বাংলাদেশে রাজনৈতিক নিপীড়ন, মতপ্রকাশে বাধা, গুম অব্যাহত

২০১৮ সালের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি: যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন

২০১৮ সালের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি: যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের অনিয়ম, বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের নেতা-কর্মীদের দমন-নিপীড়নসহ, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে করা মামলা এবং তার বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন, গণমাধ্যমের মত প্রকাশে বাধাপ্রধানসহ বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘনের এক স্ববিস্তার চিত্র উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের মানবিধকার বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ‘কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস’ শীর্ষক বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। মঙ্গলবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "২০২০ সালে গোটা বিশ্বেই মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে।"

ব্লিংকেন সাংবাদিকদের বলেন, " মানবাধিকারের ধরণটা ভুল দিকে যাচ্ছে। করোনাভাইরাস মহামারি গোটা পৃথিবীতে অনন্য এক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে এবং কোন কোন দেশের সরকার এই সংকটকে নিজ নাগরিকদের অধিকার লংঘন করার এবং কর্তৃত্ববাদি শাসন আরও শক্ত করার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছে।"

সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের কড়া সমালোচনা করে প্রতিবেদনের শুরুতেই বলা হয়েছে, "বাংলাদেশে সংসদীয় কাঠামোর সরকারে প্রধানমন্ত্রীকে বেশিরভাগ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে যে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে তাতে তৃতীয়বারের মত ক্ষমতায় এসেছে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। পর্যবেক্ষকদের মতে নির্বাচনটা সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ ছিল না। নির্বাচনে অনিয়ম, ব্যালট বক্স দখল করে ভর্তি এবং বিরোধীদলগুলোর ভোটার এবং এজেন্টদের ভয় দেখানোর মত ঘটনা ঘটেছে।"

বাংলাদেশে সংঘটিত এবং চলমান উল্লেখযোগ্য মানবাধিকার লংঘন প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, "মানবাধিকারের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্য রয়েছে- সরকার কিংবা তার আইনশৃঙ্খলাবাহিনী দ্বারা বিচারবর্হিভূত হত্যা এবং গুম, নির্যাতন, সরকার কিংবা তার আইনশৃঙ্খলাবাহিনী দ্বারা নিষ্ঠুর, অমানবিক আচরণ, বাজে এবং জীবন হুমকিতে পড়া জেলের পরিবেশ, বেআইনি গ্রেফতার, ব্যক্তিগোপনীয়তায় বেআইনি, একতরফা হস্তক্ষেপ, সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেফতার, সেন্সরশিপ এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়া।"

প্রতিবেদনে বলা হয়, "আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহারের বিস্তর অনিয়মের রেকর্ড রয়েছে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অনিয়ম আর হত্যাকান্ডের ঘটনার তদন্ত এবং বিচারে সরকারের পদক্ষেপ নেবার উদাহরণ খুবই কম।"

জুলাইয়ের ৩১ তারিখে কক্সবাজারে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টিও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। যেখানে বলা হয়েছে এই হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশের বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয় এবং এর জের ধরে পরবর্তীতে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। হত্যার দায়ে ২১ পুলিশ কর্মকর্তা বহিষ্কার এবং নয় জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে এখনো নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুম এবং অপহরণের মতো ঘটনা হয়। গত বছরের ১০ মার্চ বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর ফটো-সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল গুম হন। মে মাসে তার খোঁজ মিললেও তার বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের মামলা করা হয়। মোট ২৩৭ দিন কারাগারে থেকে অবশেষে ২৫ ডিসেম্বর মুক্তি পান তিনি।

বাংলাদেশের আইন ও সংবিধানে নির্যাতন নিষিদ্ধ হলেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও মিডিয়ার মতে, নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা বিভাগ নির্যাতন, নিষ্ঠুর ও অমানবিক সাজা দিয়ে থাকে।

আইনশৃঙ্খলবাহিনী কর্তৃক ঠিক কতজন হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে এসব কোন তথ্য সরকার প্রকাশ করেনা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "এসকল বিষয়ে (হত্যাকান্ড) যারা তদন্ত করে তাদের স্বাধীনতা এবং পেশাগত মান নিয়ে সন্দিহান মানবাধিকার সংস্থাগুলোর। এসকল ঘটনায় অভিযোগ আনা এবং আইনগত ব্যবস্থা নেবার উদাহরণ খুবই কম।"

এতে আরো বলা হয়, "মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত ১৯৬ জন বিচারবর্হিভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। আর এসব হত্যাকান্ডের অধিকাংশ ঘটেছে র্যাব এবং বিজিব বাহিনী কর্তৃক। মানবাধিকার সংস্থাসমূহ এবং সুশীল সমাজ এসকল হত্যাকান্ডে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। হত্যার শিকার অধিকাংশই নিরাপরাধ।"

রোহিঙ্গারাও বিচারবর্হিভূত হত্যার শিকার উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, "অ্যামনেস্টি ইন্টারনেশনালের তথ্যমতে ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১০০ অধিক রোহিঙ্গা বিচারবর্হিভূত হত্যার শিকার হয়েছে।"

বাংলাদেশে গুম এবং অপহরণ অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, "মানবাধিকার সংস্থা এবং গণমাধ্যমের দেয়া তথ্যানুসারে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকর্তৃক গুম এবং অপহরণ এখনো অব্যাহত রয়েছে। এসব প্রতিরোধ এবং বন্ধে সরকারকে খুব কমই পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়।সুশীল সমাজের তথ্যানুসারে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী এবং বিরুদ্ধমতের লোকেরাই গুমের শিকার। গুম হওয়া কিছু লোকদের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী হয় এমনিতে ছেড়ে দেয় নতুবা মামলা করে, কাউকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় আর কারো কোন খবর পাওয়া যায়না।"

