সাহেদের গ্রেফতার...আর আ'লীগের 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি'

সাহেদের গ্রেফতার...আর আ'লীগের 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি'

বৈশ্বিক মহামারিতেও দেশে এবং বিদেশে শিরোনাম হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। করোনাভাইরাস মোকাবেলার ব্যর্থতা ঢাকতে নানান কায়দা প্রয়োগ করছে ক্ষমতাসীন সরকার কিন্তু হালে পানি পাচ্ছেনা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য মহামারিকে পুঁজি করে মুনাফা বাগিয়ে নিতে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কান্ডে জড়িত হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। বিপদে শোষণ আর ধোঁকাবাজির সর্বশেষ নমুনা হলো আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য ও রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম।

মহামারির মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে যে প্রতারণা এই আওয়ামী লীগ নেতা করেছেন তা নিয়ে ধিক্কার উঠেছে পুরো দেশে। কোনো ধরনের টেস্ট না করেই তিনি বিলি করেছেন হাজারো করোনাভাইরাস নেগেটিভ হবার সনদপত্র। এমনকি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিকের উপস্থিতিতে আয়োজন করেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাথে চুক্তি করেন এই প্রতারক। বিষয়টি জনসম্মুখে চলে আসার পর এখন তার মোড় ঘুরাতে আদা-জল খেয়ে নেমেছে সরকার।

শুধু তাই না সাহেদ দলটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য তাও রীতিমত অস্বীকার করে বসেছে সরকার। জনগণের তীব্র প্রতিক্রিয়া আর বৈশ্বিক চাপের মুখে পড়ে সরকার সাহেদ গ্রেফতারকে নিজেদের অনিয়মের বিরুদ্ধ কঠোর অবস্থান-এমন একখানা ভাব করে চালিয়ে দিতে চাচ্ছে।

ক্ষমতাসীন দলের পদবি ব্যবহার, টকশো, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম ভাঙ্গানো আর হাসপাতাল ব্যবসা ব্যবহার করেই ওপরে উঠে আসেন সাহেদ করিম। আর এসব দেখেও না দেখার ভান করেছেন ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপিরা।

বিদেশেও আলোচিত সাহেদ

শুধু দেশে নয় সাহেদের কীর্তিকলাপ নিয়ে রিপোর্ট ছেপেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দ্য নিউইয়র্ক টাইমস। পত্রিকাটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, "তিনি (সাহেদ) কোন টেস্ট ছাড়াই প্রবাসী শ্রমিকদের কাছে হাজার হাজার ভুয়া করোনাভাইরাসের সার্টিফিকেট বিক্রি করেছেন। করোনাভাইরাসের ১০,০০০ এর অধিক সার্টিফিকেট বানিয়েছেন যার বেশিরভাগই ভুয়া। নিজের হাসপাতাল থেকেই টাকার বিনিময়ে এসব ভূয়া সার্টিফিকেট ব্যবসা করেছেন।"

এতে বলা হয়, "বাংলাদেশের যেসব শ্রমিক ইউরোপে কাজ করেন তাদের কাছে এসব সার্টিফিকেটের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।ইতালিতে ফেরত যাওয়া অনেক বাংলাদেশি এই ভূয়া সার্টিফিকেট ব্যবহার করেছেন।"

রিপোর্টে বলা হয়, "করোনাভাইরাস পজিটিভ হওয়ায় ইতালির স্বাস্থ্যমন্ত্রী রবার্তো স্পেরাঞ্জা বাংলাদেশ থেকে ইতালি যাওয়া সব ফ্লাইট বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। গেল সপ্তাহে রোম এবং মিলান বিমানবন্দরে পৌঁছা ১৬৮ বাংলাদেশীকে ইতালি ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে।"

সাহেদ আ’লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য

সাহেদ করিম দলের কেউনা এমনটা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ। অথচ দলটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর এক রিপোর্টে বলেছেন, "রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম প্রায়ই আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির বৈঠকে যোগ দিতেন।তিনি দলটির সাবেক একটি কমিটির সদস্যও ছিলেন।"

মোহাম্মদ জমির বলেন, "সাহেদ করিম মাঝে মাঝে আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির বৈঠকে আসতেন। তিনি সাবেক একটি কমিটির সদস্য ছিলেন।"

তিনি আরো বলেন, "তার সঙ্গে (সাহেদ) কমিটির বৈঠকে দু–চারবার দেখা হয়েছে। আর দেখা হয়েছে টিভির টক শোতে।"

সাহেদকে নিয়ে করা এক প্রতিবেদনে বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, "আওয়ামী লীগের নেতারা জানিয়েছেন, ২০১৫ সালের আগেও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সাহেদ করিমের কোন সম্পৃক্ততা ছিল না। তবে ২০১৬ সাল থেকে তিনি বিভিন্ন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন।

২০১৭ সালে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য হন। তবে গত ডিসেম্বরে ২১ তম সম্মেলনের পর নতুন উপ-কমিটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।"

রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তি হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে

রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তির সময় তাতে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি এবিষয়টিকে এখন আড়াল করতে চাচ্ছেন। একটি দৈনিককে দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন, "অধিদপ্তর ওই লোকটাকে (রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ) ওখানে এনেছে। কে এনেছে, কীভাবে এনেছে, জানি না। অধিদপ্তরই ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সইয়ের শর্ত ঠিক করেছে। তারপর আমাদের দাওয়াত দিয়েছে। আমাদের তারা জানিয়েছে, “আপনারা থাকলে একটু ভালো হবে, প্রেস কভারেজ ভালো হবে।” তাই আমরা হাসিখুশিভাবেই চুক্তি করেছি।"

অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এর পূর্বে ১১ জুলাই বলেছে, "মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল বিভাগ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেয়।"

কূটনীতিকদের রিজেন্টে যেতে পত্র জারি

উত্তরার বহুল আলোচিত রিজেন্ট হাসপাতালসহ ৩টি হাসপাতাল বিদেশি কূটনীতিকদের জন্য ডেজিগনেটেড বা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছিল। ২৪ শে মার্চ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই তিন হাসপাতালের নাম উল্লেখ করে ঢাকাস্থ সব বিদেশ মিশনে নোট ভারবাল পাঠায়। তাতে করোনা চিকিৎসার জরুরি প্রয়োজনে কূটনীতিকদের ওই ৩ হাসপাতালে যোগাযোগ এবং যেতে বলা হয়েছিল।

কূটনৈতিক পত্রে (নোট ভারবাল) জানানো হয়, করোনা আক্রান্ত হলে ঢাকার ৩ হাসপাতালে সেবা পাবেন বিদেশি কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা। সরকার বিদেশিদের জন্য তিনটি হাসপাতাল সুনির্দিষ্ট করেছেন। হাসপাতাল তিনটি হলো- স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেড এবং বসুন্ধরাস্থ এভারকেয়ার (পুরাতন এ্যাপোলো) হাসপাতাল।

করোনা নিয়ে জেকেজির প্রতারণা

নমুনা নিয়ে করোনাভাইরাস পরীক্ষা না করেই ভুয়া রিপোর্ট ডেলিভারি দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

জেকেজি হেলথকেয়ারের করোনা টেস্ট নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী আরিফ চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সাবরিনা তারই স্ত্রী।

ডা. সাবরিনা চৌধুরীর বিরুদ্ধে করোনাভাইরাসের দেড় হাজারের বেশি ভুয়া রিপোর্ট প্রদানের মাধ্যমে আট কোটি টাকা আত্মসাতসহ বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদক জানায়, ডা. সাবরিনা জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে কর্মরত (সরকারি চাকরি) থাকাকালে তার স্বামী আরিফ চৌধুরীর সহায়তায় প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহপূর্বক ১৫ হাজার ৪৬০টি ভুয়া মেডিকেল রিপোর্ট প্রস্তুত ও সরবরাহ করে ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়াসহ জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পেয়েছে দুদক।

পাপুল কান্ড, রানা প্লাজা ধস...এবং মোড় ঘুরানোর রাজনীতি

দেশে এখন চলছে প্রকৃত ঘটনাকে মোড় ঘুরিয়ে দেবার নির্লজ্জ অপচেষ্টা। এর কোনটারই কমতি ছিলোনা এমপি পাপুল কিংবা রানা প্লাজা ধসের ঘটনাতেও।

অর্থ ও মানবপাচার মামলায় কুয়েতের কারাগারে আছেন এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলে। এটা দেশের জন্য কতো লজ্জার তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। তাতেও ভাব-লেশহীন সরকার। পাপুলকে গত ৬ জুন রাতে কুয়েতের মুশরিফ আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে সে দেশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা।

বিষয়টি নিয়ে যখন সমালোচনা তুঙ্গে তখন সরকার বলছে পাপুল কুয়েতের নাগরিক, দোষ প্রমাণিত হলে তবে ব্যবস্থা নেবে। যেন ধরি মাছ না ছুঁই পানি।

সরকারের কথিত ভূমিকা দেখা গিয়েছিলো রানা প্লাজা ধসের সময়টাতেও। ভবনটি ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ধসে পড়ে। ভবনটিতে পাঁচটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি ছিল। দুর্ঘটনায় ১১৩৮ জন পাণ হারান এবং আহত হন দুই হাজারেরও বেশি মানুষ।

রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের লোক। নানা-টালবাহানার মধ্যে জনঅসন্তোষ দেখেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এ কৌশল অতি পুরনো। জনক্ষোভ দেখেই তারা বোল পাল্টাতে পটু। অনিয়ম আর দুর্নীতির উপচানো পানি হলো গুটিকয় সামনে আসা ঘটনাগুলো। দুর্নীতির শিকড় আরো গভীরে যা সরকার নিজে লালন করছে। গুটিকয় ঘটনাগুলোকে হজম না করতে পেরে দেশে এবং বাইরে সরকার প্রচার করতে চাইছে-''ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না!''

জিএস/