ক্ষমতায় টিকে থাকতে সেনাবাহিনীর আনুগত্য কিনে নিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টাকা দিয়ে সেনাবাহিনীকে শুধু বশ করাই নয় বরং ক্ষমতা ভাগাভাগির কেন্দ্রেও তাদেরকে নিয়ে আসা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাপ্তাহিক পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্টে প্রকাশিত 'বাংলাদেশ গভর্ণমেন্ট লেভিশেস মানি অন দ্য আর্মি' শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়। এর আগে বাংলাদেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনিয়ম, দুর্নীতি আর মাফিয়াতন্ত্র নিয়ে চাঞ্চল্যকর প্রতিবদেন প্রকাশ করে আরেক প্রভাবশালী গণমাধ্যম আল-জাজিরা।
জাস্ট নিউজ পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটির অনুবাদ তোলে ধরা হল:
বাংলাদেশে সেনাবাহিনী প্রধান খুনের দায়ে দন্ডিত তার দুই ভাইকে বিদেশে পালিয়ে বেড়াতেই সহযোগিতা করছেন, বিষয়টা শুধু তেমন কিছু নয়। বরং এই দুই জন সেনাবাহিনীর সরঞ্জমাদি ক্রয়ের বিষয়টিও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। আল-জাজিরার প্রতিবেদনে এসকল অনিয়মের চিত্র তোলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলেও তা তদন্তের কোন পদক্ষেপ নেয়নি সরকার।
এই দুইয়ের মধ্যে এক পলাতক আসামী যখন নিজ মুখেই বলল- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এসব কর্মকান্ড সম্পর্কে অবগত। সে যা করছে তা নিয়ে কোন আপত্তি নেই হাসিনার। এমন তথ্য সম্মুখে আসার পরও তা খতিয়ে দেখারও কোন প্রয়োজন বোধ করেনি সরকার।বরং তার বদলে তারা প্রতিবেদনটিকে 'উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা' বলে উড়িয়ে দিল।
সেনাবাহিনীর সঙ্গে শেখ হাসিনার একটা অদ্ভূত সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে কে হত্যার মাধ্যমে এই সেনাবাহিনীর সদস্যরাই তাকে রাজনীতির সামনের সারিতে আসার রাস্তা খুলে দেয়। এরপর থেকে তার মধ্যে সাংঘর্ষিক দুটি জিনিসের বাস্তবায়ন লক্ষ্য করা গেল। প্রথমত, হত্যাকান্ডের বদলা নেবার রেশ টেনে ধরা। আর দ্বিতীয়ত, সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ট এক সম্পর্ক তৈরি করা, যাতে করে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার রাস্তাটা বন্ধ করে দেয়া যায়।
সেনাবাহিনীতে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চাইতে কম। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা হলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্রনায়ক জিয়াউর রহমান। আর দলটিকে এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ২০০৯ সালে হাসিনা যখন টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসেন তখন সেনাবাহিনী থেকে বিএনপি বলয়ের সেনাকর্মকর্তাদের অপসারণ শুরু করেন। আর পদোন্নতি দেয়া শুরু করেন তার দলের অনুগতদের। যেমন জেনারেল আজিজের কথাই বলা যায়, আল-জাজিরার অভিযোগের বিষয়বস্তুতে রয়েছে এই সেনাপ্রধানের নামটি।শুধু তাই নয় একিসঙ্গে সেনাবাহিনীকে বিশেষ রকমের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন হাসিনা। যেমন ধরুন- সামরিক হাসপাতালগুলোতে সেনাদের স্বজনরা সেবা নিতে পারছেন। ২০১৫ সালে সেনাবাহিনী এবং সিভিলে চাকরিরতদের বেতন সুবিধা দ্বিগুণ করে দেন।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সস্টিটিউট এর দেয়া এক প্রতিবদেন মতে, কোন ধরনের সামরিক আগ্রাসনের হুমকি না থাকার পরও ২০০৮ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ১২৩%।