বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্ট প্রকাশ, লঙ্ঘনের ঘটনা চরম

খালেদা জিয়ার রায়ে নিরপেক্ষতা চায় যুক্তরাষ্ট্র: রাজনৈতিক কারণে কাউকে কারাদণ্ড নয়

খালেদা জিয়ার রায়ে নিরপেক্ষতা চায় যুক্তরাষ্ট্র: রাজনৈতিক কারণে কাউকে কারাদণ্ড নয়

ওয়াশিংটন থেকে মুশফিকুল ফজল আনসারী, ২১ এপ্রিল (জাস্ট নিউজ): সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মামলার রায়ে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নিশ্চিত করার আহবান পূনর্ব্যক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার কারণে কারো কারাদণ্ড হতে পারেনা বলেও মনে করে দেশটি।

২০১৭ সালের বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্ট প্রকাশ উপলক্ষে শুক্রবার ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ফরেন প্রেস সেন্টারে আয়োজিত এক বিশেষ ব্রিফিং এমন অবস্থানের কথা জানান স্টেট ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র এডভাইসর এবং গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শ্রম বিষয়ক ব্যুরো প্রধান এ্যাম্বেসেডর মাইকেল জি কোজাক।

বিশেষ ওই ব্রিফিংএ সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টকে উদ্ধৃত করে সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী জানতে চান- আপনাদের রিপোর্ট অনুসারে ১৬২ জন ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে। এমনিভাবে বছরের প্রথম ১০ মাসে ১১৮ জন বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এমন ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেই চলেছে। গণতান্ত্রিক চর্চা সম্পর্কে বলা হয়েছে বিরোধীদের সভা-সমাবেশের অধিকার খুব সীমিত, বিশেষত প্রধান বিরোধীদল বিএনপি সমাবেশ করার সুযোগ পাচ্ছেনা। রিপোর্ট বলা হয়েছে বিগত ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন প্রধান বিরোধীদল বিএনপি বয়কট করেছে। মূলত শুধু বিএনপিই বয়কট করেনি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বয়কট করেছে। কেনোনা যুক্তরাষ্ট্র, ইইউসহ সকলে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল পাঠানো স্থগিত করে। আমরা তখনো দেখেছি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া। যাকে একতরফা নির্বাচন হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের প্রধান বিরোধী নেত্রী কারাগারে আটক রয়েছেন। এই বিষয়গুলো সার্বিক ভাবে আপনারা কিভাবে মূল্যায়ন করছেন? বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন অংশীদার হিসাবে দেশটিতে গণতন্ত্র প্রত্যাবর্তনে যুক্তরাষ্টের ভূমিকাই বা কি?-

জবাবে ট্রাম্প প্রশাসনের অন্যতম শীর্ষ এই কূটনীতিক বলেন, আমার ধারনা আপনি রিপোর্টি ভালো করে পড়েছেন। আজকে প্রকাশিত রিপোর্টটি গত ক্যালেন্ডার বছরের রিপোর্ট। যার মধ্যে ওই সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। এর পরে অনেকগুলো ঘটনা ঘটনা ঘটেছে। যা আপনিও বলেছেন। আগামী বছরের রিপোর্টে তা উঠে আসবে।

মাইকেল কোজাক বলেন, নির্বাচন আসন্ন। আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার আহবান জানিয়েছে এবং যা হতে হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে।

অবাধ প্রতিযোগিতা , উন্মুক্ততা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এটি একটি উপায়। আমরা ক্রসফায়ারের ঘটনা নিয়ে প্রতিনিয়ত সরকারের সঙ্গে কথা বলছি। এটি সাধারণত একটি বিতর্কের বিষয় যা কিনা একটি বৈধ সামরিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে ক্রসফায়ারে নিহত হয়। কিন্তু এটা আমাদের উদ্বেগের বিষয়। আমরা এই বিষয়ে মানুষদের সাথে কথা বলি।

আরেকটি বিষয় যা বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, যদি আমাদের কাছে তথ্য থাকে যে নিরাপত্তা বাহিনীর একটি বিশেষ ইউনিট ক্ষমতার অপব্যবহার করছে তখন আমরা প্রশিক্ষণ ও সরজ্ঞামাদি প্রদান বন্ধ রাখি। যতক্ষণ না সরকার অপরাধীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসে।

