অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান-আল জাজিরার লোমহর্ষক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, সরকারের প্রতিবাদ

অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান-আল জাজিরার লোমহর্ষক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, সরকারের প্রতিবাদ

রাষ্ট্রীয় চুক্তি কিংবা যেকোনো চাকুরির সুবিধা দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে গোপন যোগসাজশে ঘুষ আদায় করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থনপুষ্ট একদল সন্ত্রাসী। তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বজায় রেখে চলেন। আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী গণমাধ্যম আল-জাজিরার এক অনুসন্ধানী প্রতিবাদে এমন লোমহর্ষক তথ্য উঠে এসেছে। সরকার তরফে প্রতিবেদনের বিরোধিতা করে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।

দুই বছর অনুসন্ধান চালিয়ে 'অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান' শিরোনামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সমর্থনপুষ্ট সন্ত্রাসী গ্যাংয়ের অনিয়মের দীর্ঘ প্রতিবদেনটি তৈরি করেছে আল-জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট। সাতপর্বের ধারাবাহিক এই প্রতিবদেনের প্রথম পর্বটি সোমবার প্রকাশ করে গণমাধ্যমটি। প্রতিবেদনটির ভাবানুবাদ জাস্ট নিউজ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল:

বাংলাদেশের নিরাপত্তাবাহিনীগুলোর সঙ্গে গোপন যোগসাজশে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন চুক্তি এবং চাকুরি পাইয়ে দেবার কথা বলে ঘুষ নিচ্ছে একটি সন্ত্রাসী গ্যাং। গ্যাংটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গভীর যোগসূত্র বজায় রাখে বলে আল-জাজিরার অনুুসন্ধানে উঠে এসেছে।

খুনের মামলায় দন্ডিত হারিস এবং আনিস আহমেদ কিভাবে তাদেরই ভাই একজন উচ্চপদস্থ সেনাকর্মকর্তার মাধ্যমে কিভাবে সুরক্ষা পাচ্ছে এবং সাজা এড়াতে পালিয়ে বিদেশে অবস্থান নিয়েছে- অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটিতে এর সবকিছু উঠে এসেছে। সেই ভাইটি হলেন বর্তমান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। তিনি প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার একজন আস্থাভাজন মানুষ।

১৯৯৬ সালে মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা নামে তৎকালীন বিরোধী দলের এক সদস্যকে খুনের দায়ে দন্ডিত হারিস এবং আনিস আহমদ এখন কোথায় অবস্থান করছেন তা জানতে পেরেছে আল-জাজিরা।

খুনের পরই প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে বিদেশে আত্মগোপন করেন এই দুই ভাই। দেশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী হারিস এখন হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে অবস্থান করছেন। সেখানে নাম পরিবর্তন করে মোহাম্মদ হাসান নামে বসবাস করছেন।

২০০৭ সালে খুনের মামলায় সাজা বহাল রাখা হলে আনিস আহমেদ কুয়ালালামপুরে পালিয়ে যান। দেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কর্তৃক এই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকার পরও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে পলাতক এই দুই ভাই ঢাকায় তাদের ভাতিজার (আজিজের ছেলে) বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সে অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদসহ অন্যান্য দেশি-বিদেশি অতিথিরাও উপস্থিত ছিলেন।

ভূয়া পরিচয়

বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাবার পর থেকেই ভূয়া পরিচয় ব্যবহার করছেন হারিস। পরিচয় দিচ্ছেন মোহাম্মদ হাসান নামে। জেনারেল আজিজ সেনা কর্মকর্তাদের দিয়ে হারিসের ভূয়া পরিচয় ব্যবহারের যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এসংক্রান্ত নথি আল-জাজিরার কাছে রয়েছে। এই পরিচয়ে তিনি ইউরোপে ব্যবসা করেছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত সম্পদ ক্রয় করেছেন। মোহাম্মদ হাসান নামে যে ভূয়া পাসপোর্ট বানানো হয়েছে আর তাতে যিনি স্বাক্ষর করেছেন সে সংক্রান্ত প্রমাণাদি আল-জাজিরার নিকট রয়েছে। অনুসন্ধানে বের হয়েছে যিনি পাসপোর্টে স্বাক্ষর করেছেন তিনি জালিয়াত চক্রের একজন সদস্য।

গোপনীয় রেকর্ডের সময় হারিস জানিয়েছেন তার ভাই জাতীয়ভাবে বিভিন্ন চাকুরি এবং ঢাকায় পুলিশে নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে টাকা নিয়ে থাকেন তার ভাই আহমেদ। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন যোগসাজশেই তিনি এটা করেন। তিনি আরও জানান এই প্রক্রিয়ায় (টাকা নেবার কাজে) কম করে হলেও একজন সিনিয়র মন্ত্রীর সহযোগিতা রয়েছে।

হারিস বলেন, বিমানবন্দরের অফিসার-ইন-কমান্ডের ক্ষেত্রেই হিসেবের অংকটা দাঁড়াবে ৬লাখ ২৫হাজার ডলারে।

তিনি বলেন, "ঘুষের টাকা হাত বদল হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি আর পুলিশ কমিশনারের মধ্যে।"

হারিস আরও বলেন, "যদি ঘুষের চুক্তিটা হয় ৬লাখ ২৫হাজার ডলারের তাহলে আমরা তাদেরকে দেই ৩লাখ ৭৫ হাজার ডলার। বাকি ২লাখ ৫০ হাজার ডলার থাকে আমাদের হাতে।"

