ওয়াশিংটনে রাইট টু ফ্রিডমের প্যানেল আলোচনায় বক্তারা

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ছাড়া  মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ছাড়া  মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়

ওয়াশিংটন থেকে বিশেষ সংবাদদাতা

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য জরুরি হলো আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ ভাবে অনুষ্ঠান করা।  নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে দেশের সামগ্রিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবেনা। রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্র চর্চা, বিচারব্যবস্থায় দৃষ্টি দেওয়া, ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে সংবিধান কী করবে-এগুলোতে দৃষ্টি দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে সরার আগে জরুরী গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। গণতন্ত্র  ছাড়া সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আশা করা অবান্তর।

বুধবার ওয়াশিংটন ভিত্তিক অধিকার সংগঠন ‘রাইট টু ফ্রিডম’ আয়োজিত ‘বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং আগামীর চ্যালেঞ্জগুলো’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন।

রাইট টু ফ্রিডম এর প্রেসিডেন্ট, অ্যাম্বাসেডর উইলিয়াম বি মাইলামের সঞ্চালনায় প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) এর সিনিয়র প্রোগ্রাম কনসালট্যান্ট এবং সিপিজে'র এশিয়া প্রোগ্রামের সাবেক সমন্বয়কারী স্টিভেন বাটলার, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং সুইডেনের গথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং রিসার্চার আলী রীয়াজ এবং ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর।

জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি, সাংবাদিক, স্কোলার এবং সিভিল সোসাইটি প্রতিনিধির অংশগ্রহণে এতে পরিচিতি তুলে ধরেন রাইট টু ফ্রিডমের  নির্বাহি পরিচালক সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী।

বাংলাদেশে গণমাধ্যম দলনের চিত্র তুলে ধরে সিপিজে'র এশিয়া প্রোগ্রামের সাবেক সমন্বয়কারী স্টিভেন বাটলার বলেন, “মুক্ত এবং স্বাধীন গণমাধ্যম একটি সরকার ব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যের অবাধ স্বাধীনতা ব্যতীত নাগরিকদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্থ হয়। কিছু লোক বলে থাকেন মুক্ত গণমাধ্যম গণতন্ত্রের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি এটা সত্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও গণমাধ্যম আক্রান্ত হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেয়া তথ্য মতে, এ বছরের শুরুর চার মাসে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের হয়রানির অন্তত ৯০ টি ঘটনা ঘটেছে। অতি সম্প্রতি জীবন যাত্রায় ব্যয় বৃদ্ধি নয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করার দায়ে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এবং সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি এবং সুনাম ক্ষুন্ন করার অভিযোগ আনা হয়েছে। এই অভিযোগটা সত্যিকার অর্থে হাস্যকর। সমাজ এবং সরকারের সমালোচনা করাটা সাংবাদিকদের কাজ এটা তাদের স্বাধীনভাবে করতে দেওয়া উচিত। তাদেরকে থামানোটা সরকারের কাজ না। সরকারের সমালোচনা করার সুযোগ থাকাটা প্রকৃত গণমাধ্যম এবং গণতন্ত্র বজায় থাকার ইঙ্গিত। এজন্য সরকারের গর্ব করা উচিত। যদিও এই দুই সাংবাদিককে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে কিন্তু এই মামলার রেশ তাদের টানতে হবে বছরের পর বছর ধরে।”

