ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে: গওহর রিজভী

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে: গওহর রিজভী

সাংবাদিক টিম সেবাস্টিয়ানের উপস্থাপনায় গত বুধবার জার্মানির গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেতে প্রচারিত টক শো ‘কনফ্লিক্ট জোন’-এ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। তাঁদের আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, দুর্নীতি, আল–জাজিরার প্রতিবেদনসহ নানা বিষয়। ডয়চে ভেলেতে তাঁদের আলোচনার আরেকটি অংশ:

টিম সেবাস্টিয়ান: যে দেশে একটি কার্যকর বিচারব্যবস্থা রয়েছে, সে দেশে আপনার সেনাপ্রধানের দুই পলাতক ভাই, আনিস ও হারিস, যাঁরা খুনের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত, ২০১৯ সালে ঢাকায় গিয়ে প্রকাশ্যে একটি পারিবারিক বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন? এ রকম নিশ্চয়ই অনেক পলাতক খুনি নেই যারা ক্ষমতাবানদের কোনোরকম ছত্রচ্ছায়া ছাড়াই উচ্চপর্যায়ের এক বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারে এবং সেখানে রাষ্ট্রপতি ও বিদেশি বিশিষ্টজনদের সঙ্গে দেখা করতে পারে। আপনিও নিশ্চয়ই আমার মতো বিষয়টি জানেন।

ড. গওহর রিজভী: আপনি একেবারে ঠিক। যদি এটা কেউ বুঝতে পারত যে এই ভদ্রলোকেরা বাংলাদেশে ফিরেছেন, তবে দ্রুত তাঁদের গ্রেপ্তার করা হতো। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রশ্ন করারই সুযোগ নেই।

টিম সেবাস্টিয়ান: কিন্তু তাঁদের বিয়েতে যোগ দেওয়ার ছবি রয়েছে, ড. রিজভী। তাঁদের ছবি তোলা হয়েছিল।

ড. গওহর রিজভী: আমাকে…(বলতে দিন), আমি (বলছি)।
টিম সেবাস্টিয়ান: সেটা ছিল একটি সেনা ক্লাবে। দুজন দণ্ডিত খুনি, যাঁরা কিনা পাত্রের চাচা, অন্য সবার সঙ্গে বিয়ের উৎসবে অংশ নিয়েছেন।

ড. গওহর রিজভী: আমরা এমন একটি ঘটনার কথা বলছি, যা ২৫ বছরের বেশি সময় আগে ঘটেছিল। এ দুই ভাই ১৯৯৬ সালে অপরাধ করেছিল। সেটা জেনারেল আজিজ ক্যাডেট হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ারও অনেক আগের ঘটনা। এখন আমরা ২৫ বছর পরের ঘটনায় ফিরে আসি। আমরা বলছি যে এ দুজন বাংলাদেশে ফিরে এসেছে এবং তারা যদি সেটা করে থাকে, মানে ছবিতে যা দেখা যাচ্ছে, তবে সেটা আমাদের বিচার প্রশাসন ও বিমানবন্দর পুলিশের একটি বড় ব্যর্থতা—এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আপনার এটাও বুঝতে হবে, এই ব্যক্তিরা ভিন্ন নামের পাসপোর্ট জোগাড় করেছেন। সরকারের যদি সেটা জানা না থাকে এবং তারা যদি নজরদারির তালিকায় (ওয়াচ লিস্ট) না থাকে, তবে তারা অন্য হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে ঢুকতে বা বের হতে পারে। আমি একবারও বলছি না যে এটা সরকারের জন্য ব্য়র্থতা নয়।

টিম সেবাস্টিয়ান: ঠিক আছে, ড. রিজভী, মুক্ত গণমাধ্যমসহ যে গণতন্ত্র বাংলাদেশে রয়েছে বলে আপনি দাবি করেছেন, তা সত্যি হলে আল–জাজিরার এসব অভিযোগ দেশটির পত্রিকা ও টিভিতে প্রচারিত হতো। কিন্তু সেটা হয়নি, হয়েছে? ‘ঢাকা ট্রিবিউন’ পত্রিকা বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছে ‘আমাদের নীরবতার কারণ’ শিরোনামে। পত্রিকাটি লিখেছে, ‘বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বর্তমান পরিস্থিতি ও মানহানি আইন এ বিতর্ক নিয়ে অর্থবহ মন্তব্য করা থেকে বাংলাদেশের সব গণমাধ্যমকে দূরে রেখেছে।’ এটাই বাস্তবতা, তাই না? আপনি চাপ প্রয়োগ করে গণমাধ্যমকে নতিস্বীকার করতে ও চুপ থাকতে বাধ্য করেছেন। ফলে এটি এখন নিজের ছায়া দেখেই ভয় পাচ্ছে। আপনি কি এ জন্য গর্বিত?

ড. গওহর রিজভী: আপনি যা বলেছেন তা যদি সত্যি হতো, তবে আমি লজ্জিত হতাম। আপনি বরং আমাকে সত্যিটা বলতে দিন।
টিম সেবাস্টিয়ান: আপনি কি বলতে চাইছেন এই পত্রিকা মিথ্যা বলছে? আপনি কি বলতে চাইছেন পত্রিকাগুলো মিথ্যা বলছে?

