নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে দেশে ফিরেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাস্থল থেকে ৫০ গজ দূরত্বে থাকায় শুক্রবারের নিমর্মতা থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন তামিমরা। দুটি ম্যচে হারের দুঃখের চেয়েও হৃদয়ে বড় পাথর নিয়ে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে করে শনিবার রাত ১০টা ৪০ মিনিটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান টাইগাররা।
এ খবর নিশ্চিত করেছেন বিসিবির মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস।
ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার পর নিউজিল্যান্ডে শেষ টেস্ট সিরিজ বাতিল হয়ে যায়। পরে বাংলাদেশ সময় শুক্রবার রাত ৩টার পর ক্রিকেটাররা ক্রাইস্টচার্চ বিমানবন্দরে পৌঁছান। শনিবার ভোর ৫টায় সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসে করে দেশের উদ্দেশে রওনা দেন বাংলাদেশ দলের ১৯ সদস্য।
কোচিং স্টাফসহ ১৯ জনের দল একসঙ্গে একই ফ্লাইটে দেশে ফিরেছেন। তবে প্রধান কোচ স্টিভ রোডস, পেস বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশ ও ট্রেনার মারিও ভিল্লাভারায়েন ফিরে যাবেন নিজ নিজ দেশে। আর দেশে ফিরেছেন মাহমুদউল্লাহ, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মেহেদী হাসান মিরাজ, মোস্তাফিজুর রহমান, লিটন দাস, তাইজুল ইসলাম, সাদমান ইসলাম, মুমিনুল হক, খালেদ আহমেদ, এবাদত হোসেন, মোহাম্মদ মিঠুন, নাঈম হাসান, আবু জায়েদ ও সৌম্য সরকার।
এর আগে দেশে ফেরা নিয়ে দলের ম্যানেজার খালেদ মাসুদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘(স্থানীয় সময়) শনিবার দুপুর ১২টায় (বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টা) আমরা রওনা দেব। আশা করি, ঢাকায় পৌঁছাব রাত ১০টা ৪০ মিনিটে।’
কোচিং স্টাফদের কেউ কেউ যে দলের সঙ্গে ফিরছেন না, সেটি অবশ্য ম্যানেজার আগেই বলেছিলেন। পাইলট বলেন, ‘আমরা ১৯ জন ফিরব। কোচিং স্টাফের কেউ ওয়েস্ট ইন্ডিজ যাবে, কেউ হয়তো দক্ষিণ আফ্রিকায়। তারা দ্রুতই টিকিট পেয়ে যাবেন।’
তৃতীয় টেস্ট ম্যাচটিকে সামনে রেখে গতকাল শুক্রবার সকালে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন সফরকারী বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। সংবাদ সম্মেলন শেষে দুপুর দেড়টায় জুমার নামাজ আদায় করতে টাইগারদের মসজিদে ঢোকার কথা ছিল তাদের। কিন্তু সংবাদ সম্মেলন শেষ করতে কিছুটা দেরি হয়ে যায় মাহমুদউল্লাহর। এই দেরি আর অজ্ঞাত এক নারীর সতর্কবানীর কারণে নৃশংসতা থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন মুশফিক, তামিম, মিরাজ, পাইলটরা।
যতক্ষণে তারা টিম হোটেলে ফেরেন ততক্ষণে এই দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে চলে গেছেন ৪৯ জন। হোটেলে ফিরেও নিজেদের মনকে বোঝাতে পারছিলেন না মুশফিক। চোখের কোন থেকে অঝর ধারায় গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। বোকা বনে গেছিলেন তামিম, সৌম্যসহ সব ক্রিকেটার।
ঘটনার পর থেকেই সারাবিশ্বের গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গেই প্রকাশ হয়েছে ক্রাইস্টচার্চের সন্ত্রাসী হামলা ও টাইগার ক্রিকেটারদের অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়ার খবর। এমনকি বিশ্বের বাঘা বাঘা ক্রিকেটারগণ টুইটারে ঝেড়েছেন ক্ষোভ। টাইগারদের জানিয়েছেন সাধুবাদ।
ক্রিকেটের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ক্রিকবাজ লিখেছে, রক্তাক্ত লোকজন যেভাবে মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসছিলেন তা যেন কোনো এক সিনেমার দৃশ্য। ক্রিকবাজ আরো লিখে, ক্রাইস্টচার্চে সন্ত্রাসী হামলায় অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।
ঘটনার পর একটি ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশ দলের টিম ম্যানেজার খালেদ মাসুদ পাইলট বলেছিলেন, ‘আমরা সত্যিই ভাগ্যবান ছিলাম। যে নরকীয় অবস্থার কথা শুনেছি, তা মেনে নেওয়া কষ্টকর।’
সফররত দলে ছিলেন টেস্ট স্পেশালিস্ট ব্যটসম্যান মমিনুল হক। কয়েকটি সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা বাসের মধ্যে পাঁচ-দশ মিনিট বসে ছিলাম। তখন পাইলট ভাই (ম্যানেজার) ফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছিলেন। পেছন থেকে তামিম ভাই এলেন, আমরা বাসের ড্রাইভারকে জানালা খুলতে বলি। দেখলাম বেশ কিছু লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমরা বাসের পেছনের দরজা খুলে পার্কের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলে আসি। আমরা পাঁচ মিনিট আগে মসজিদে পৌঁছালে ভেতরে থাকতাম এবং সবাই শেষ হয়ে যেতাম। পরম করুণাময়ের অশেষ রহমত যে পাঁচ মিনিট দেরিতে পৌঁছেছি।’
তবুও দেশটিকে ভালোবাসেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের উইকেট কিপার ও ব্যাটিং স্তম্ভ মুশফিকুর রহিম। তিনি বলেছেন, ‘আমার চোখে নিউজিল্যান্ড এখনো বিশ্বের সেরা দেশগুলোর একটি। আমরা এখনো নিউজিল্যান্ডকে ভালোবাসি।’
গতকালকের ঘটনার পর বাংলাদেশ দলের বাস ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর একটু আগেই রক্তের স্রোত বইতে শুরু করেছিল ক্রাইস্টচার্চের আল নুর মসজিদ। সে হামলার সরাসরি শিকার না হলেও ভয়ঙ্কর সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পার করেছেন বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা। ভীত-সন্ত্রস্ত দলকে দ্রুত হোটেলে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হলেও ঘটনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে বহুদিন সময় লাগবে।
এমআই