একদিনেই সংবাদপত্র বদলে গিয়েছিল যেভাবে

একদিনেই সংবাদপত্র বদলে গিয়েছিল যেভাবে

সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া বাংলাদেশে মুক্তমত আর গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতা পাবার কথা ছিলো কিন্তু কার্যত তা হয়নি। বরং গণমাধ্যমের ঠুটি চেপে ধরা হয়েছিলো রাষ্ট্রযন্ত্রকে হাতিয়ার বানিয়ে। সরকারি মদদপুষ্ট চারটি জাতীয় দৈনিক ছাড়া আর সকল সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল করা হয় কোনো কারণ ছাড়াই। স্বাধীন দেশে গণমাধ্যমে এটাই ছিলো সবচাইতে বড় এবং প্রথম আঘাত। এটা করা হয়েছিলো শেখ মুজিবুর রহমানের তৈরি করা একদলীয় বাকশালের মাধ্যমে। শুধু মিডিয়া নয় এর মাধ্যমে মানুষের রাজনৈতিক অধিকারের সমাপ্তি ঘটানো হয়েছিলো।

দেশবাসী ১৫ আগস্টের পরপরই গুটি কয়েক পত্রিকার ঠিক উল্টো এক চরিত্র দেখতো পেলো। যারা কথায় কথায় সরকার বন্দনা করতো। তারাই মুজিব পরিবারের হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে একটি শব্দতো লিখলোই না বরং তাদের পাতাজুড়ে ছিলো মোস্তাক সরকারের বন্দনা। যিনি কীনা নিজেকে শেখ মুজিবের ঘনিষ্ট দাবি করতেন। সে সময়কার দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলাদেশ অভজারবার, বাংলাদেশ টাইমস এবং রোববারের দৈনিক বাংলার শুধু প্রথম পাতায় চোখ বুলালেই সে দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

একক সিদ্ধান্তে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন আর তখন ইত্তেফাকসহ মাত্র চারটি দৈনিক পত্রিকাকে প্রকাশের সুযোগ দেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা ও সৈনিকের হাতে সপরিবারে জীবন দিতে হয় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে।

কিছু পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় আগে যেখানে প্রতিদিনই শেখ মুজিবুর রহমান বা তার ঘনিষ্ঠ নেতাদের সংবাদ দেখা যেত, ১৫ অগাস্টের পর তা বদলে যায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবরটি কোনো পত্রিকায় প্রধান শিরোনামে আসেনি; কোনো কোনো খবরে নতুন সরকারের গুণগান করতেও দেখা যায়। চাপা পড়ে হত্যাকান্ড আর ক্ষমতা দখলের খবর।

১৫ অগাস্ট: কী ছিল সেদিনের পত্রিকায়

 

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট প্রকাশিত ইত্তেফাক

শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের আগে ১৯৭৫ সালের ১৬ অগাস্ট বাংলাদেশ অবজারভারে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন

সেই রাতের আগে

ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয় ১৫ অগাস্ট ভোরের দিকে। তার আগেই মধ্যরাতে সংবাদপত্র ছাপার জন্য প্রেসে চলে যায়। ফলে ১৫ অগাস্ট শুক্রবারের পত্রিকায় সেই খবর আসেনি। ১৬ অগাস্ট পত্রিকার শিরোনামে আসে সেনাবাহিনী ও মুশতাক সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার খবর।

সেই রাতের আগে পত্রিকাগুলো প্রথম পৃষ্ঠা ছিল অন্যরকম। এহতেশাম হায়দার চৌধুরী সম্পাদিত দৈনিক বাংলার ১৪ অগাস্টের প্রধান শিরোনাম ছিল ছয় কলাম জুড়ে ‘অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই দ্বিতীয় বিপ্লব’। বাকশাল জেলা সম্পাদক প্রশিক্ষণ কোর্সে কোরবান আলীর বক্তব্য ধরে ছাপা হয় ওই সংবাদ।

ওবায়দুল হক সম্পাদিত সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভার সেদিন আওয়ামী নেতা মনসুর আলীকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। শিরোনাম ছিল, ‘প্রকৌশলীদের প্রতি মনসুরের আহ্বান: উন্নয়ন তরাণ্বিত করতে দক্ষতা ব্যবহার করুন’। এছাড়া বঙ্গভবনে বাকশালের এক অনুষ্ঠানে তোফায়েল আহমেদ এবং তৎকালীন বাকশাল সেক্রেটারি শেখ মণি, জিল্লুর রহমান ও আব্দুর রাজ্জাকের বক্তব্য নিয়ে আলাদা প্রতিবেদন ছাপা হয়।