তিনি বলেন, “এই সরকারের প্রথম আলোর রিপোর্টার রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছে। উপনিবেশিক আমলের সিক্রেট অ্যাক্টে তার নামে তিন বছর আগে মামলা করা হয় এবং এর পর থেকে ক্রমাগত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এই মামলার কোন প্রমাণ নেই-পুলিশের এই সুপারিশের পরও তার বিরুদ্ধে মামলা চলমান রয়েছে। এই রিপোর্ট প্রকাশের সাত মাস পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মামলাটি পুলিশকে পুনরায় তদন্তের কথা বলে। এজন্য এই সাংবাদিককে নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। তাকে পাসপোর্ট জমা দিতে হয়েছে এবং প্রেস অ্যাক্রিডেশন বাতিল হয়েছে। প্রথম আলো পত্রিকাটিকে বাংলাদেশে টার্গেট করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শখ হাসিনা প্রথম আলোকে আওয়ামী লীগ এবং জনগণের শত্রু বলে মন্তব্য করেছেন। এই ধরনের মন্তব্যের একটা প্রতিক্রিয়া এবং রেশ থাকে। এ বক্তব্যের পরই একদল যুবক প্রথম আলো অফিসে অনুপ্রবেশ করে এবং হামলা চালায়। এ বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য হলো ভয় দেখানো। এই বিষয়টাই আমরা দেখেছি আলোকচিত্রী শহীদুল আলমের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে। তিনি এ বিষয় নিয়ে এর আগে এখানে বিস্তারিত বলেছেন। আমি মনে করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সমালোচনার ভয়েই শহীদুল আলমকে জেলে রাখতে চায়নি সরকার। এটা করতে না পেরে তার শহীদুল আলমকে হয়রানির করার পথ বেছে নেয়। তার বিরুদ্ধে এমনসব অভিযোগ আনা হয়েছে যার কোনো ভিত্তি নেই।নির্ধারিত সময় পর পরই তাকে আদালতে হাজির হতে হয়। এখানে তাকে আদালতে হাজির করাটাই বিষয়। বৃটেন প্রবাসী সাংবাদিক আব্দুর রবের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা করেছে সরকার। তবে উদ্বেগের কথা হলো তার ভাইকে বাংলাদেশে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। একইভাবে বৃটেন প্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খানের ভাইয়ের ওপর ঢাকার একটি রাস্তায় রড দিয়ে হামলা চালিয়েছে চার দুবৃর্ত্ত। এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো হচ্ছে প্রবাসে থাকা সাংবাদিকদের পরিবারের নিরীহ সদস্যদের হয়রানি করার পরিকল্পনার অংশ। পৃথিবীর অন্য দেশেও এগুলো হচ্ছে। চীনে এসব ঘটছে। পরিবারের সদস্যরা কোনাে অপরাধ না করার পরও তাদের এই হয়রানিটা একধরনের বর্বর আচরণ বলা যায়।”

বাটলার বলেন, “আইনমন্ত্রী বলেছেন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অপব্যবহার রোধে এটি সংশোধন করা হবে। আমি আশা করি এমনটা যেন হয়, তবে আশাবাদী হতে পারছিনা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে আমি ঢাকা সফরের সময় তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তথ্য এবং প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা প্রসঙ্গে বলেন এটি সংশোধন করা হবে। তিনি আমার যুক্তি গ্রহণ করেননি। ২০১৮ সালের অক্টোবরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনাে পরামর্শ না করেই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট চালু করা হয়।সরকারের কর্মকর্তারা প্রায় সময়ই বলে থাকেন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অপব্যবহার হচ্ছে কিন্তু এটার সমাধানে তারা কিছুই করেননা।”

বাংলাদেশ গণতন্ত্র এবং গণমাধ্যম-দুটো জিনিসই ধুঁকছে উল্লেখ করে বাটলার বলেন, “২০২৪ সালে বাংলাদেশে আরেকটি নির্বাচন আসন্ন। আর মাত্র সাত মাস বাকি। দুই দলের মধ্যে সত্যিকারের প্রতিদ্বিন্দ্বতা হবে কী না  এবং মত প্রকাশের কতটুকু সুযোগ থাকবে এটি একটি পরীক্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দৈনিক দিনকাল, যে পত্রিকাটি বিএনপির মুখপাত্র হিসেবে কাজ করতো সেটিকে জোরপূর্বক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিগত মাস গুলোতে যেসব ঘটনা ঘটেছে তা আমাকে খুব একটা আশাবাদী করেনা।”

নির্বাচন কমিশনের সাংবাদিক নীতিমালা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বাটলার বলেন, “এখানে সরকার স্পষ্টতই একটা কারচুপির নির্বাচন আয়োজনের অংশ হিসেবে এটা করছে। যেটা আমরা বিগত নির্বাচনে দেখেছি। সেখানে অনিয়ম হয়েছিলো।”