ড. গওহর রিজভী: আমাকে শুধু হ্যাঁ বা না উত্তর দিতে বলবেন না। আমাকে ব্যাখ্যা করতে দিন। এটা ঠিক যে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ (ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট) বলে একটা ব্যাপার রয়েছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সহিংসতা, গুজব ছড়ানো ও জনগণকে উসকানি দেওয়া থেকে বিরত রাখতে করা হয়েছে এটি। তবে আইনটি, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সরকার উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে, যেটি তথ্যপ্রযুক্তি আইন (আইসিটি অ্যাক্ট) নামে ১৯৯৬ সালে পাস হয়েছিল। আমাদের সরকার সেটি সংশোধন করেছে এবং বর্তমানে এটির নাম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। দুঃখজনক হচ্ছে আমরা এখন জেনেছি যে আইনটির কিছু শব্দচয়ন দুর্বল ও অস্পষ্ট হয়েছে, যার অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এ জন্য এটা বলা (ঠিক নয়), গণমাধ্যমকে বাকরুদ্ধ করা হয়েছে, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই…। আমার আপনাকে জানানো উচিত, শুধু ঢাকা থেকে প্রতিদিন ৬০টির বেশি দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়।

টিম সেবাস্টিয়ান: ড. রিজভী, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল...অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল...। আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, গত বছরের প্রথম ৯ মাসে এ আইনের আওতায় ৮০০–এর বেশি মামলা করা হয়েছে, যেখানে অনেক সুপরিচিত সম্পাদক ও ঊর্ধ্বতন সাংবাদিকদের ক্রমবর্ধমান হারে নিশানা করা হয়েছে। এমন এক আইনের আওতায় ৮০০ মামলা করা হয়েছে, যা আপনার সরকার দৃশ্যত উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে। মনে হচ্ছে, আপনার সরকারের এ আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের জড়তা নেই, তাই না? আপনার আইনটি যে সমালোচকদের মুখবন্ধ করার ও বিরুদ্ধ মত দমনের একটি অস্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়, তা কি এখন স্বীকার করা উচিত নয়? এটাই তো সত্যি, তাই না?

ড. গওহর রিজভী: না। আমি আপনার সমালোচনা মেনে নিতাম ও আপনার অভিযোগও মেনে নিতাম যদি আপনি হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে জিজ্ঞাসা করতেন যে এই ৮০০ মামলার কয়টি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা হয়েছে? আপনি ৮০০ বলে একটি সামগ্রিক সংখ্যা বলেছেন। আমরা যখন কোনো সন্ত্রাসী হামলার মুখোমুখি হই, আমাদের সেটার বিরুদ্ধে লড়তে হয়, কঠিনভাবে লড়তে হয়। সেই ৮০০–এর মধ্যে কতজন সন্ত্রাসী? সেই ৮০০–এর মধ্যে কতজন অপরাধী রয়েছে, যারা সহিংস কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত? কোনোরকম বাছবিচার ছাড়াই আপনি আমাকে সংখ্যাটি বলেছেন। আমি আপনাকে দয়া করে সংখ্যাগুলোর দিকে আবারও তাকাতে চ্যালেঞ্জ করছি। আমাকে বলুন, তাঁদের মধ্যে আসলে সাংবাদিক কয়জন?

টিম সেবাস্টিয়ান: তাহলে আমি আরও কিছু সংখ্যা আলাদা করে বলতে পারি। কেননা মানবাধিকার সংগঠনগুলো, বিশেষত করোনাকালে বাকস্বাধীনতার ওপর আপনার সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ রয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, করোনা সংকট সমাধানে আপনার সরকারের উদ্যোগের বা ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনা করায় সাংবাদিক, শিল্পী, শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ ও অ্যাকটিভিস্টদের আপনারা গ্রেপ্তার করেছেন। এমনকি গত জুনে ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর মানহানি করে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছেন আপনারা। তাকে শাস্তি হিসেবে কিশোর সংশোধনাগারে (জুভেনাইল ডিটেনশন) রাখা হয়েছিল।

ড. গওহর রিজভী: ঠিক আছে। তবে এবার আমাকে আপনার প্রশ্নের আমার পক্ষে যতটা সম্ভব পরিষ্কার উত্তর দিতে দিন। আপনি আপনার দর্শকদের বলতে চাইছেন যে করোনাকালে সরকার নানা ধরনের ভয়াবহ কাজ করেছে। আপনি কি আপনার দর্শকদের বলেছেন যে বাংলাদেশ হচ্ছে বিশ্বের অল্প কয়েকটি দেশের একটি, যেটি আপনার নিজের দেশ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের চেয়ে ভালোভাবে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পেরেছে? আমাদের দেশে করোনায় মৃত্যুর হার বিশ্বের মধ্যে অন্যতম কম। আমাদের দেশে আরোগ্যলাভের হার সবচেয়ে বেশি। আমরা চিকিৎসা দিতে আমাদের হাসপাতালের পরিধি বাড়িয়েছি। এসব কাজের (ফ্যাক্টের) উল্লেখ কোথাও নেই।