১৫ অগাস্ট অবজারভারের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ছয়টি প্রতিবেদনের শিরোনামে সরাসরি বঙ্গবন্ধু শব্দটি উল্লেখ ছিল। একটির শিরোনাম ছিল- ‘বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রশংসায় কোরিয়ান দূত’।

প্রধান প্রতিবেদনটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বঙ্গবন্ধুর যোগ দেওয়ার কর্মসূচি নিয়ে। এ বিষয়ে একটি বিশেষ ক্রোড়পত্রও ছেপেছিল পত্রিকাটি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং ক্ষমতার পট পরিবর্তনে সেদিন সেই সমাবর্তন আর হয়নি।

সে সময় দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক ছিলেন নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী। ১৫ অগাস্ট ইত্তেফাকেও প্রধান শিরোনাম হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বঙ্গবন্ধুর যাওয়ার কর্মসূচি। ওই প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুর ছবিও ছিল। প্রকাশ করা হয়েছিল বিশেষ ক্রোড়পত্র।

সেদিন দৈনিক বাংলার প্রধান শিরোনাম ছিল ‘গ্রাম পর্যায়ে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে’। বাকশাল জেলা সম্পাদক প্রশিক্ষণ কোর্সে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামানের বক্তব্য নিয়ে ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর

১৬ অগাস্ট দৈনিক বাংলার প্রধান প্রতিবেদনে সবগুলো কলাম জুড়ে শিরোনাম ছিল, ‘খোন্দকার মুশতাক নয়া রাষ্ট্রপতি’। শোল্ডারে লেখা ছিল ‘শেখ মুজিব নিহত: সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারি: সশস্ত্র বাহিনীসমূহের আনুগত্য প্রকাশ’।

শেখ মুজিবুর হতাকাণ্ড বা নৃসংশতার কোনো বর্ণনা সেদিন দৈনিক বাংলার কোথাও ছিল না। প্রধান প্রতিবেদনে বলা হয়, “শুক্রবার সকালে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ’বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে’ সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পতন ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মুশতাক আহমদের নেতৃত্বে ক্ষমতা গ্রহণ করে। সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের সময় সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তার বাসভবনে নিহত হন বলে ষোষণা করা হয়।”

আরেকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল- ‘দুর্নীতির সঙ্গে আপস নেই’। সেখানে বলা হয়, “রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মুশতাক আহমদ নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্যে দেশবাসী সকল শ্রেণীর মানুষের প্রতি নিষ্ঠার সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করার আহ্বান জানিয়েছেন।”

দৈনিক বাংলা সেদিন প্রথম পৃষ্ঠায় ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। সেখানে লেখা হয়, “জাতীয় জীবনে একটি ঐতিহাসিক ক্রান্তির সূচনা হয়েছে। …জাতীয় জীবনে সূচিত এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপকে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিয়েছেন জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা।… দেশে কোথাও কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেনি। সর্বত্র বিরাজিত স্বাভাবিক অবস্থা।”

১৯৭৫ সালের ১৬ অগাস্ট প্রকাশিত বাংলাদেশ অবজারভার

স্বাধীনতার আগে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত যে ইত্তেফাককে আওয়ামী লীগের মুখপত্র মনে করা হত, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর সেই ইত্তেফাকের প্রধান শিরোনাম ছিল- ‘দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি উচ্ছেদ: খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর শাসনক্ষমতা গ্রহণ’।

সেখানে কেবল ‘বঙ্গবন্ধুর নিহত’ হয়েছেন বলা হয়, তাকে যে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে, সেই ঘটনা ছিল অনুপস্থিত।

প্রতিবেদনে বলা হয়, “রাষ্ট্রপতি খন্দকার মুশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী জাতির বৃহত্তর স্বার্থে গতকাল প্রত্যূষে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া দেশের শাসনভার গ্রহণ করিয়াছেন।... শাসনভার গ্রহণকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনে নিহত হইয়াছেন।”

‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয় সেদিনের ইত্তেফাকে। সেখানে মুশতাকের ক্ষমতা গ্রহণকে দেশ ও জাতির ‘ঐতিহাসিক প্রয়োজন পূরণ’ হিসেবে দেখানো হয়। প্রথম পৃষ্ঠায় কয়েকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল- ‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শাসনভার গ্রহণ’।

