নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্তরা রাশিয়া ও বেলারুশে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল জেনারেল

নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্তরা রাশিয়া ও বেলারুশে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল জেনারেল

আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বহাল তবিয়তে থেকে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ সরকারের নিয়োগ দেয়া রাশিয়া আর বেলারুশের দুই অনারারি কনসাল জেনারেল। নিয়োগ দেয়া এই দুই জনই ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। ২০২০সালের নির্বাচনে কারচুপি হবার পরও বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোকে সমর্থন করার জন্য দেশটিতে বাংলাদেশের অনারারি কনস্যুল আলেকজান্ডার ভ্যাসিলিভিচ শাকুতিনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বৃটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। অন্যদিকে, ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ায় রাশিয়ান আগ্রাসনকে সমর্থন দেবার দায়ে দুই বছর আগে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে বাংলাদেশের অনারারি কনস্যুল সের্গেই আলেকসান্দ্রোভিচ ফুরসেনকোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা।

নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অনারারি কনসাল জেনারেল পদে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া এই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নেত্র নিউজ।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার নিয়োগ দেয়া বর্তমান দুই অনারারি কনস্যুল মূলত ব্যবসায়ী। তারা নিজ দেশে গণতন্ত্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ক্ষতিকর কার্যকলাপে ভূমিকা রাখার দায়ে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছেন।

২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কারচুপি করার জন্য বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোকে সমর্থন করার দায়ে দেশটিতে বাংলাদেশের অনারারি কনস্যুল আলেকজান্ডার ভ্যাসিলিভিচ শাকুতিনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বৃটেন।

দুই বছর আগে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল সের্গেই আলেকসান্দ্রোভিচ ফুরসেনকোর বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার দখলদারিত্বে সমর্থন দেবার দায়ে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা।

বাংলাদেশ সরকার কী পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলির এ নিষেধাজ্ঞা দেবার আগে কিংবা পরে এই দুই অনারারি কনস্যুলকে নিয়োগ দিয়েছিল কী না তা জানা যায়নি। আর এ নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশ সরকার কোনো বেকায়দায় পড়তে পারে কীনা তা এখনো স্পষ্ট নয়। এ প্রতিবেদনটি প্রকাশের পূর্বে নেত্র নিউজের তরফে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সচিবের কাছে জানতে চাওয়া হয় এই দুই জনের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে তারা অবগত আছেন কীনা আর এ অবস্থায় তাদের স্বপদে বহাল থাকাটা কতটা যুক্তিযুক্ত, কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

বেলারুশের অনারারি কনসাল জেনারেল

সুশীল সমাজ এবং বিরোধীদের দমনে অবদান রাখার জন্য ২০২০ সালে শাকুতিনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির পর বিরোধীরা বিক্ষোভ করলে উল্টো তাদের নিন্দা করে কথা বলেন শাকুতিন। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ক্ষুণ্ন করার দায়ে একি সময়ে তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় বৃটেন।

অনারারি কনসাল জেনারেল হিসাবে তার স্বপদে বহাল থাকার বিষয়ে ইইউ-এর দৃষ্টিভঙ্গি সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে, এক ইইউ কর্মকর্তা নেত্র নিউজকে বলেন, "যদিও আমাদের নিষেধাজ্ঞাগুলি পররাষ্ট্রনীতির অংশ হিসেবে ইইউ-বহির্ভূত দেশগুলিতে অভ্যন্তরীণ একটা প্রভাব ফেলে তবে এটি শুধুমাত্র ইইউ সদস্যভুক্ত দেশগুলোর জন্য কার্যকর।"

বৃটেনের ফরেন কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তবে নেত্র নেউজ যেটুকু এ থেকে অনুধাবন করেছে তা হল বৃটেন এটাকে বাংলাদেশের বিষয় বলেই মনে করে।

সেন্ট পিটার্সবার্গের অনারারি কনসাল জেনারেল

রাশিয়ান সরকারের ক্রিমিয়া দখল, পূর্ব ইউক্রেনে সহিংসতা উসকে দেওয়া, আসাদ সরকারকে অস্ত্র সরবরাহ এবং সাইবার হামলায় ভূমিকা রাখার দায়ে ফুরসেনকোর উপর ২০১৮ সালে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।

