জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী দিবস পালিত

কার্যক্রমে বিশ্বে নন্দিত, নিন্দিত দেশে!

কার্যক্রমে বিশ্বে নন্দিত, নিন্দিত দেশে!

মুশফিকুল ফজল আনসারী, ৩ জুন (জাস্ট নিউজ): যুদ্ধ আর সংঘাতময় দেশগুলোতে শান্তির বার্তা পৌঁছে দিতে কাজ করে যাচ্ছে ‘ব্লু হেলমেট’ বাহিনী-জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশন। ১৯৪৮ সাল থেকে এই মিশনের যাত্রা শুরু হয়েছে। ৭০ বছরের পথ-পরিক্রমায় শান্তির জন্য প্রাণ দিয়েছেন ৩,৭০০ এর অধিক সেনা, পুলিশ আর বেসামরিক লোক। জাতিসংঘ মিশনের অন্যতম প্রধান অংশীদার হিসেবে যে দেশটির নাম গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারণ করা হয় তার নাম হলো বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশকে এ গৌরব আর সম্মানে আসীন করেছে দেশের দুর্বার আর প্রত্যয়ী সেনাসদস্যরা।

শান্তিরক্ষী মিশন আর বাংলাদেশ যেনো একে অপরের পরিপূরক। মিশনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অংশীদার আমাদের দেশ। সংঘাতপূর্ণ মালি, সিয়েরা লিয়ন, হাইতিসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদান প্রশংসার দাবিদার। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংঘাতময় সব এলাকায় সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োজিত আমাদের সেনাসদস্যরা। আর তার নজির অভূতপূর্ব, কোনো কোনো এলাকার লোকেরাতো বাংলা ভাষাতেই কথা বলে, বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিকে মিশিয়ে নিয়েছে নিজেদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের সঙ্গে। এমন বিরল নজির বাংলাদেশই দেখাতে পেরেছে।

২৯ মে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী দিবস। জাতিসংঘ মহাসচিবের ব্যস্ততার কারণে এবার দিবসটি পালন করা হয়েছে ১ জুন। দিবসটি উপলক্ষে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে মিশনে নিহতদের পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে বিনম্র শ্রদ্ধা জানান জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্থোনিও গুতারেস। নিহতদের স্মরণ করে মহাসচিব বলেন, ‘অন্যের জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন শান্তিরক্ষীরা। আমরা তাদের কাছে চির ঋণী আর তারা বেঁচে থাকবে আমাদের হৃদয়ে।’

আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী দিবস জাতিসংঘে সম্মান জানানো হয় নিহত চার বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর বিদেহি আত্মার প্রতি। সেই চার বাংলাদেশি হলেন-সার্জেন্ট মো: আলতাফ হোসেন, লেন্স কর্পোরাল মো: জাকিরুল আলম সরকার, মো: মনোয়ার হোসেন এবং মো: আব্দুর রহিম।

দিবসটি উপলক্ষে জাতিসংঘে নানান কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।

জাতিসংঘ সদর দপ্তরে শান্তিরক্ষী দিবসকে কেন্দ্র করে সাংবাদিকদের জন্য আয়োজন করা হয় এক বিশেষ আলোচনার। এতে শান্তিরক্ষা মিশন নিয়ে উঠে আসে আশা-প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির নানা হিসেব-নিকেশ।

জাতিসংঘ মহাসচিবের ডেপুটি মুখপাত্র ফারহান হক এর সঞ্চালনায় আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ফর পিস কিপিং জেইন পিয়েরে লেক্রয়িক্স এবং পিস কিপিং অপারেশন এর আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ফর ফিল্ড সাপোর্ট অতুল খারে। এছাড়া বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকরা আলোচনা আর প্রশ্নোত্তরপর্বে অংশ গ্রহণ করেন।

বিদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এ অগ্রণী ভূমিকা অনেকটা ম্লান করে দিয়েছে বর্তমান অনির্বাচিত সরকারের চলমান মানবাধিকার লংঘন, বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড, গুম-খুন, গ্রেফতার- নির্যাতন। ক্ষমতাসীন সরকার কেবল তার অবৈধ ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে সেনাবাহিনীর সদস্যদের একটি অংশকে নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার কাজে ব্যবহার করছে। র‌্যাব, পুলিশ কিংবা অন্যান্য আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে পরিনিত করেছে দলীয় লাঠিয়াল বাহিনীতে।