প্যানেল আলোচনায় উঠে আসে কারা হেফাজতে লেখক মুশতাক আহমদের মৃত্যু, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের উপর কারানির্যাতন, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা, সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম এবং নূসরাত রাকাকে কারাগারে প্রেরণ, ডেইলিস্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়ের, শামসকে তুলে নেয়া, কার্টুনিস্ট কিশোরের নির্যাতনসহ মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় সরকারি হস্তক্ষেপের তথ্য ভিত্তিক অসংখ্য চিত্র।   

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, “সরকার প্রণীত নতুন আইনগুলো নিয়ে এই পরিবেশে নির্বাচন হলে শুধু গণমাধ্যমই নয়, সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি কঠিন হয়ে যাবে।এখন যে যৎসামান্য কথা বলার সুযোগ আছে, তাও থাকবে না। এই সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, যদি তারা ২০১৪ কিংবা ২০১৮ সালের মতো আরেকটি নির্বাচন করে ফেলতে পারে তাহলে এই সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কিছু থাকবে বলে আমি মনে করি না। বর্তমান শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন নিয়ে কথা না বলে অন্য সবকিছু নিয়ে কথা বলা অর্থহীন।”

তিনি বলেন, “এই রাজনৈতিক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তন ছাড়া মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অর্থবহ হবেনা। তবে আমি যেটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি সেটা হলো- কথা বলা এবং সমাবেশের অধিকারকে নিয়ন্ত্রিত করে ফেলা হয়েছে। সামনে একটি নির্বাচন। অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সরকারকে এবিষয়ে চাপ দিতে হবে। আমি বিপ্লব না মৌলিক অধিকার প্রসঙ্গে কথা বলছি। আমরা এ বিষয়ে দুভার্গ্যবশত পিছিয়ে আছি। এটা মৌলিক অধিকারের বিষয়ে কথা। এ ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এটা শুধু সাংবাদিকদের দিয়ে হবেনা। এটা একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ। আর তাতে জনগণের অংশগ্রহণটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি আশা করি জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে এটা বুঝবে। এ চ্যালেঞ্জ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চ্যালেঞ্জ থেকে আরো বৃহৎ। পুরো দেশের ভবিষ্যতের বিষয় এটা। আমি মনে করি ২০২৩ সালটা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য খুবি গুরুত্বপূর্ণ হবে।”

আলী রীয়াজ বলেন, “বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পরিবেশের বিষয়টি বুঝতে হলে দেশের চলমান পরিস্থিতির দিকে আমাদের খেয়াল করতে হবে। বলতে হয় প্যারডক্সের কথা। আমি এটাকে প্যারডক্সই বলি।”

তিনি বলেন, “রিপোটার্স উইদাইট বর্ডারের গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৩৫.৩১। বাংলাদেশে মিডিয়ার যে চিত্রটা আমরা দেখতে পাচ্ছি সেটা হলো ইলিউশন। ২০১২ সালে এই সরকারের সময়টাতেই বাংলাদেশের স্কোর ছিলো ৫৭.৯৯। ২০২২-২২ এই এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ পিছিয়েছে ১০ধাপ। এই এক দশকে মিডিয়ায় যেটা আমরা দেখতে পেলাম সেটা ইলিউশন।”

আলী রীয়াজ বলেন, “আইনমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেছেন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল হবেনা। এটা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এবং রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হবে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে নির্বাচনের ঠিক পূর্বে আমরা এটার ব্যবহার দেখেছি। আরেকটি নির্বাচন সামনে আসছে। আরও দুটি নতুন আইন তৈরি হচ্ছে- উপাত্ত সুরক্ষা আইন এবং ডিজিটাল সোশাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ আইন। এগুলো আরেকটি সমস্যা। এর মাধ্যমে সামাজিকমাধ্যম ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে। এছাড়া আরেকটি আইন আছে। তারা প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধন করতে চাচ্ছে। এখানে কি সংশোধন হচ্ছে কেউ জানেনা। এমনকি সাংবাদিকদের সঙ্গেও পরামর্শ হয়নি।”

