যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক প্রতিবেদন

২০২১ সালে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-সংঘাতের ঘটেছে

২০২১ সালে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-সংঘাতের ঘটেছে

২০২১ সালে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর বেশ কিছু হামলা, সংঘাত ঘটেছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।সংখ্যালঘু সুরক্ষায় সরকারের পদক্ষেপের পরও এসব ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে দেশটি।

বৃহস্পতিবার স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রকাশিত ২০২১ সালের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এসব কথা বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন আনুষ্ঠানিকভাবে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক বিশেষ দূত রাশাদ হুসাইন।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ১৬ পৃষ্ঠার একটি পর্যালোচনা রয়েছে।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন বারবার বলছেন, ভূমি বিরোধের জেরে তাদের বলপূর্বক পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ ও জমি কেড়ে নেওয়া প্রতিরোধে সরকারের ভূমিকা কার্যকর ছিল না।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয়, সংবিধানে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হলেও বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সমুন্নত রেখেছে। গত বছরের ১৩ থেকে ২৪ অক্টোবর সহিংসতায় মুসলমান, হিন্দুসহ বেশ কয়েকজন প্রাণ হারান। সরকার ওই হামলার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি সহায়তা সহযোগিতা, অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা এবং ২০ হাজারের বেশি লোকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করে।

প্রতিবেদনে, গত বছর ধর্মীয় ইস্যুতে তিনটি ‘হাইপ্রোফাইল’ মামলার রায়ের কথা রয়েছে। এর একটিতে একজন প্রকাশককে হত্যার দায়ে ৮ জঙ্গির, বাকি দুটিতে ৫ ও ১৪ জঙ্গির ফাঁসির আদেশের প্রসঙ্গগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। তা ছাড়া বছরজুড়ে সংখ্যালঘুদের অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়া, গুজব ছড়িয়ে হামলা, ধর্মীয় কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচারের তথ্যও তুলে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্র।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরজুড়ে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা অব্যাহত ছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত, দূতাবাস প্রতিনিধি ও পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের সদস্য ও ধর্মীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক এবং বিবৃতিতে ধর্মের নামে সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠীর অধিকার এবং সহনশীলতার পরিবেশ গড়ে তুলতে তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

এতে আরও বলা হয়, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টানসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা অব্যাহতভাবে বলে যাচ্ছে যে, জোরপূর্বক উচ্ছেদ এবং ভূমি দখল প্রতিরোধে সরকার কার্যকর কিছু করছে না। সহিংসতার টার্গেটে পরিণত হতে পারে এমন ধর্মীয় স্থান, উৎসব এবং ইভেন্টে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের মোতায়েন করেছে সরকার।

ফেসবুকে ১৩ই অক্টোবর দেয়া এক পোস্টে দেখা যায় একটি মন্দিরে এক দেবীর পায়ের কাছে পবিত্র কোরআনের একটি কপি রাখা। এ ঘটনায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা চালান মুসলিমরা। তাদের অভিযোগ, এর মধ্য দিয়ে পবিত্র কোরআনকে অপবিত্র করা হয়েছে। মিডিয়া, অধিকারকর্মী ও সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এ নিয়ে সহিংসতায় কমপক্ষে চার জন নিহত ও ১৪ জন আহত হয়েছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশজুড়ে মন্দির এবং হিন্দুদের সহায়সম্পত্তিতে হামলা হতে থাকে। এ ধারা চলতে থাকে ২৪ শে অক্টোবর পর্যন্ত। হিন্দু নেতারা বলেছেন, আরও সহিংসতার ভয়ে আতঙ্কিত তারা। ফলে ৪ঠা নভেম্বর প্রকাশ্যে দিওয়ালি উদযাপন থেকে তারা বিরত থাকেন। একই সঙ্গে মন্দিরে এবং ঘরে ঘরে এ উৎসব করার কথা বলেন তারা। হিন্দুদের নিরাপত্তার অভাবের প্রতিবাদে উপাসনাকারীরা তাদের মুখ কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখেন। আল জাজিরার জুনের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন সদস্য ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। এ জন্য অবাঙালি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি গ্রুপ তাদের ওই সদস্যকে হত্যা করে।

মে মাসের মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, অনলাইনে একটি ভিডিও গেম নিয়ে বিরোধে খ্রিস্টান চারজন শিক্ষার্থীকে ভয়াবহভাবে আহত করে মুসলিম শিক্ষার্থীরা। পরে আহত এক শিক্ষার্থী মারা যান। একই মাসে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের সূত্র অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রামে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর ওপর হামলা চালিয়ে মারাত্মক আহত হরেছে দু’ব্যক্তি। ফেব্রুয়ারিতে মিডিয়ার রিপোর্টে বলা হয়, লালমনিরহাট জেলায় খ্রিস্টানদের একটি চার্চ ধ্বংস করে দিয়ে সেখানকার সম্পদ চুরি করেছে মুসলিমদের একটি গ্রুপ।

প্রতিবেদন প্রকাশের সময় অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশ ও অঞ্চলের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এবারের প্রতিবেদনে বেশ কিছু দেশের পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এ জন্য ওই সব দেশের সরকার, নাগরিক সমাজ এবং দেশের জনগণকে ধন্যবাদ জানাই। আবার অনেক ক্ষেত্রে যে আমাদের অনেক কাজ করার বাকি, সেটিও প্রতিবেদনে দুর্ভাগ্যজনকভাবে উঠে এসেছে।’

অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতেও আমরা ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা হতে দেখছি।’ তিনি বলেন, গণতান্ত্রিকভাবে পিছু হটা অনেক দেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকারগুলোকে অবশ্যই এসব বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ হতে হবে।

তিনি বলেন, কোনো সরকার তার নাগরিকদের অধিকার ও সুরক্ষা না দিলে সেখানে অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। বিশ্বের অনেক দেশের সরকার তাদের নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারছে না। তিনি রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার বাহিনীর ও জিনজিয়াংয়ে উইঘুরদের ওপর চীন কর্তৃপক্ষের ‘গণহত্যার’ প্রসঙ্গ টানেন।