চীনা থেকে কেনা হয়েছে যুদ্ধ বিমান, ট্যাংক এবং বানানো হয়েছে বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি। ২০১৮ সালে ৬২০ হেক্টর জায়গাজুড়ে একটি ঘাঁটির উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনার এক দশকের শাসনকালে বহুগুণে ব্যবসার বেড়েছে সেনাবাহিনীর। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে বাংলাদেশ আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এবং সেনা কল্যাণ সংস্থার মাধ্যমে। দুটি প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনীর স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হলেও এগুলো পরিচালনা হয় চাকুরিরত কর্মকর্তাদের মাধ্যমেই। সেনা কল্যাণ সংস্থার তথ্যমতে সংস্থাটির সম্পদের পরিমাণ এখন ৬০ বিলিয়ন টাকা। বাংলাদেশ আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের সম্পদের মধ্য রয়েছে- বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল হোটেল এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এসকল প্রতিষ্ঠানে ইভিএম মেশিন তৈরি করার কাজও হয়। এসব কাজের জন্য কোন দরপত্র আহবান করা লাগেনা। পর্যবেক্ষক এবং বিরোধী রাজনীতিবিদদের অভিযোগ হল- এসকল মেশিন এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে করে সহজে ভোটে কারচুপি করা যায়।
সরকারি সুবিধায় অনেক অবকাঠামোগত কাজও বাগিয়ে নেয় সেনাবাহিনী। আশংকাজনক এ বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ উঠে এসেছে আল জাজিরার প্রতিবেদনে। যেমন ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প নির্মাণে নৌবাহিনী ব্যয় করেছে ৩০০ মিলিয়ন ডলার। ঢাকায় বিমানবন্দর সম্প্রসারণের কাজ নিয়েছে বিমান বাহিনী। আর মহাসড়ক মেরামতের কাজ বাগিয়ে নিয়েছে সেনাবাহিনী।
নিজেদের সম্পদ বানাতে অবাধ সুবিধা পেয়েছেন শীর্ষ কর্মকর্তারা। যেমন ঢাকার মত ঘনবসতিপূর্ণ শহরে জমি পাবারা সুবিধা। তারা সবাই নিজস্ব জমির জায়গা পেয়েছে যেখান সাত তলা ভবন নির্মাণ করা যাবে। তত্ত্বগতভাবে বিষয়টা দিয়ে আবাসন সুবিধা বুঝালেও, বাস্তব কথা হল ভবনের অনেকগুলো ফ্ল্যাট অফিসাররা বিশাল লাভে বিক্রি করার সুযোগ পেয়ে যাবেন। সেনাবাহিনীতে চাকুরিরত কিংবা অবসর নেয়া কর্মকর্তাদের দেয়া হয় লোভনীয় সরকারি চাকুরির সব অফার। যেমন ধরুন- জাতীয় বন্দর কর্তৃপক্ষ ও চা চাষ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার মতো জায়গাতে উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরি।এমনকি যারা নিচের র্যাংকে আছেন তাদের জন্যও রয়েছে লাভজনক সুবিধা। সরকার শান্তিরক্ষা মিশনে মোতায়েন করা প্রতিটি বাংলাদেশি সৈন্যের জন্য জাতিসংঘ থেকে প্রাপ্ত আয় থেকে প্রায় ১০,০০০ ডলার ব্যয় করে।
(সরকারের) এই বিশেষ আদর-যত্ন কাজে লেগেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে সেনাবাহিনী তিনবার ক্ষমতা দখল করেছে এবং ১৫ বছর দেশ শাসন করেছে। তারা শেখ হাসিনাকে শাসন করার সুযোগ করে দিচ্ছে। টাকা দিয়ে সেনাবাহিনীর আনুগত্য কিনে সেটিকে বরং ক্ষমতা ভাগাভাগির কেন্দ্রেই নিয়ে এসেছেন তিনি। এদিয়ে সমস্যা যেটা তৈরি হল তা হচ্ছে ক্ষমতার পালাবাদলে পরবর্তী উত্তরসূরির পথটি জটিল করা। যে সুযোগ শেখ হাসিনাকে দেয়া হল। রাজনীতি থেকে এটাকে সরিয়ে দেয়া হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। যতটা দীর্ঘপথ তিনি (হাসিনা) তৈরি করেছেন ততটা দীর্ঘ হবে না।
কেবি/