তিনি বলেন, “নির্বাচনকে সামনে রেখে এসব আইন নিয়ে শুধু মিডিয়া নয় বরং সামগ্রিক পরিস্থিতি আরও কঠিন হতে যাচ্ছে। মতপ্রকাশের যতটুকু অল্প জায়গা বাকি রয়েছে সেটুকু আর অবশিষ্ট থাকবে কীনা সেটা নির্ভর করছে শুধু মিডিয়া নয় বরং রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর।”

আলী রীয়াজ বলেন, “বাংলাদেশে গণতন্ত্রের এই অবনতির জন্য শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি দায়ী নয় বরং বাইরের কিছু শক্তির কারণেও দেশটির গণতন্ত্রের অবক্ষয় হচ্ছে। দেশটা স্বৈরতন্ত্রের দিকে যাচ্ছে এটা জানার পরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের এটা রোধে যে ভূমিকা নেয়ার কথা ছিলো তা তারা নিতে পারেনি।”

তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে আসল কথা হলো-২০২৩ সালে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া। এটাকে উপেক্ষা করা যাবেনা। রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্র চর্চা, বিচারব্যবস্থায় দৃষ্টি দেওয়া, ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে সংবিধান কী করবে-এগুলোতে দৃষ্টি দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এর সবগুলো নিয়ে একটি ঘরেই আলোচনা করা যাবে। আর সে ঘরের দরজাটা হলো-একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন। এটা হলেই সবাই মত প্রকাশের স্বাধীনতা পাবে। এটা ছাড়া কিছুই হবেনা। সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া বাকি সবগুলো বিষয় অর্থহীন।”

নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে বলেন, “ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের কারণে একটা প্রচন্ড ভয়ের পরিবেশ বিরাজ করছে। যদি গণমাধ্যমের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা এবং আমাদের জনগণের মতপ্রকাশের কথা বলি তাহলে বলতে হয় দেশে ২০০০ এর বেশী আইন রয়েছে যেগুলো উপনিবেশিক আমলে তৈরি করা হয়েছিলো। এআইনগুলো বৃটেন এবং পাকিস্তানের শাসনামলের তৈরি করা। এরপর আমরা নিজেদের সরকার পেয়েছি যারা একের পর এক শাসন করেছে। আমরা মিডিয়া এবং গণতন্ত্র নিয়ে অনেক কথা বলেছি। বাস্তবতা হলো আমাদের এখনো তাদের সঙ্গে এ বিষয়গুলো নিয়ে লড়ে যেতে হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “এখানে কার্যত এক দলের শাসন ব্যবস্থা চলছে। কর্তৃত্ববাদী সরকার পৃথিবীর কোথাও বিভিন্ন মতের মানুষ নিয়ে সমাজ পরিচালনা করতে পারেনা। আমাদেরকে এখানে নিউজ ছাপাতে সমস্যা হয়, আমাদের ব্যয় মেটাতে সমস্যা হয় এবং রাজনৈতিক সংঘাতকে মোকাবিলা করতে হয়। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকে তারা বলে থাকে যে ভীতিকর আইন তারা প্রত্যাহার করে নিবে কিন্তু সব শেষে যেটা দেখা যায় সেটা হলো সমাজ এবং রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের একটা রাজনীতিকরণ। ডিজিটাল সিকউরিটি অ্যাক্ট কিংবা অন্যান্য আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বিষয়টি আসলে বৃহত্তর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি অংশ। এবিষয়ে আপনারা এবং বিশ্বের অনেকেই আমাদের প্রতি সহানুভূতি জানাচ্ছেন। তবে এক্ষেত্রে যেটা বেশী প্রয়োজন সেটা হলে সমাজ এবং রাষ্ট্রের গণতান্ত্রয়ন।”