এক বছর পরে রাশিয়ার আগ্রাসী নীতি, ইউক্রেনে সার্বভৌমত্ব লংঘন এবং মানবাধিকার লংঘনের দায়ে ফুরসেনকোর উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় কানাডা। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক মুখপাত্র জেসন কুং নেত্র নিউজকে বলেন, "কানাডা ইউক্রেনে প্রেসিডেন্ট পুতিনের অযৌক্তিক আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা করে। ইউক্রেন ও এর জনগণের সমর্থনে আমরা আন্তর্জাতিক মিত্রদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশের অনারারি কনসাল জেনারেলের বিষয়টি তাদেরকেই প্রশ্ন করা উচিত।"

যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা এ সংক্রান্ত কোন বিষয়ে মন্তব্য করতে সম্মত হয়নি।

ক্ষমতার উৎস

শাকুতিন এবং ফুরসেনকো উভয়ই তাদের নিজ নিজ দেশে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ভালো যোগসাজশ রয়েছে।

একজন শিল্পপতি হওয়ার পাশাপাশি, ২০০৮-২০১২ সালের মধ্যে শাকুতিন বেলারুশিয়ান পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষের সদস্য ছিলেন এবং বেলারুশিয়ান স্বৈরাচারী আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে।

ইইউ-এর মতে, তিনি (শাকুতিন) তাদের মধ্যে একজন যারা লুকাশেঙ্কোর প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন বেসরকারীকরণ থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছেন। তিনি লুকাশেঙ্কােপন্থী পাবলিক অ্যাসোসিয়েশন 'বেলায়া রুস'-এর প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং কাউন্সিল ফর দ্য ডেভেলাপমেন্ট অব এন্ট্রিপিওনারশীপ ইন দ্য রিপাবলিক অব বেলারুশের সদস্য।

ইইউ জানিয়েছে যে এসকল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শাকুতিন লুকাশেঙ্কোর শাসন থেকে সুবিধা নিয়েছেন।

বৃটেন বেলারুশে বাংলাদেশের অনারারি কনস্যুলকে আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর দীর্ঘদিনের সহযোগী" হিসাবে বর্ণনা করেছে। প্রতারণামূলক নির্বাচনের ফলাফল সত্ত্বেও তিনি লুকাশেঙ্কোর সরকারকে সমর্থন করেছেন।

শাকুতিনের প্রেসিডেন্টের প্রতি এই সমর্থন গণতন্ত্রকে ক্ষুণ্ন করেছে বলে উল্লেখ করে বৃটেন।

নিষেধাজ্ঞার কারণে ইইউ এবং বৃটেনে শাকুতিনের সমস্ত সম্পদ জব্দ করা হয়েছে এবং তিনি কোনও ইইউ বা বৃটেনের নাগরিকের সাথে ব্যবসা করতে পারবেন না।

রাশিয়ান সরকারের সাথে সের্গেই ফুরসেনকোর ঘনিষ্টতা আরও বেশী।

তিনি এবং তার ভাই আন্দ্রেই ফুরসেনকো ওজেরো গ্রুপের সঙ্গে জড়িত। এটি সেন্ট পিটার্সবার্গে অবস্থিত সাবেক রাশিয়ান গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং ধনীদের একটি গ্রুপ যা ভ্লাদিমির পুতিনের উত্থানে সহায়তা করেছিল। ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট পুতিন ক্ষমতায় আসার পর এটি আরও সুবিধা পায়

সের্গেই ফুরসেনকো রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম নেফ্টের বোর্ড সদস্য ছিলেন। তার এই অবস্থানের কারণেই ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র যে কয়জন রাশিয়ান ধনীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় সে তালিকায় তার নাম যুক্ত হয়।

