ বছরের রিপোর্টে। যুক্তরাষ্ট্রের রিপোর্টে মানবপাচার পরিস্থিতিকে চারটি ধাপে ভাগ করা হলেও এগুলো আসলে উন্নয়নের কোনো ধাপ নয় বরং মানবপাচারের মতো একট অপরাধযোগ্য বিষয়ে কোন দেশ কোন অবস্থায় রয়েছে তার একটা কাটা-ছেঁড়া বিশ্লেষণ।

রিপোর্টটি প্রকাশ পর বাংলাদেশ একধাপ উন্নতি করেছে মর্মে দেশের মন্ত্রীদের মুখে ধন্য ধন্য সুর উঠেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলো রিপোর্টের ভিতরে এবং বাইরে রিপোর্ট প্রকাশ কেন্দ্রিক সার্বিক মানবপাচার পরিস্থিতির হতাশাজনক চিত্র বের হয়ে এসেছে। পৃথিবীর কোনো দেশের রিপোর্টে সরকার দলীয় এমপি বা উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা মানবপাচার জড়িত থাকার অভিযোগ আসেনি। সেটা এসেছে রিপোর্টের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারে, যেখানে অর্থ ও মানবপাচারকারি শহীদুল ইসলাম পাপুল এমপির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। পাপুল ইস্যুতে টালমাটাল হয়ে উঠেছে কুয়েত প্রশাসন। শুধু নিজে যে অর্থ ও মানবপাচার করেছে তা নয়, ঘুষ দিয় বাগিয়ে নিয়েছেন দেশটির গুটি কয়েক বড় কর্মকর্তাকে। তার কাছ থেকে ঘুষ নেবার দায়ে বরখাস্ত করা হয়েছে কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অ্যাসিসট্যান্ট আন্ডার সেক্রেটারি মেজর জেনারেল মাজেন আল-জাররাহকে। তদন্তের মুখোমুখি কুয়েত সরকারের একাধিক উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ প্রশাসনে এ বিষয়ে চলছে সুনশান নিরবতা।

যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার রিপোর্ট প্রকাশের পরপরই শুক্রবার তড়িত গতিতে ভার্চুয়াল কনফারেন্সে বাংলাদেশের উন্নতি হয়েছে বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। খুশিতে গদ গদ হয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ। বিষয়টিকে 'সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টার একটি স্বীকৃতি' এমন ঢোল পিঠিয়ে সরকারি প্যাডে কয়েকজন সাংবাদিককে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। সেই চিঠি এখন ভাসছে নেটি ওয়ালের জালে।

ধাপ বিন্যাস নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রিপোর্ট কী বলে

যুক্তরাষ্ট্রের ট্র্যাফিকিং ইন পারসনস (টিআইপি) রিপোর্টে প্রথম স্তর, দ্বিতীয় স্তর, দ্বিতীয় স্তর নজরদারি ও তৃতীয় স্তর এরকম চারটি ক্যাটাগরি রয়েছে। ক্যাটাগরি নিয়ে পরিস্কার একটা ধারণা দেয়া আছে রিপোর্টের ৩৯ তম পৃষ্ঠায়।

পৃষ্ঠার শুরুতেই বলা আছে, "যুক্তরাষ্ট্রের ট্র্যাফিকিংস ভিক্টিমস অ্যাক্ট (টিভিপিএ) মানদন্ড বিচার অনুসারে প্রতিটি দেশকে চারটি স্তরে ভাগ করা হয়। দেশে কত সমস্যা রয়েছে সেটা নয় বরং টিভিপিএ অনুসারে মানবপাচার রোধে একটি দেশের সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে সেটা বিবেচনা করা হয়।"

