টোকিও অলিম্পিকে খেলতে চাই: শিরিন আক্তার

টোকিও অলিম্পিকে খেলতে চাই: শিরিন আক্তার

বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকসে অন্যতম সেরা একজন অ্যাথলেট শিরিন আক্তার। গত এক দশক ধরে অ্যাথলেটদের মধ্যে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন।

টানা দশবার দ্রুততম মানবী হয়েছেন সাতক্ষীরার এক কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা দেশ সেরা এই নারী স্প্রিন্টার।

২০০৭ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) ভর্তি হন শিরিন আক্তার। এরপর ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অভিষেক যুব এশিয়ান গেমসের মধ্য দিয়ে। ২০১৪ কমনওয়েলথ গেমস, ২০১৫ সালে এশিয়ান বিচ গেমস, ২০১৬ সালে গৌহাটি এসএ গেমস ও রিও অলিম্পিক গেমসে দেশের হয়ে ট্র্যাকে নামেন শিরিন। সবমিলিয়ে দেশের নারী অ্যাথলেটিক্সের ভরসার অন্য নাম শিরিন আক্তার।

দেশের হয়ে অনেক অর্জন শিরিন আক্তারের। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অঙ্গনে এখন পর্যন্ত কোনো স্বর্ণপদক অর্জন করতে পারেননি তিনি। সেই আক্ষেপটাই তাই রয়েই গেছে শিরিনের মাঝে। তবে স্প্রিন্ট ট্র্যাকে যতদিন আছেন সেই অর্জনের চেষ্টা করে যাবেন দেশের দ্রুততম এই মানবী।

আলাপকালে এমনটাই জানিয়েছেন শিরিন আক্তার। এসময় তিনি অ্যাথলেটিকস নিয়ে নিজের পরিকল্পনার কথা বলেছেন। জানিয়েছেন যত দিন বেঁচে থাকবেন খেলাধূলার এই জগতটা নিয়েই বেঁচে থাকতে চান। নিজের ক্যারিয়ারটাকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। খেলতে চান টোকিও অলিম্পিকে।

শিরিন বলেন, '২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সিনিয়র ন্যাশনাল খেলছি। এর মধ্যে কিন্তু আমার নিজের রেকর্ডই আমি ভেঙেছি। সে ক্ষেত্রে আমার মনে হচ্ছে যে আরো বেশি চ্যাম্পিয়ন হচ্ছি, দেশের রেকর্ড ভাঙছে সেটার জন্য আমি বিকেএসপিতে ট্রেনিংয়ের কথা বলব। আমার কোচ আব্দুল্লা হেল কাফি যিনি বাংলাদেশের সেরা স্প্রিন্টের কোচ। আমি বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য এটা পাচ্ছি। কিন্তু আমাকে যদি আরো বড় গেমস কিংবা পরিকল্পনাটা সেভাবেই করতে হবে। আমি দেশের রেকর্ড ভাঙছি দেশের সর্বোচ্চ জায়গায় থেকে, এর থেকে ভালো কিছু যদি আমাকে পেতে হয় তাহলে নিশ্চয়ই এর থেকে ভালো কিছু আমাকে দিতে হবে। তাহলেই সেই জায়গাটাতে পৌঁছানো সম্ভব। '

আমদের দেশের বেশির ভাগ অ্যাথলেট কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসে। যার ফলে পরিবারে অর্থ আয়ের উৎস হয়ে থাকেন এসব অ্যাথলেটরা। আর আর্থিক বিবেচনার কথা চিন্তা করলে আমাদের দেশের অ্যাথলেটদের কোনো আর্থিক নিরাপত্তা নেই। যার কারণে তাদের কাছ থেকে ভালো পারফম্যান্সটা পাওয়া সম্ভব হয় না। দেশের অন্যতম সেরা এই অ্যাথলেট তাই মনে করেন।

শিরিন বলেন, 'আমাকে চিন্তা করতে হয় যে, আমার বাবা কেমন আছে, আমার মা কেমন, আছে আমার বোন কেমন আছে, সবকছুই আমাকে দেখতে হয়। বেশিরভাগ অ্যাথলেটরাই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসে। সে ক্ষেত্রে আমার পরিবারের চিন্তা আমার মাথায় থাকে, আবার আমাকে পড়াশোনা করতে হবে, মোটামুটি ভাবে ফ্যামিলির একটা দায়িত্ব, নিজের একটা দায়িত্ব, খেলার চিন্তা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে হবে। আমি আজকে যে অর্থটাই পাচ্ছি না কেন সেটা আমার খেলাধুলা কিন্তু আমার জীবন-যাপনে খরচ হয়ে যাচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে যদি আমি এতো চিন্তার ভেতরে থাকি তো অনেক বেশি প্রশিক্ষণ নিলেও কিন্তু আমার পারফরম্যান্স ভালো হবে না। '