ইত্তেফাক সেদিন ‘জনসাধারণের স্বস্তির নিঃশ্বাস’ শিরোনামের আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে; সেখানে লেখা হয়, “গতকাল ছিল গতানুগতিক জীবনধারার একটি ব্যতিক্রম। চলার পথে শক্তি সঞ্চয়ের দিন। তাই আমাদের জাতীয় জীবনে একটি ঐতিহাসিক দিন।... মনের ভাব প্রকাশের জন্য রাস্তায় নামিয়া পড়ার অদম্য ইচ্ছা থাকিলেও শান্তিপ্রিয় জনগণ নয়া সরকারের নির্দেশ লঙ্ঘন করে নাই।”


১৯৭৫ সালের ১৬ অগাস্ট দৈনিক বাংলার সম্পাদকীয়

বাংলাদেশ অবজারভারের প্রধান শিরোনাম সেদিন ছিল, ‘রাষ্ট্রপতি হয়েছেন মুশতাক’। শোল্ডারে লেখা ছিল- ‘ক্ষমতায় সশস্ত্র বাহিনী: সামরিক আইন জারি: কারফিউ জারি’। আর মূল শিরোনামের নিচে কিকারে ছোট করে লেখা ছিল ‘মুজিব নিহত: পরিস্থিতি শান্ত’।

সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, “সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সরিয়ে শুক্রবার ভোরে ‘বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে’ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী।... এটা ঘোষণা করা হয় যে, ক্ষমতা গ্রহণের সময় সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তার বাসভবনে নিহত হন। ... এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।”

এছাড়া প্রথম পৃষ্ঠায় একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয় ‘হিসটোরিকাল নেসিসিটি’ শিরোনামে। সেখানে বলা হয়, “এটা ছিল বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে এবং ইতিহাসের আবশ্যকতার প্রেক্ষিতে’... রাষ্ট্রপতি মুশতাক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সত্য আকাঙ্ক্ষা পূরণের পবিত্র দায়িত্ব থেকে...।”

অবজারভারের আরেকটি শিরোনাম ছিল– ‘ক্ষমতা গ্রহণে জনগণের অভিবাদন’।

১৯৭৫ সালের ১৬ অগাস্ট প্রকাশিত বাংলাদেশ টাইমস

আর আব্দুল গনি হাজারি সম্পাদিত বাংলাদেশ টাইমসের আট কলামের প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘মুসতাক অ্যাসিউমস প্রেসিডেন্সি’।

এই শিরোনামের শোল্ডারে লেখা ছিল, ‘মার্শাল ল প্রক্লেইমড ইন দ্য কান্ট্রি: মুজিব কিলড’। প্রধান খবরে সঙ্গে মোশতাকের শপথের ছবি ছাপা হয়েছিল।

মূল শিরোনামের নিচে পত্রিকাটির প্রথম কলামে ‘আওয়ার কমেন্টস’ নাম দিয়ে একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয়; যার শিরোনাম ছিল- ‘অন দ্য থ্রেশলড অব দ্য নিউ এরা’।

পত্রিকাটির প্রথম পাতার অন্যান্য শিরোনা ছিল, ‘পিপল থ্যাঙ্ক আর্মড ফোর্সেস’, ‘মুজিবস পিকচার রিমুভড’, ‘ইউএস রেডি ফর নরমাল টাই’, ‘ভাইস প্রেসিডেন্ট, টেন মিনিস্টার, সিক্স স্টেট মিনিস্টার সোয়র্ন ইন’, ‘ভ্যালুজ হ্যাভ টু বি রিহ্যাবিলিটেটেড’, ‘হেল্প মেক বাংলাদেশ এ প্রসপরাস কান্ট্রি’।

মুশতাক প্রশাসনের স্তুতি

শেখ মুজিবুর হত্যাকাণ্ডের পর অগাস্টের বাকি দুই সপ্তাহ ধরে সংবাদপত্রে চলে মুশতাক সরকারের প্রতি ’সমর্থনসূচক‘ প্রতিবেদন প্রচার। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচরদের ‘হয়রানির’ খবর সেখানে আসেনি।

মুশতাক সরকারকে কয়েকটি দেশের স্বীকৃতির খবর প্রকাশিত হয় ১৭ অগাস্টের দৈনিক বাংলায়।