নূরুল কবির বলেন, “দেশের লাখো লাখো মানুষ গণতন্ত্রের চেতনাকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করে আছে। বিপ্লব প্রতিবছর আসেনা। গণঅভ্যুত্থানও প্রতিবছর হয়না। আমি এ বিষয়টাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। যতক্ষণ পর্যন্ত না গণমাধ্যমের সমস্যাকে গণতন্ত্রের সমস্যা হিসেবে চিন্তা করা না হবে আমি এটার কোনো সমাধান দেখিনা।”

তিনি বলেন, “ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট স্পষ্টত বস্তুনিষ্ট গবেষণার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, এ আইনের একটি ধারায় বলা হয়েছে, আপনি চাইলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে সমালোচনা করতে পারবেননা। পৃথিবী জুড়ে, যদি এশিয়ার কথাই বলি তাহলে বলতে প্রতিটি যুদ্ধ এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস আলাদা।  বাংলাদেশে সরকারের ইতিহাস নিয়ে নিজেদের একটা বর্ণনা আছে। আপনি যদি তাদের ইতিহাসের সঙ্গে মিল না পান, এর বর্ণনা এবং বিশ্লেষণের  প্রয়োজন হয় তাহলে আপনি আইনটির বিরোধীতা করতে পারবেননা। যদি বিরোধীতা করেন তাহলে আপনি বাধার মুখে পড়তে পারেন।”

“বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোর আয়ের একটা অংশের জন্য সরকারি বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভরশীল। আরা যারা স্বাধীনভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠান চালাতে চায় তাদেরকে নির্ভর করতে হয় ব্যাক্তি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনের উপর। এখানে তাদের কোনো স্বস্তি নেই। বিভিন্ন সরকারি বাহিনী, সরকার দলীয় নেতারা, সরকার সমর্থক ব্যবসায়ীরা তারা অন্যদেরকে নিষেধ করে দেয় তারা যেন এসব পত্রিকাকে বিজ্ঞাপন না দেয়। যদি বিজ্ঞাপন দেয়া হয় তাহলে সরকারের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয় তাদের। বিভিন্ন ক্ষতির পাশাপাশি এই অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যাওয়াটা একটা ক্ষতি।”

নূরুল কবির বলেন, “বর্তমান এই সময়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন কোনোভাবেই সফল হতে পারেনা যদিনা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ লড়াইটা শুরু না হয়। যারা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের সামনে এসে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের আন্তর্জাতিক বন্ধুও রয়েছে। আর যারা কতৃত্ববাদী শাসনের শিকার হয়েছে তাদেরও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বন্ধু রয়েছে। এজন্য প্রয়োজন গণতন্ত্রের অধিকারের পক্ষে একাত্মতা। এটা যেমন বাংলাদেশের ভিতরে প্রয়োজন তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকেও গণতন্ত্রের পক্ষে একত্মতা প্রকাশ করতে হবে। গণতন্ত্রের জন্য সীমানার কথা চিন্তা না করে যারা কাজ করছে তাদের উচিত বাংলাদেশের যারা গণতন্ত্রের পক্ষে কাজ করেন তাদের সমর্থন করা।”

তিনি বলেন, “আমার সাংবাদিক জীবনের ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, যৌবনে রাজনীতির উত্তাল ঘটনাপ্রবাহ পাড়ি দিয়েছি এবং ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের অভিজ্ঞতা যেটা বলে সেটা হলো, যদি আগামীকাল একটি অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা যায় তাহলে এসরকারকে বিদায় নিতে হবে। অবশ্যই সরকার বিদায় হবে। সামনে চ্যালেঞ্জ যেটা দাঁড়িয়েছে সেটা হলো- সার্বিক যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে সেটাকে মোকাবিলা করে দেশের জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে বাছাই করতে পারবে কীনা। পরের কথা হলো যদি এদেশের জনগণ সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তনে সফল হয় তাহলে ভবিষ্যতটা কী হবে? বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো পৃথকভাবে সাংবাদিকদের বলেছে তারা ডিজিটাল সিকউরিটি অ্যাক্ট বাতিল করবে।”

এমএন/