মানবপাচারে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রসঙ্গে রিপোর্টে বলা হয়, "দ্বিতীয় স্তর-এ অবস্থানের অর্থ হলো, পাচার নির্মূলের লক্ষ্যে ন্যূনতম মান অর্জনে বাংলাদেশ সরকার উল্লেখযোগ্য ও ক্রমবর্ধমান প্রচেষ্টা নিচ্ছে। পুরোপুরি এই মান অর্জন এবং এই ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড নির্মূলে আরো কাজ বাকি রয়েছে।"

"গুরুত্বপূর্ণ যে পদক্ষেপগুলোর ফলে গত বছর মানব পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশের অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সাতটি মানব পাচার ট্রাইবুনাল গঠন এবং বিদেশে কাজের জন্য গমনেচ্ছু বাংলাদেশীদের শোষণকারী নিয়োগ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ।"

প্রথম স্তর সম্পর্কে রিপোর্টের বিবরণে বলা হয়েছে, "কোনো দেশের 'টিয়ার-১' চলে আসা মানে এমনটা না যে সেদেশে আর মানবপাচার নেই। বিষয়টা এমনও না যে মানবপাচার বন্ধে যথেষ্ট করে ফেলেছে দেশটি।বরং আমরা এটা বলতে পারি যে, মানবপাচার রোধে সরকার তার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যা টিভিপিএ'র সর্বনিম্ন মানদন্ডগুলো পূরণের শর্তের সঙ্গে যায়।

'টিয়ার-১' অবস্থান ধরে রাখতে হলে প্রতিবছর সরকারকে গ্রহণযোগ্য অগ্রগতি দেখাতে হবে। প্রকৃত কথা হলো 'টিয়ার-১' অবস্থান নেয়া মানে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া। এর মানে দায়মুক্ত হয়ে যাওয়া নয়।"

বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের এই চার ধাপের দ্বিতীয় স্তর নজরদারি তালিকা থেকে এ বছর দ্বিতীয় স্তরে অবস্থান করছে। সেটাকেই সাফল্য বলে জনমনে একটা উন্নয়ন ধোঁয়াশা তৈরির প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন সরকারের মন্ত্রীরা।

কতোটা উন্নতি আমাদের

ভোট চুরি করে ক্ষমতায় আসা সরকার তথ্য চুরি করে মানুষকে ধোঁকা দিতে চাচ্ছে। উন্নয়ন বা উন্নতি আসবে কোত্থেকে যদি রক্ষক বসে যান ভক্ষকের চেয়ারে! যারা মানুষের অধিকারকে দমন করেছে তারা অধিকার কী ফিরিয়ে দেবে?

এবার দৃষ্টি দেয়া যাক রিপোর্ট প্রকাশ উপলক্ষে স্টেট ডিপার্টমেন্টের ভার্চুয়াল কনফারেন্স রিপোর্টের চুম্বক অংশে। ওই কনফারেন্সে একমাত্র বাংলাদেশী প্রতিনিধি হিসাবে প্রশ্ন উত্থাপন করেন এই প্রতিবেদক।

যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার পর্যবেক্ষণ এবং মোকাবিলা বিষয়ক বিভাগের প্রধান অ্যাম্বাসেডর এ্যাট লার্জ জন কটন রিচমন্ড কোনো রাখ-ঢাক না করেই সংবাদ সম্মেলনে বলেন, "মানবপাচারের সঙ্গে সরকারের কর্মকর্তারাও জড়িত। আর তাদের জড়িত থাকার বিশদ রিপোর্ট রয়েছে।"

তিনি বলেন, "বাংলাদেশ একটা জটিল জায়গা, দেশটিতে মানবপাচার সক্রিয় থাকার পেছেন বিভিন্ন রকমের কারণ জড়িত। আমরা অনেকগুলো বিষয় পর্যবেক্ষণ করেছি যেগুলো উদ্বেগের।"