‘জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনের ভাষা ছিল এরকম-, “কায়েমী স্বার্থবাদী মহলের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মুশতাক আহমদের নেতৃত্বাধীন নয়া সরকার এবং সশস্ত্রবাহিনীর প্রতি দেশের সর্বস্তরের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দন জ্ঞাপন অব্যাহত রয়েছে। তারা নয়া সরকারের প্রতি তাদের পূর্ণ আস্থা ও আনুগত্য প্রকাশ করেছেন।”

অবশ্য সেদিন শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়েও আলাদা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক বাংলা। ‘পূর্ণ মর্যাদায় সাবেক রাষ্ট্রপতির লাশ দাফন’ শিরোনামে মাত্র দুই লাইনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, “সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ শনিবার বিমানযোগে ফরিদপুরের টুঙ্গিপাড়ায় তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে তাদের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়। একজন সরকারি মুখপাত্র এ কথা জানান বলে গতকাল বাসসের খবরে বলা হয়।”

ইত্তেফাকে ১৭ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের দাফনের খবর ছাপা হয় ৩৭ শব্দে।

‘পূর্ণ মর্যাদায় স্বগ্রামে পরলোকগত রাষ্ট্রপতির দাফন সম্পন্ন’ শিরোনামে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, “পরলোকগত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ গতকাল (শনিবার) বিমানে করিয়া তাহার নিজ গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় (ফরিদপুর) লইয়া যাওয়া হয় এবং উহাদের পারিবারিক গোরস্থানে পূর্ণ মর্যাদায় দাফন করা হয়।”

সেদিনের পত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গে বক্স করে ছাপা একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল- ‘রাষ্ট্রপতি মোশতাকের প্রতি বাদশাহ খালেদ ও প্রেসিডেন্ট নিমেরীর অভিনন্দন: সৌদি আরব ও সুদানের স্বীকৃতি’।

অবজারভারও সেদিন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল নতুন সরকারের প্রতি সৌদি আরব ও সুদানের স্বীকৃতিকে। টুঙ্গিপাড়ায় মুজিবের দাফনের কথা বলা হয় ২৪ শব্দের এক সংবাদে।

মুশতাক সরকারের প্রতি ‘সমর্থনসূচক’ প্রতিবেদন ছাপার পাশাপাশি ‘লন্ডনে প্রায় দুই শ’ বাঙালি কর্তৃক’ বঙ্গবন্ধুর ছবি পোড়ানোর খবর প্রাধান্য পায় সেদিনের অবজারভারে।

ভেতরের পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম ছিল ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক’। আরেকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল- ‘পরিবর্তন (ক্ষমতা) বিদেশে প্রশংসিত’।

‘নয়া সরকারের প্রতি আকুণ্ঠ সমর্থন অব্যহত’, ‘বিভিন্ন স্থানে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা’, ‘যোগাযোগ ও পরিবহন স্বাভাবিক: কর্মচঞ্চল জীবনযাত্রা’, ‘ইয়েমেনের স্বীকৃতি: সাম্প্রতিক পরিবর্তন বিদেশে অভিনন্দিত’, ‘সকল স্তরের মানুষের অভিনন্দন অব্যহত’- এ ধরনের শিরোনাম দৈনিক বাংলায় ধারাবাহিকভাবে দেখা যায় অগাস্টের শেষ দিনগুলোতে।

‘কোনো বিভ্রান্তির অবকাশ রাখা হয়নি’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে বলা হয়, “স্ফটিক-স্বচ্ছ দর্পণের আলোকেই মূল্যায়ন করতে হবে জাতির জীবনে সূচিত পরিবর্তনকে।... ঐতিহাসিক প্রয়োজনে জাতির দুর্গতি মোচনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখেই ক্ষমতায় এসেছেন নতুন সরকার।”

দীর্ঘদিন পর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী চার নেতা ও বঙ্গবন্ধুর ‘শুভানুধ্যায়ীদের’ খবর আসে এ পত্রিকায়, তা ছিল তাদের গ্রেপ্তারের খবর।

‘অবৈধ সম্পত্তি করার দায়ে ২৬ জন আটক’ শিরোনামের ২৪ এপ্রিল প্রকাশিত দৈনিক বাংলার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, “...দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে ও সমাজবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত থেকে জানামতে নিজ আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীনভাবে বিপুল সম্পত্তি গড়ে তোলা এবং গোপন পন্থায় স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার প্রভৃতি উপায়ে সম্পত্তি কুক্ষিগত করার অভিযোগে সামরিক আইন বিধি বলে শনিবার (২৩ অগাস্ট) নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের আটক করা হয়েছে।”