খালেদা জিয়ার কারাদন্ড প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মাইকেল কোজাক বলেন, “জিয়া সম্পর্কে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচারের আহ্বান আমরা জানিয়েছি, এবং শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার কারণে কারো কারাদন্ড হতে পারেনা।”

তিনি বলেন, “আমরা নানা উপায়ে মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করি। একেক দেশে একেক রকম ব্যবস্থা নেয়া হয়। যেমন- বিবৃতি প্রদান, সরঞ্জামাদি প্রদান না করে এবং মানবাধিকার সুরক্ষায় উত্সাহিত করা। কখনও কখনও লোকেদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যাতে তারা তাদের মানবাধিকার কর্মক্ষমতা উন্নত করে। সুতরাং সার্বিক ভাবে নানা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহনের মধ্য দিয়ে আমরা সমস্যা সমাধানের পথে অগ্রসর হচ্ছি। তবে রিপোর্ট সমস্যা সম্পর্কে, সমাধান সম্পর্কে নয়।”

রোহিঙ্গদের মানবিক বিপর্যয় ও যুক্তরাষ্ট্রের শক্ত অবস্থান থাকা সত্তেও মিয়ানমার সরকারের আন্তর্জাতিক চাপ অগ্রাহ্য করার বিষয়ে বাংলাদেশী সাংবাদিক শিহাব উদ্দিন কিসলুর করা অপর এক প্রশ্নের জবাবে এ্যাম্বেসেডর মাইকেল বলেন, নিঃসন্দেহে এটা এথনিক ক্লিনজিং বা জাতিগত নিধন। ভয়াবহতম বিপর্যয়। এখান থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই। আমরা ইতোমধ্যে এই ঘটনায় দায়ী সিনিয়র জেনারেলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছি।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির জন্য করনীয় সকল কিছুই যুক্তরাষ্ট্র করবে উল্লেখ করে বিপুল সংখ্যক শরণার্থী গ্রহণ করায় বাংলাদেশের উদারতার প্রশংসা করেন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র এই নীতিনির্ধারক।

মানবাধিকার লংঘন ও সভা-সমাবেশের অধিকার সংকুচিত
বাংলাদেশের মানবাধিকারের তীব্র সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে যেসব খাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেছে তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত মানবাধিকার প্রতিবেদন-২০১৭ এর বাংলাদেশ অংশে এ তথ্য উঠে এসেছে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে সবচেয়ে গুরুত্বর যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেছে তার মধ্যে রয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, নির্যাতন, খেয়ালখুশিমতো ও বৈআইনিভাবে আটকে রাখা, নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে জোর করে গুম করা, নাগরিক স্বাধীনতা সীমাবদ্ধতা। রয়েছে সংবাদ মাধ্যম, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় সীমাবদ্ধতা। সীমাবদ্ধতা রয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের স্বাধীনতা নেই।
রয়েছে দুর্নীতি, সহিংসতা, লিঙ্গগত বৈষম্য, রয়েছে যৌনতা বিষয়ক অপরাধ, ধর্মীয় বিষয়। আর রয়েছে জবাবদিহিতার অভাব।

এখনও মানব পাচার একটি গুরুত্বর সমস্যা হয়ে আছে। রয়েছে শ্রমিকদের অধিকারের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা। শিশু শ্রমের অবস্থা একেবারে বাজে। এ ছাড়া রয়েছে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে নির্যাতনের অভিযোগ থেকে তাদেরকে দায়মুক্তি দেয়ার ব্যাপকতা। নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা যেসব নির্যাতন বা হত্যাকাণ্ড ঘটায় তা তদন্তে বা বিচার প্রক্রিয়ায় সরকার সীমিত পদক্ষেপ নিয়েছে। পুলিশ ও নিরাপত্তামূলক সেবাখাতগুলোতে জনগণের রয়েছে অনাস্থা। এ জন্য তারা ফৌজদারি কোনো ঘটনা রিপোর্ট করতে বা সরকারি বাহিনীর সহায়তা নেয়া থেকে বিরত থাকেন।

রিপোর্টে আরো বলা হয়, সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ একটি উদার ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ একটি নির্বাচনে পুননির্বাচিত হয়ে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার দেশ পরিচালনা করছে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য উদ্ধৃত করে রিপোর্টে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের হাতে ক্রসফায়ারে ১৬২ জন নিহত হয়েছে। তবে অধিকার বলছে, বছরের প্রথম ১০ মাসে নিহত হয়েছে ১১৮ জন।