অন্য আরেক গোপন রেকর্ডিংয়ে হারিস জানান সেনাবাহিনীতে ভাইয়ের পরিচয় ব্যবহার করে সেখান থেকেও চুক্তির মাধ্যমে টাকা নেন তিনি।

আল-জাজিরার সঙ্গে আলাপকালে হারিস জানান তাকে সুরক্ষা দেবার জন্য এক রাজনীতিবিদের সমর্থন রয়েছে। এপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, "এমনকি আমাদের প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) পর্যন্ত বলেছেন- হারিস যদি কোনকিছু করতে চায়। তাকে তা করতে দাও। আমরা তাকে সহযোগিতা করব।"

দ্বিতীয় পলাতক আনিসের অবস্থানও নিশ্চিত করতে পেরেছে আল-জাজিরা। জেনারেল আজিজ যখন কুয়ালালামপুরে তার ভাই আনিসের সঙ্গে দেখা করেন তখন তাদের অনুসরণ করে আল-জাজিরার অনুসন্ধানী টিম। তাদের দুই ভাইকে কূটনৈতিক সুযোগ সুবিধা প্রদান করে সেখানকার বাংলাদেশ হাইকমিশন।

আনিসের বাড়ির নথি অনুসন্ধান করে দেখা গেছে তার মালিকানা আনিস আহমেদ এবং মোহাম্মদ হাসানের (হারিস আহমেদের ভূয়া পরিচয়) নামে।

শেখ হাসিনার জন্যই নিরাপত্তা সুবিধা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্যই এমন নিরাপত্তা সুবিধা পাচ্ছেন এই দুই ভাই। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালে শেখ হাসিনা যেই বিরোধীদলে থাকাকালীন তার জীবনের নিরাপত্তায় ছিলেন সে সময় হারিস এবং আনিস।

দলের ভিতর যারা এই দুই ভাইয়ের সমালোচনা করে তার জবাবে শেখ হাসিনার অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় আল-জাজিরার কাছে থাকা একটি ফোন কল রেকর্ডিং থেকে।

সেখানে হাসিনা বলেন, "দেখেন, তার ভাইদের সম্পর্কে আমার চাইতে আপনারা বেশি জানেননা। যখন আমার বাড়ি লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোঁড়া হয়েছিল তখন আপনারা কোথায় ছিলেন?"
"আমার বাড়িতে এ ঘটনাটা ঘটেছিল। তখন আপনারা কোথায় ছিলেন? তখন এই সেনাপ্রধানের ভাইয়েরাই আমার পাশে ছিলো।তারাই ছিল আমার মূল আস্থার জায়গায়।"

পাঁচ ভাই

হারিস এবং আনিসরা মোট পাঁচ ভাই। এর মধ্যে চারজনই আন্ডারওয়ার্ল্ডের সদস্য।

এদের মধ্য যোসেফ আহমেদ হল বাংলাদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের একজন। ১৯৯৬ সালে খুনের দায়ে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। এরপর ২০১৮ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থনে রাষ্ট্রপতির ক্ষমার মাধ্যমে তাকে মুক্তি দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এর কয়েক সপ্তাহ পরই যোসেফের ভাই আজিজকে সেনাপ্রধান করেন হাসিনা।

তাদের পঞ্চম ভাই হল টিটু আহমেদ। ১৯৯৯ সালে সন্ত্রাসীদের গুলিতে মারা যান তিনি।

আল-জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ টিম তাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির সময় প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, পুলিশ কমিশনার এবং চার ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এবং বক্তব্য জানতে চেয়েছে। অনুসন্ধানের বিষয়ে তাদের বক্তব্য জানতে চাইলে তারা তাতে সাড়া দেননি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার'স মেন' নামের এই প্রতিবেদনটি সোমবার প্রথম প্রচার করার পর থেকে এটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা চলছে। ইতোমধ্যে কয়েক মিলিয়ন মানুষ প্রতিবেদনটি দেখেছেন।

সরকারের প্রতিবাদ

আল জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর সরকার তরফে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে।

আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে নিন্দা জানিয়ে বলা হয়েছে " এটা পরিষ্কার না যাদের পূর্বে অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকার রেকর্ড রয়েছে তাদের সঙ্গে কীভাবে আল জাজিরার মত আন্তর্জাতিক নিউজ চ্যানেল যুক্ত হল। প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন অফিসিয়াল, সামাজিক, ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানের ক্লিপ ব্যবহার করে। বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন অনুষ্ঠানের দৃশ্য একত্রিত করে সম্পাদনা করে কণ্ঠ দেয়া হয়েছে"।

বাংলাদেশ সরকার এই প্রতিবেদনটিকে মিথ্যা ও অবমাননাকর হিসেবে বর্ণনা করেছে ।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের থেকে পাঠানো ওপর এক বিবৃতিতে ,একে লন্ডন ও অন্যান্য জায়গায় সক্রিয় উগ্রপন্থী ও তাদের সহযোগীদের উসকানিতে বেপরোয়া ও নোংরা অপপ্রচার বলে উল্লেখ করা হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, “বাংলাদেশ সরকার এটি প্রত্যাখ্যান করছে। আরও বলা হয়, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে জামায়াতে ইসলামীর মদদ-পুষ্ট কতিপয় সাজাপ্রাপ্ত পলাতক অপরাধী এবং কুখ্যাত ব্যক্তি তাদের চিরাচরিত ছকে যে ধরনের বাংলাদেশ-বিরোধী অপপ্রচার চালায়, এই রিপোর্টটিও সেই শ্রেণির। এরা বিভিন্ন উগ্রপন্থী আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী ও সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে আল জাজিরার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিভিন্ন সময় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।”

এসজে/