পঞ্চপান্ডব ছাড়া ১৫ বছর পর মাঠে বাংলাদেশ দল

পঞ্চপান্ডব ছাড়া ১৫ বছর পর মাঠে বাংলাদেশ দল

২৮শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৬। শেষবার এই দিনে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল এমন একটি একাদশ নিয়ে মাঠে নামে যে দলে ছিলেন না তামিম ইকবাল, মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা, সাকিব আল হাসান, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ বা মুশফিকুর রহিমদের কেউ একজন।

বাংলাদেশের অনেকে এই পাঁচজনকে ডাকেন পঞ্চপান্ডব বলে।

আজ ঠিক এমন আরেকটি দিন।

অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে বৃষ্টিবিঘ্নিত টি-টোয়েন্টি ম্যাচের আগেই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের মিডিয়া বিভাগ নিশ্চিত করে যে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ থাকছেন না এই ম্যাচে, ফলে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন লিটন দাস। যেখানে ১০ ওভারের একটি ম্যাচেও ৬৫ রানে হেরে গেছে দলটি।

এর আগেই চোটের কারণে মুশফিকুর রহিম বাদ পড়েছেন।

তামিম ইকবাল ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন।

সাকিব আল হাসান তৃতীয় সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার কারণে কয়েকদিনের ছুটি কাটিয়ে এখন কলকাতায় কোয়ারেন্টিন পালন করছেন, আর অপেক্ষায় আছেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে মাঠে নামার।

আর মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা ২০১৭ সালেই অবসর নিয়েছেন টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট থেকে।

ক্রিকেট পরিসংখ্যানবিদ রিফাত এমিলের মতে, বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখনও পরিসংখ্যান বা সংখ্যার দিক থেকে এই পাঁচজনকে অতিক্রম করতে পারে এমন ক্রিকেটার পাওয়া যায়নি।

"এটা একদিক থেকে ভালো যে এক ঝাঁক অভিজ্ঞ ক্রিকেটারকে দীর্ঘদিন পেয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু তাদের জায়গায় কে খেলবে, সেটা নিয়ে যখন এখনও প্রশ্ন থেকে যায়, তা আবার কিন্তু নেতিবাচক।"

তামিম ইকবাল:

মোট রানের হিসেবে তামিম ইকবাল এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান।

২০০৬-০৭ মৌসুম থেকে তামিম ইকবালের সাথে জুনায়েদ সিদ্দিকি, নাজিমুদ্দিন, ইমরুল কায়েস, শাহরিয়ার নাফীস, এনামুল হক বিজয় কিংবা মোহাম্মদ আশরাফুল নানা সময়ে ওপেন করেছেন বাংলাদেশের হয়ে।

তবে কেউ তামিম ইকবালের কাছাকাছি পারফর্ম করা তো দূরে থাক, তামিমের সঙ্গী হিসেবেও দলে টিকতে পারেননি।

শেষ পর্যন্ত খুব একটা ধারাবাহিক না হলেও, সৌম্য সরকার ও লিটন দাস নিয়মিত হয়েছেন দলে।

কিন্তু তাদের পারফরম্যান্সও খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। অনেকদিন পরপর একটা দুটো ভালো ইনিংস খেলেন তারা।

বিশেষত, লিটন দাসের ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফরম্যান্স আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চিত্র পুরোই ভিন্ন।

সৌম্য সরকারও ২০১৫ সালে যেভাবে ব্যাট করে নিজের সম্পর্কে প্রত্যাশার পারদ উঁচুতে উঠিয়েছিলেন, তা আর ধরে রাখতে পারেননি। বরং সময়ের সাথে সাথে তার পায়ের কাজ, শট সিলেকশন, ধৈর্য্য - এসবই প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

মুশফিকুর রহিম:

উইকেটরক্ষক মুশফিকুর রহিমকে নিয়ে নানা অভিযোগ আছে বাংলাদেশে ক্রিকেট সমর্থকদের, বিশ্লেষকরাও মনে করেন তিনি উইকেটরক্ষক হিসেবে বিশ্বমানের নন। কিন্তু ব্যাটসম্যান মুশফিক বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অন্যতম স্তম্ভ হয়ে আছেন গত এক দশক ধরে।

তার জায়গাটিতেও অনেককে নিয়ে নানাভাবে পরীক্ষার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যাটিংয়ের পরীক্ষায় তারা আর টিকে থাকতে পারেননি। একজন বাড়তি ক্রিকেটার শুধুমাত্র কিপিংয়ের জন্য নেয়া আধুনিক ক্রিকেটে বিলাসিতাও বটে।

এনামুল হক বিজয়, মোহাম্মদ মিঠুনরা নানা সময়ে উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু তাদের ব্যাটে যথেষ্ট রান না থাকায় বেশি দিন টিকতে পারেননি।

সাকিব আল হাসান:

ব্যাট, বল, ফিল্ডিং, ক্রিকেটীয় চিন্তা - সব দিক থেকে বলা যায় সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্পূর্ণ ক্রিকেটার।

পরিসংখ্যানও তার হয়ে কথা বলে।

একই সাথে টানা ১৪ বছর একটা দলের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যাটসম্যান ও বোলার হয়ে ওঠার কাজটা তিনি করে গেছেন গেছেন নিয়মিত ভাবেই।

আবার মাঠের বাইরেও খবরের পাতায় সাকিবই সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি।

ব্যাপারটা এমন, সাকিব খেলছেন এটা যেমন খবর, সাকিব খেলছেন না এটা আরও বড় খবর।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সাকিব যখন সিদ্ধান্ত নিলেন এবারে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ খেলবেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের বদলে, তখন তিনি তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েন। আবার দেশের ক্রিকেট বিশারদরা এই প্রশ্নও তোলেন সাকিবের বদলি হিসেবে ক্রিকেটার গড়ে না তোলার ব্যর্থতা কার?