অগাস্টের শেষ দিনগুলোতে ইত্তেফাকের চিত্রও ছিল একই রকম। ২১ অগাস্ট ‘রাজনৈতিক কর্মীদের সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, “...স্পষ্টতঃ সকল শ্রেণীর রাজনৈতিক কর্মীর সহযোগিতাও নয়া সরকারের কাম্য। কাজেই এ ব্যাপারে কাহারও মনে কোন দ্বিধা দ্বন্দ্ব থাকা বাঞ্ছনীয় নহে।... রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে সৎ ও দেশপ্রেমিক নাগরিকদের সক্রিয় সহযোগিতা আহ্বান সূচিত হইয়াছে।”

‘সেন্সরশিপ’

১৯৭৫ সালের অগাস্টে নানা ঘটনায় বাংলাদেশ যখন টালমাটাল, সংবাদিক সৈয়দ বদরুল আহসান তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তবে সংবাদমাধ্যমের ঘটনাপ্রবাহে তিনি নজর রেখেছিলেন তখন থেকেই।

তিনি স্মরণ করেন, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি মেজর ডালিম (পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) ১৫ অগাস্ট সকাল থেকেই বাংলাদেশ বেতারে ক্রমাগত ঘোষণা দিচ্ছিলেন যে দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে।

সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিপ আরোপের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা তাতে না থাকলেও ডালিমের ওই ঘোষণায় গণমাধ্যম প্রভাবিত হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন এশিয়ান এইজের এডিটর ইন চার্জ বদরুল আহসান।

"মুজিব সরকারের তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর বঙ্গবন্ধুর খুবই লয়াল ছিলেন। কিন্তু তিনিও মুশতাকের ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন। আরও অনেকেই জড়িত ছিলেন। ১৫ তারিখে তাহের উদ্দিন ঠাকুর বেতার অফিসে গিয়ে নির্দেশনা দিয়েছে। তাহের উদ্দিন ঠাকুরের অফিস থেকে সব নির্দেশনা গিয়েছিল গণমাধ্যমগুলোতে। তাহেরের নেতৃত্বে ঠিক হয়েছে পত্রিকায় কী যাবে, কী যাবে না।

“অবশ্য তাহের নিজেও ইত্তেফাকের সাংবাদিক ছিলেন এক সময়। সেন্সরশিপের ব্যাপারে অফিসিয়ালি কোনো নির্দেশনা যেত না। তবে তাহেরের অফিস থেকে লেখা যেত। ১৬ অগাস্ট পত্রিকায় মুশতাকের ক্ষমতা গ্রহণ, দখল না, মুজিব নিহত এসব খবর দিয়েছে তাহেরই। কেন নিহত, কীভাবে নিহত, এসব সংবাদ সে দেয় নাই। এভাবে ফলস নিউজ সে দিত।”

সৈয়দ বদরুল আহসান বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর একদিন কেবিনেট মিটিংয়ের একটি ছবি এসেছিল একটি পত্রিকায়। সেই ছবিতে মুশতাক সরকারের মন্ত্রীদের চেহারায় কোনো উৎকণ্ঠা দেখা যায়নি। অথচ তারা বঙ্গবন্ধুরও মন্ত্রী ছিলেন। ওই ছবি পরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সংবাদপত্রের সেই হঠাৎ বদলে যাওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “এটা স্বাভাবিক। ফিয়ার সাইকোসিস যাকে বলে। ১৫ অগাস্ট থেকে সবাই ভয় পেয়ে গেছিল। পত্রিকাগুলোর ভূমিকাও বদলে যায়। সাংবাদিকরা সাহস দেখায়নি। তারা সতর্কভাবে লিখত। এসব ঘটনা সবসময়ই হয়েছে।”

“জাতির পিতাকে যেভাবে মেরে ফেলা হয়েছিল সেখানে সবাই ভয় পেয়েছিল। আসলে আমরা পুরো জাতি ফেইল করেছি। গণমাধ্যমের এমন ভূমিকা সবসময়ই ছিল। আমি অনেক সাংবাদিককে চিনি, যারা এখনো জীবিত, বাকশাল গঠনের পর বাকশালে জয়েন করেছে। পরে মুশতাক সরকারের সাথে ছিল। এখন আবার শেখ হাসিনাকে সমর্থন করে।”

তথ্যসূত্র: বিডিনিউজ