বাংলাদেশে চলমান গুমের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে মানবাধিকার রিপোর্টে বলা হয়, মানবাধিকার সংস্থা আর গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে দেশটিতে গুম এবং অপহরণ চলমান রয়েছে। এর অনেকগুলো আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সংস্থাসমূহের দ্বারা ঘটে থাকে। এধরনের অপরাধ দমন কিংবা তদন্তে সরকারে নেয়া ভূমিকা নামকাওয়াস্থে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে গত বছর ৬০ জনকে গুম করা হয়।

অপহরণের চিত্র তোলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ২০১৬ সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত তিন বিরোধী নেতার ছেলেদের আটক করে। এর মধ্যে এর মধ্যে হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে ছেড়ে দিলেও এখনো নিখোঁজ মির আহমেদ বিন কাশেম ও আমান আজমী। ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা তাদের এক রিপোর্টে জানায় ৪০ জনকে গুম করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে বে-আইনী গ্রেফতার অব্যাহত রয়েছে।

রিপোর্টে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধান সংবাদ মাধ্যম সহ মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে। কিন্তু এই অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। সংবিধানে সংবিধানের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহের সমান করে দেখানো হয়েছে। এমন রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে কেউ অভিযুক্ত হলে তাকে তিন বছর থেকে যাবজ্জীবন সাজা পাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। ২০১৬ সালে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব মাহমুদুর রহমান মান্না ও সাংবাদিক কনক সারওয়ার সহ উচ্চ পর্যায়ের অনেক ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে।

তবে মান্না ও কনক সারোয়ারের বিচার প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয় নি সরকার। ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ে এমন বক্তব্যকে সীমাবদ্ধ করেছে আইন। কিন্তু ঘৃণামুলক বক্তব্যের সংজ্ঞা কি তা পরিষ্কার করে বর্ণনা করা হয় নি। এর ফলে হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে সরকার বড় শক্তি ব্যবহার করার সুযোগ পায়। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে যায়, বিদেশী বন্ধুপ্রতীম দেশের বিরুদ্ধে যায়, আইন শৃংখলার বিরুদ্ধে যায়, নৈতিকতার বিরুদ্ধে যায়, আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে, মানহানি হয় অথবা অপরাধকে উসকে দেয় এমন সব বক্তব্য সীমিত করতে পারে সরকার।

বাংলাদেশে প্রিন্ট ও অনলাইন নিরপেক্ষ মিডিয়া সক্রিয় রয়েছে। তারা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। যেসব মিডিয়া সরকারের সমালোচনা করেছে তারা সরকারের নেতিবাচক চাপের মুখে পড়েছে। মাঝে মাঝে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সহ কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন করেন। এতে গত অক্টোবরে একটি অনলাইন নিউজ আউটলেটের একজন সাংবাদিক উৎপল দাসের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়। বলা হয়, অক্টোবরে উৎপল নিখোঁজ হলেও ডিসেম্বরে তাকে ফিরে পাওয়া যায়। তার পর উৎপল দাস যে বক্তব্য দিয়েছেন তার ফিরে আসা নিয়ে তাতে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। তবে পর্যবেক্ষকদের অভিযোগ ভীতি প্রদর্শনের পদ্ধতি অনুসরণ করে তাকে জোর করে গুম করা হয়েছিল।

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর ও সামাজিক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মুবাশ্বের হাসান গত বছর ৪৪ দিন নিখোঁজ ছিলেন। দ্য ওয়্যার নামে একটি সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট অভিযোগ করে যে, একটি বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা এই নিখোঁজের জন্য দায়ী। এর ফলে ওই ওয়েবসাইটটি ব্লক করে দেয় সরকার। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের মতে, ১৭ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিদেশের দূতবাসগুলোতে চিঠি পাঠানো হয়। বাংলাদেশী কোনো সাংবাদিক বিদেশ সফরে গেলে তাদের ওপর নজরদারি করতে নির্দেশনা দেয়া হয় ওই চিঠিতে।

 

(জাস্ট নিউজ/এমআই/জিএস/একে/১২৫৬ঘ.)