বিশেষ করে র‌্যাব সদস্যদের দ্বারা অহরহ বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে। আর তা নিয়ে অব্যাহত উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য সহ বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার সকল জাতিরাষ্ট। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাদের রিপোর্ট গুলির বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের আইনশৃংঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বর্বরতার চিত্র। বিশ্বের তাবৎ মিডিয়া তোলে আনছে এসব হৃদয় বিদারক ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদন। ক্ষমতাসীনদের এ সকল বেপরোয়া কর্মকান্ড বিদেশে বাংলাদেশের সেনাসদস্যদের সুনামকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মিশনে থাকা একাধিক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, ‘গুটি কয়েক অতি উৎসাহী সদস্যের কারণে সরকার এসব করাতে পারছে। আবার অনেকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে সরকারের হুকুম তামিল করছে। আর তাতে নষ্ট হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি।’

জাতিসংঘের শুক্রবারের বিশেষ ওই ব্রিফিংএ অংশ নিয়ে আমার জিজ্ঞাসা ছিলো- বাংলাদেশের সেনাসদস্যরা আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী মিশনে অংশ নিয়ে সাফল্য আর সুনামের সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। শান্তিরক্ষী মিশনে নিয়োজিত বাংলাদেশের বাহিনীগুলো অসম্ভব সফলতা দেখিয়েছে। একজন বাংলাদেশি সাংবাদিক হিসেবে আমি বিষয়টি নিয়ে খুবি গর্ব অনুভব করি। আর আজকের এই সুযোগে সকল বাহিনীর সদস্যদের সাধুবাদ জানাই। কিন্তু দেশের ভিতরের চিত্রটা ভিন্ন রকম। এই ফোর্সের সদস্যদের বর্তমান সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যবহার করছে, আর তাদের লক্ষ্য হলো যেকোনো উপায়েই ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা। বিশেষ করে র‌্যাব এর সদস্যরা বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে অহরহ। আমি যদি বলি, বিগত ১৬ দিনে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে ১২৫ জন মানুষ বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন।

বিদেশের ন্যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শান্তি, মানবাধিকার সুরক্ষা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় এসকল বাহিনী সদস্যদের প্রতি জাতিসংঘের কেমন আবেদন থাকতে পারে?

এমন প্রশ্নের উত্তরে জাতিসংঘ আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ফর পিস কিপিং জেইন পিয়েরে লেক্রয়িক্স বলেন, ‘আপনার এই প্রশ্ন নিশ্চিত ভাবে আপনি উত্থাপন করেছেন। তবে বিষয়টি আমার সীমার বাইরে। পিস কিপিং এর দায়িত্বপালনকারী হিসেবে আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে যেটি বলতে পারি তা হলো শান্তিরক্ষী মিশনের সহযোগি দেশগুলোর মধ্য বাংলাদেশ অন্যতম ভূমিকা পালন করছে। তারা মিশনে অংশ নিয়ে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘ মিশনের অংশ হিসেবে কঠিন এবং বিপদজনক পরিস্থিতির মধ্যে শান্তিরক্ষায় মালিতে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। যেখানে কদিন আগেই জাতিসংঘ মহাসচিব সফর করেছেন। বাংলাদেশের এ প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই।’

প্রসঙ্গত ১৯৮৮ সালে ইরাকে ১৫ জন সদস্য পাঠানোর মাধ্যমে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। তবে ১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বিএনপি সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহনের পর থেকে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব ব্যাপকতা লাভ করে। সে সময় থেকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষার অন্যতম অংশীদার হিসেবে কাজ করছে দেশটি। এ পর্যন্ত ৪০ দেশে ৫৪ টি শান্তি রক্ষা মিশনে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ। শান্তি রক্ষায় এ মহানব্রতে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশের ১,২৮,৫৪৫ জন সদস্য।

(জাস্ট নিউজ/জিএস/০৪২০ঘ)