সাকিব দলে না থাকলেই পুরো একাদশে প্রভাব পড়ে অবধারিতভাবেই, পুরো দশ ওভার বল করা একজন বোলার এবং নির্ভরযোগ্যভাবে ব্যাট করা একজন ব্যাটসম্যানের অভাববোধ করে টিম ম্যানেজমেন্ট। যে ঘাটতি পুষিয়ে ওঠা অনেকসময় কঠিনই হয়ে পড়ে।

নাসির হোসেন, সোহরাওয়ার্দী শুভ, তারও আগে ফরহাদ রেজা - এরা নানা সময়ে বাংলাদেশের নতুন 'সাকিব' হয়ে ওঠার একটা ইঙ্গিত দিলেও কেউই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিয়মিত হতে পারেননি।

বরং এখন মেহেদী হাসান মিরাজ, শেখ মেহেদী হাসান কিংবা আফিফ হোসেনের দিকে নজর বাংলাদেশ ক্রিকেটের থিঙ্কট্যাঙ্কের।

মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা:

এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলার মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা।

মাশরাফী শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন ২০০৯ সালে - তবে এখনও মাশরাফীর পাওয়া ৭৮ উইকেটকে অতিক্রম করতে পারেননি বাংলাদেশের কোনও পেস বোলার।

মুস্তাফিজুর রহমানকে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রতিভাবান পেস বোলারদের একজন মনে করা হলেও বিদেশের মাটিতে, যেখানে গতি ও বাউন্স আছে, সেখানে তিনি কার্যকর বোলিং করতে পারেননি।

২০১৫ বিশ্বকাপে মাশরাফীর পার্টনার ছিলেন তাসকিন আহমেদ। তিনি ইনজুরি ও ফর্মের নানা সমস্যা কাটিয়ে দলে ফিরেছেন বটে, কিন্তু তিনি মাশরাফীর মানে পৌঁছুতে পারবেন কি-না, তা এখনই বলা মুশকিল।

মাশরাফী ছাড়া রুবেল হোসেন বাংলাদেশের হয়ে দীর্ঘদিন বোলিং করেছেন। কিন্তু মাশরাফী যেভাবে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পেস আক্রমণকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই অবস্থানটি এখনও কেউ নিতে পারেননি।

মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ:

বাংলাদেশ ক্রিকেটের বহুল আলোচিত এই 'পঞ্চপান্ডব'-এর মধ্যে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের পরিচিতি 'সাইলেন্ট কিলার' বা নীরব ঘাতক।

বাংলাদেশের অনেক বড় বড় জয়ের নায়ক বা সহ-নায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। তার পজিশনে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষাও হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট দলে তারা থিতু হতে পারেননি কিংবা টিম ম্যানেজমেন্ট তাদের ওপর ভরসা করতে পারেননি।

তাই পিঠের ব্যথা সত্ত্বেও চলমান নিউজিল্যান্ড সিরিজে ম্যাচ খেলেছেন তিনি।

২০১৫-১৬ সালেই সাব্বির রহমান, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত চেষ্টা করেও রিয়াদের চেয়ে বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারেননি।

২০১১ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের সাথে জয়ে অর্ধশতক, ২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে বিশ্বকাপে প্রথম সেঞ্চুরি এবং দুটো সেঞ্চুরি, ২০১৮ সালে নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলঙ্কার মাটিতে রুদ্ধশ্বাস একটি ম্যাচে ছয় মেরে জয়, ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সাকিবের সাথে জুটি গড়ে শত রানের ইনিংস খেলে নিউজিল্যান্ডকে হারানো - মনে রাখার মতো সব স্মৃতিতেই আছেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ।

এখন পর্যন্ত রিয়াদের জায়গায় খেলানোর মতো ক্রিকেটার পায়নি বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যানেজমেন্ট।

'গত পাঁচ বছরে পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট'

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের গেম ডেভেলপমেন্টের সাবেক ন্যাশনাল ম্যানেজার নাজমুল আবেদীন ফাহিমের মতে, গত ৪-৫ বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেট বরং বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে।

তিনি ২০১৫-১৬ সালে যে দলটিকে দেখেছিলেন, সেটি ছিল আত্মবিশ্বাসে ভরা। বিশেষত, ওয়ানডে ক্রিকেটে শক্তিশালী দল হিসেবে তখন চিহ্নিত হয়েছিল বাংলাদেশ।

মি. ফাহিম বলেন, এখন বাংলাদেশ যে শুধু টেস্ট খেলুড়ে দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ তা-ই নয়, ওয়ানডেতেও নিচের দিকের দল।

কোচ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভুল, ক্রিকেটার নির্বাচনে ভুল, ক্রিকেটার পরিচর্যায় ভুল, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ও ঘরোয়া ক্রিকেটে আকাশ পাতাল পার্থক্য, মেধাবী ক্রিকেটাররা জাতীয় দলে এসে ক্রিকেট খেলাটা শেখা - এসবকেই বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার কারণ বলে মনে করেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম।

"ওরা যে স্কুলে পড়ে, সেটা ঠিক আন্তর্জাতিক মানের না," এভাবেই হতাশা ব্যক্ত করেন মি. ফাহিম।