বাংলাদেশে মানবপাচারের উদ্বেগের আরেকটা সুনির্দিষ্ট বিষয় হলো যৌন কাজে বাধ্য করা উল্লেখ করে রিচমন্ড বলেন, "যৌন কাজে বাধ্য করার জন্য রাজধানীর যৌনপল্লীগুলোতে যেসব মানবপাচার হচ্ছে সে বিষয়ে সরকার যা করছে তা খুবি তুচ্ছ। এগুলো বিশ্বের বড় যৌনপল্লীগুলোর একটি। এসব যৌনপল্লীতে মানবপাচার নিয়ে আমরা খুবি উদ্বিগ্ন। সরকারকে আহবান জানাবো তদন্ত করে দেখতে।"

তিনি বলেন, প্রাপ্ত বয়স্ক বা কম বয়সী যাই বলুন না কেন আমরা সবার কাছ থেকেই জোরপূর্বক যৌন কর্মে বাধ্য করার অভিযোগ পেয়েছি।

সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে বাংলাদেশির জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করা হচ্ছে মন্তব্য করে রিচমন্ড বলেন, "বাংলাদেশ সরকারকে আমরা মানবপাচারের এ বিষয় খতিয়ে দেখতে বলেছি এবং যারা এসব জোরপূর্বক কাজে বাধ্য করছে তাদের যোগসূত্র বের করতে আহবান জানিয়েছি।"

এবার নজর দেয়া যাক রিপোর্টের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারে।

বাংলাদেশ অংশ বলা হয়েছে, "মানবপাচারের ঘটনায় সংঘটিত মামলাসমূহের তদন্ত কমিয়ে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী।প্রশাসনের লোকদের এর সঙ্গে জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ থাকা স্বত্ত্বেও এতে কোনো রকমের পাত্তা দিচ্ছেনা। রোহিঙ্গা নারীদের বিদেশে বাধ্যতামূলক শ্রম প্রদান এবং যৌন কর্মে বাধ্য করা সংক্রান্ত হাজারো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ থাকা স্বত্ত্বেও এসব নিয়ে কোনোধরনের তদন্ত করেনা বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী।"

মানবপাচারে শুধু সরকারি কর্মকর্তারাই নয় বরং এমপিরাও জড়িয়ে পড়েছে উল্লেখ করে রিপোর্টে বলা হয়, "বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তাসহ এমপিরাও বিদেশে চাকরি দেওয়ার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যোগসাজোশ গড়ে তুলেন। এটি অভিবাসনবান্ধব পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক। এর ফলে রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিগুলো অভিবাসী শ্রমিকদের ঠকায় এবং তাদেরকে সুরক্ষার বিষয়টি বাধাগ্রস্ত করে।"

লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি পাপুলের মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয় উল্লেখ করে রিপোর্টে বলা হয়, "কুয়েতি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে ২০,০০০ বাংলাদেশিকে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে কুয়েতে নিয়ে যায় পাপুল। এক্ষেত্রে চুক্তি অনুযায়ী তাদের যে চাকরি দেওয়ার কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা দেয়া হয়নি। যে বেতন নির্ধারণ করা হয়েছিল তার থেকে কম বেতন পেয়েছে অথবা একদম পায়নি।"

মালয়েশিয়াতে মানবপাচারের প্রসঙ্গ এনে রিপোর্টে বলা হয়, "মালয়েশিয়ার চাকুরি প্রদানকারী এজেন্সিগুলো এবং বাংলাদেশের ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি উভয় দেশের কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের ঘুষ দিয়ে বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়াটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চেয়েছিলো। প্রতিটি ব্যক্তির কাছ থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়েছে। যদিও মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য সরকারের নির্ধারিত ফি ছিল ৩৭,০০০ টাকা। এর ফলে অভিবাসীরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে।"

যেসমস্ত সাংবাদিকরা আহ্লাদে গদগদ হয়ে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রীর দেয়া প্রশংসাপত্র শেয়ার করছেন এটা গণসংযোগ কর্মকর্তাদের মানালেও সাংবাদিকদের নয়। বরং নতজানু এবং জ্বি হুজুর, জাহাপনা’র নামান্তর।

জিএস/