জাতিসংঘের গুম বিষয়ক ওয়ার্কিং কমিটি বাংলাদেশ সফরের অনুমতি চাইলেও সরকার তাতে কোন সাড়া প্রদান করেনি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

বাংলাদেশে জেলখানার পরিবেশ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "জেলখানার পরিবেশ বাজে এবং একিসঙ্গে জীবনের জন্য হুমকিস্বরুপ। এখানে ধারণ ক্ষমতার চাইতে বেশি লোক বন্দি আর সেনিটেশনের অভাব রয়েছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজনসের তথ্যমতে ২০২০ সালের মার্চ মাসে জেলে কয়েদি ছিল ৮৯,০০০ যেখানে ধারণ ক্ষমতাই হল ৪১,২২৪।"

বেআইনী গ্রেফতার প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "সংবিধানে বেআইনী কাউকে গ্রেফতার বা আটক নিষেধ করা আছে। কিন্তু আইনে যেটা করা হচ্ছে সেটা হল ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি কিংবা ওয়ারেন্ট ছাড়াই যেকাউকে আটক বা গ্রেফতার করা হচ্ছে যা নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলা বিঘ্ন করতে পারে।গণমাধ্যম সুশীল সমাজ, মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে সরকার শুধু সন্দেহভাজন জঙ্গিদের গুম করছে তা নয়, তারা সুশীল সমাজ এবং বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদেরও গুম করছে। আটক করার পর আটককৃতরা কোথায় আছে, কেন আটক করা হল-তা না জানিয়েই আটক করে কর্তৃপক্ষ।"

দুর্নীতি বাংলাদেশে এখনো মারাত্মক সমস্যা বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

রাজনৈতিক বন্দিদের প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, "বিরোধীদলের সদস্যদের গ্রেফতার কিংবা বিচারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিষয়টিকে প্রায়ই গুরুত্বপূণ বিষয় হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়। জাতীয় নিরপত্তার ভান করে একই ব্যবস্থা নেয়া হয়। করোনাভাইরাস প্রতিরোধ নিয়ে সরকার ব্যবস্থাপনার সমালোচনা করায় বিগত বছরে বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে।"

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার সমালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, "২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায় সরকার আমলে করা এক মামলায় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের জেল দেয়া হয়। একই বছরের অক্টোবরে সাজা বাড়িয়ে ১০বছর করে হাইকোর্ট। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আইন বিশেষজ্ঞরা বিচারপ্রক্রিয়ায় প্রমাণের ঘাটতি রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। মামলার বিষয়টি বিরোধীদলের নেতাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার একটা ষড়যন্ত্র বলেও তারা উল্লেখ করেন।"

এতে আরো বলা হয়, "এই মামলায় যখন জামিন শুনানি তখন অস্বাভাবিক রকমের ধীরগতি ছিল আদালতের কার্যক্রমে। মার্চ মাসে খালেদা জিয়ার সাজা ৬ মাসের জন্য স্থগিত করে সরকার। আবার সেপ্টেম্বরে তা ৬ মাসের জন্য বাড়ানো হয়। দুই মেয়াদে স্থগিতাদেশে খালেদা জিয়ার বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।"

মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "বাংলাদেশে সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ থাকলেও সরকার অনেক ক্ষেত্রেই তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং দেশটিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতার উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা রয়েছে।"

এতে বলা হয়, "অনেক সাংবাদিক সরকারের হয়রানি ও নিপীড়নের ভয়ে স্ব-প্রণোদিত হয়ে সরকারের সমালোচনার করার বিষয়ে নিজেদের উপর সেন্সরশিপ আরোপ করেছে।"

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়,"সংবিধানের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহের সাথে তুলনা করা হয়- যার সাজা তিন বছরের কারাদণ্ড থেকে শুরু করে যাবজ্জীবন পর্যন্ত হতে পারে।"

এতে বলা হয়, "আইনে 'হেইট স্পিচ' বা ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও একে যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। যার কারণে সরকার একে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করার সুযোগ পায়।"

"সরকার যদি কোন বক্তব্যকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে যায় বা বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্কে প্রভাব ফেলে বলে মনে করে, অথবা জনশৃঙ্খলা-নৈতিকতা-শালীনতার পরিপন্থী, বা আদালত অবমাননাকারী বা অপরাধে প্ররোচনাদানকারী বলে মনে করে - তাহলে সরকার মত প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।"

প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয় যে, "ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অজুহাতে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে গোয়েন্দা বিভাগ এবং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা সাংবাদিকদের উপর শারীরিক হামলা, হয়রানি, বা ভয় দেখানোর মতো কাজ করেছে। এই আইনকে মানবাধিকার কর্মীরা - সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের সাংবাদিকদের ভয় দেখানোর হাতিয়ার হিসেবে দেখেন।"

এছাড়া বিভিন্ন ঘটনায় সরকার ইন্টারনেট যোগাযোগে হস্তক্ষেপ করা, ফিল্টার কিংবা ব্লক করার মতো পদক্ষেপ নিয়ে থাকে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

"নিরাপত্তার কারণ" দেখিয়ে গত বছর রোহিঙ্গা শিবিরে থ্রিজি এবং ফোরজি ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখা হয়েছিল।

প্রতিবেদনে আল-জাজিরা, আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ রাখার বিষয়গুলোও উঠে আসে। শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়ার অধিকারের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে বলেও জানানো হয়।

কেবি/