তিনিও আরও বলেন, 'ভালো পারফর্ম করতে গেলে আমাকে আরো অনেক দিক খেয়াল রাখতে হবে। পারফরম্যান্স শুধু কিন্তু অনুশীলন না অনুশীলনের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম, ভালো একটা পরিবেশে থাকা, চিন্তামুক্ত থাকা, মনকে পরিস্কার রাখা, আনন্দিত থাকা, সবকিছু মিলিয়ে একটা ভালো পারফরম্যান্স পাওয়া যায়। '

উন্নত বিশ্বে খেলাধুলার ক্ষেত্রে স্পোর্টস সাইন্সটা কিন্তু অনেক বেশি এগিয়েছে। অর্থাৎ প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে গেছে অ্যাথলেটদের পারফরম্যান্স। এই দিক দিয়ে আমাদের দেশ অনেক পিছিয়ে আছে। যার কারণে উন্নতি হচ্ছে না। বিদেশে দেশি কোচের অধীনে ক্যাম্পের ব্যবস্থা করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

শিরিন বলেন, 'আমাদের স্পোর্টস সাইন্সে কিন্তু এগিয়ে যেতে হবে। এই দিকটাতে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। স্পোর্টস সাইন্সটাকে কাজে লাগানোর অর্থ হচ্ছে এই যে একজন অ্যাথলেট কত কম শক্তি খরচ করে বেশিদূর এগোতে পারে সেটা নিশ্চিত করা। আর সেটা করতে হলে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে প্রযুক্তি তাকে কাজে লাগাতে হবে। সেটা দেশে হতে পারে, বিদেশে হতে পারে। বিদেশে ক্যাম্প করে হতে পারে সেক্ষত্রে আমাদের দেশী কোচ আমাদের সঙ্গে থাকলো। দেশের বাইরে যে ভাষাতেই কথা বলা হোক না কেন, তা কিন্তু পুরোপুরি বোঝা সম্ভব না। সেজন্য দেশী কোচরা থাকলে সুবিধা হবে। এই জায়গায় আমাদের আরো উন্নতি করা সম্ভব। '

নিজের ক্যারিয়ারের আক্ষেপের কথা বলতে দিয়ে শিরিন বলেন, 'পদক পেলে অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে। আর পদক না পেলে কষ্টের অনুভূতি কাজ করে। এসএ গেমস জুনিয়র এবং সিনিয়রে পদক পেয়েছিলাম, সেই অনুভূতিটা আসলে... দেশের পতাকাটা জড়িয়ে ধরে কিংবা প্রেজেন্ট করাটা আসলে অনেক অনেক আনন্দের। আমার ইচ্ছে ছিল যাতে দেশের জাতীয় সংগীতটা বাজুক। কিন্তু সেই সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে দেশের পতাকাটা সবার মাঝখানে তুলে ধরে যে পদক পেয়েছে সেটাও কম মনে হয় না আমার কাছে। খারাপ লাগে যেমন বড় বড় গেমসে পদক পাইনি। ইনশাআল্লাহ চেষ্টা করব যেন সেই সুযোগটা আসে। '

খেলাধুলা ছেড়ে দিলেও অ্যাথলেটিসের কল্যাণে কাজ করতে চান স্পোর্টস সাইন্স নিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া এই অ্যাথলেট। শিরিন বর্তমানে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে চুক্তিভিত্তিক চাকরি করছেন। পাশাপাশি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পোর্টস সাইন্সে মাস্টার্সে পড়ছেন। ইসলামী ইতিহাস থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১০ মাসের বিপিএড কোর্সও করেছেন তিনি। শিরিনের কোচিং নিয়েও রয়েছে পরিকল্পনা। এখন ক্যারিয়ারটা এগিয়ে নিয়ে যেতে চান।

শিরিন বলেন, 'স্পোর্টস সাইন্স নিয়ে পড়াশোনা করছি। স্পোর্টস সাইন্স নিয়ে এমএস (মাস্টার্স) শেষ হয়ে গেলে অদূর ভবিষ্যতে আমার পিএইচডি করার ইচ্ছা আছে। এই বিষয়ে সর্বোচ্চ পড়াশুনা ও জ্ঞান অর্জন করে আমি খেলার জগতে থাকতে চাই। আমি খেলার বাইরে যেতে চাই না। খেলাধুলা আমার অত্যন্ত প্রিয়। দেশের বাইরে কোচিং নিয়ে পড়াশোনা করতে চাই। লেভেল ওয়ান, টু -এই টাইপের যে কোর্সগুলো আছে সেগুলো শেষ করতে চাই। আপাতত ইচ্ছা আগামী পাঁচ-ছয় বছর খেলা চালিয়ে যাওয়া। সামনে টোকিও অলিম্পিকে খেলতে চাই, সেজন্য অনুশীলন শুরু করার ইচ্ছে আছে। '

এমজে/