বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ব্যাপক পুলিশি নির্যাতনের শিকার: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ব্যাপক পুলিশি নির্যাতনের শিকার: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মঙ্গলবার জানিয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিট রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাছ থেকে ব্যাপক চাঁদাবাজি, হয়রানি এবং তাদেরকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তারে নিয়োজিত রয়েছে, যাদেরকে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা সন্ত্রাসী এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীর মাধ্যমে সহিংসতার শিকার হয়ে ইতোমধ্যে তারা অরক্ষিত হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশের আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে কাজ করে যেখানে রাষ্ট্রহীন সংখ্যালঘুদের প্রায় ১০ লাখ সদস্য রয়েছে, যাদের বেশিরভাগই সামরিক দমনের পর প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছে যা এখন জাতিসংঘের গণহত্যার তদন্তের বিষয়।

পুলিশের এই ইউনিটটি ২০২০ সাল থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘শরণার্থী এবং মানবাধিকার কর্মীরা জানিয়েছে, পুলিশি নির্যাতনের পাশাপাশি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে এপিবিএনের তত্ত্বাবধানে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। কিছু শরণার্থীর অভিযোগ, এপিবিএন অফিসার ও সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে যোগসাজশ রয়েছে।’

এইচআরডব্লিউ-এর এশিয়া গবেষক শায়না বাউচনারের উদ্ধৃতি দিয়ে করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শরণার্থীদের পুলিশের নির্যাতন থেকে রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর কাছেই নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।’ এইচআরডব্লিউ জানিয়েছে, তারা ৪০ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে। যাদের মধ্যে ১০ জন অভিযুক্ত ভিকটিম। তারা জানিয়েছেন, ইয়াবা পাচারের মিথ্যা অভিযোগে তাদের আটক করা হয়েছিল।

সংস্থাটি পুলিশের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেছে এবং এপিবিএন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে গুরুতরভাবে নির্যাতনের ১৬টিরও বেশি মামলা নথিভুক্ত করেছে। মানবাধিকার সংস্থাটি সরকারের কাছে এপিবিএনের ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের দাবি জানিয়েছে। এইচআরডব্লিউয়ের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ‘পুলিশ সাধারণত গ্রেপ্তার এড়াতে ১০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা এবং আটক পরিবারের সদস্যের মুক্তির জন্য ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা দাবি করে থাকে। ঘুষ এবং মামলা চালানোর টাকা সংগ্রহে পরিবারগুলোকে প্রায়শই স্বর্ণের অলঙ্কার বিক্রি বা টাকা ধার করতে হয়।’

এইচআরডব্লিউ জানিয়েছে, রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত এপিবিএন সদস্যদের ক্যাম্প পরিচালনার বিষয়ে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য শরণার্থী এবং মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থাগুলোর গোষ্ঠীর সঙ্গে কর্তৃপক্ষের পরামর্শ করা উচিত। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘প্রতিটি ক্যাম্পে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শরণার্থীদের অভিযোগ গ্রহণের জন্য প্রশিক্ষিত নন-এপিবিএন সদস্য রাখা উচিত।’

তবে এপিবিএন এর ব্যাটালিয়ন কমান্ডার সৈয়দ হারুনর রশিদ বলেছেন, প্রতিবেদনটি প্রশ্নবিদ্ধ। ‘অপরাধীরা তাদের কাছে মিথ্যা তথ্য বলছে, এবং (হিউম্যান রাইটস ওয়াচ) সেগুলো রিপোর্ট করছে। এটি অপরাধীদের সান্ত্বনা দেয়ার মতো,’ তিনি এএফপিকে বলেছেন, যোগ করেছেন যে ইউনিটটি ‘নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে’ তদন্ত করবে।

পুলিশ স্বীকার করেছে যে, শিবিরগুলোতে সহিংসতা বেড়েছে, যেগুলো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির আবাসস্থল এবং আঞ্চলিক মাদক পাচার নেটওয়ার্কগুলির জন্য মঞ্চ হিসাবে ব্যবহৃত হয়৷ জনবসতিতে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যুদ্ধের অংশ হিসাবে গত বছর সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা শীর্ষ সম্প্রদায়ের নেতা সহ কমপক্ষে ২০ শরণার্থীকে হত্যা করা হয়েছিল।

বেশ কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থী এএফপিকে বলেছে যে, পুলিশি নির্যাতনের ‘প্রচুর’ ঘটনা রয়েছে। ‘কয়েকদিন আগে আমি একটি হাসপাতাল থেকে আমার ভাইয়ের মেডিকেল রিপোর্ট নিয়ে ক্যাম্পে ফিরছিলাম। এপিবিএন অফিসাররা আমাকে চেকপয়েন্টে থামায়, আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং আমাকে থাপ্পড় মেরেছিল,’ বলেন আলী জাকের (২০)। তিনি দাবি করেন, পুলিশ তার কাছ থেকে প্রায় ৫ হাজার টাকা চুরি করেছে। ‘তারপর তারা আমার মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। আমি যদি কারো সাথে ঘটনাটি শেয়ার করি তাহলে তারা আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেয়,’ তিনি যোগ করেন।

সিতারা বিবি (৪৫) বলেন, পুলিশের চাঁদাবাজি একটি ‘নিয়মিত ঘটনা’। ‘আমার ছেলের বিয়ের সময় আমাকে তাদের ৩ হাজার টাকা দিতে হয়েছিল। যদি আমরা তাদের টাকা না দিই, তাহলে পুলিশ আমার ছেলের বিরুদ্ধে মাদক চোরাচালানের মামলা করবে,’ তিনি যোগ করেন। একজন রোহিঙ্গা নাগরিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এএফপিকে বলেছেন যে, শরণার্থীরা গভীর রাতে ক্যাম্পের মধ্যে যাতায়াত বা ক্যাম্পে প্রবেশের জন্য পুলিশকে অর্থ প্রদান করতে বাধ্য হয়। ‘যদি কেউ এ অপব্যবহারের প্রতিবাদ করে তবে তাকে গ্রেফতার করা হবে,’ তারা যোগ করেছে। সূত্র: এএফপি।