সের্গেই ফুরসেনকো এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেবার সময় যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব ট্রেজারি বলেছিল, "রাশিয়ান ধনী এবং অভিজাতরা যারা এই দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা থেকে লাভবান হচ্ছে তারা তাদের সরকারের অস্থিতিশীল কার্যকলাপের পরিণতি থেকে আর সুরক্ষা পাবে না।"

সের্গেই ফুরসেনকোর ভাই আন্দ্রেই মন্ত্রিসভার সাবেক সদস্য। যিনি পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে বিবেচিত হন। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়াকে অধিভুক্ত করার পরে যুক্তরাষ্ট্র দেয়া প্রথম নিষেধাজ্ঞার তালিকাতে তার নাম ছিলো।

বাংলাদেশের সাথে যোগসূত্র

রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল জেনারেল হিসেবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সের্গেই আলেকসান্দ্রোভিচ ফুরসেঙ্কোর নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

শাকুতিনের নাম অবশ্য এই তালিকায় নেই, তবে মিনস্কের কনস্যুল হিসেবে বাংলাদেশের রাশিয়ান দূতাবাসের ওয়েবসাইটে তার নাম রয়েছে।

শাকুতিনের কার্যালয়ও নেত্র নিউজকে নিশ্চিত করেছে যে তিনি বাংলাদেশের অনারারি কনসাল জেনারেল ছিলেন এবং কমপক্ষে কয়েক বছর এই পদে ছিলেন।

শাকুতিনের কার্যালয় কর্মকর্তা ওলগা বলেন, "হ্যাঁ, তিনি অনারারি কনসাল জেনারেল ছিলেন, তবে শুধুমাত্র বাংলাদেশ ও বেলারুশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক সহযোগিতার জন্য।"

শাকুতিন কীভাবে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল জেনারেল হয়েছেন সে বিষয়ে তিনি কিছু জানেননা বলে উল্লেখ করেন।

২০১৬ সালে শাকুতিনের বেলারুশিয়ান কোম্পানি "আমকোদর" বাংলাদেশের ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায় এবং তার স্ত্রী শাশ্বতী রায়ের সাথে যৌথভাবে "আমকোদর পলাশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন লিমিটেড" নামে একটি বাংলাদেশ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে।

২০১৭ সালে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের একটি ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যায় অনিরুদ্ধ কুমারের নাম। বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার মতে, ২০১৭ সালের আগস্টে মাসে বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলাবাহিনী তার বন্ধু অনিরুদ্ধ কুমার রায়কে অপহরণ করে।

প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে বলে সিনহাকে তখন জানানো হয়েছিল। একই বছরের ১০ নভেম্বর কানাডা হয়ে অস্ট্রেলিয়া যাবার পথে বাংলাদেশের এক সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা তাকে জানান, অনিরুদ্ধ রায়কে মুক্ত করা হয়েছে।

"তিনি তখন আমাকে বলেছিলেন, যে তাকে একটি অজ্ঞাত স্থানে রাখা হয়েছে এবং আমি যদি পদত্যাগ করি তবে অনিরুদ্ধকে ছাড়া হবে।"

সিনহা ঐ গোয়েন্দাকে বলেন, "যতক্ষণ না তিনি অনিরুদ্ধের স্ত্রীর সাথে কথা বলছেন এবং অনিরুদ্ধকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত পদত্যাগ করবো না।"

এর কয়েক মিনিট পরই অনিরুদ্ধের স্ত্রীকে ফোন দেয় হয়। সিনহা বলেন, "তিনি কাঁদছিলেন এবং তার স্বামীর জীবনের বিনিময়ে আমাকে পদত্যাগ করার অনুরোধ করেছিলেন।"

এরপর সিনহা অনিরুদ্ধ কুমার রায়ের সাথে কথা বলেন। তিনি সিনহাকে বলেন, "স্যার, আমি আমার বাড়ির সিঁড়ির কাছে অবস্থান করছি।" এরপরই পদত্যাগ পত্রে সই করতে রাজি হন সিনহা।

অনিরুদ্ধ কুমার রায় অবশ্য মুক্তির পর সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে ব্যবসায়িক শত্রুতার কারণে তাকে অপহরণ ও আটক করা হয়েছিল।

এনকে/