‘খেলার ফেরিওয়ালা’ মনসুর আলী আর নেই

‘খেলার ফেরিওয়ালা’ মনসুর আলী আর নেই

ক্রীড়াঙ্গনের অতি পরিচিত মুখ মনসুর আলী আর নেই। গতকাল মঙ্গলবার রাতে হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৫২ বছর। কয়েক দিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। তাঁর হার্নিয়ার সমস্যা ছিল বলে জানা গেছে।

মনসুর আলীর মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই ক্রীড়াঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। সংবাদ পেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক প্রকাশ করতে থাকেন ক্রীড়াঙ্গনের সর্বোচ্চ স্তরের মানুষেরা। মনসুর ছিলেন সবার প্রিয় একজন ক্রীড়া সংগঠক। তৃণমূল থেকে ফুটবলার তুলে আনার ব্যাপারে তাঁর ছিল জুড়িমেলা ভার ছিল।

নিজের নামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মনসুর স্পোর্টিং ক্লাব। সেই ক্লাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি হাতে প্রায় নিত্যদিনই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম এলাকায় আসতেন। একটু প্রচারের আশায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি নিয়ে ঘুরতেন। পরিচিত সাংবাদিক দেখলেই মিষ্টি হাসি দিয়ে সেই সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিতেন। ছাপানোর অনুরোধ করতেন খুব বিনয়ের সঙ্গে। অমুক জায়গায় মনসুর স্পোর্টিংয়ের জয়, অথবা মনসুর স্পোর্টিংয়ের খেলোয়াড় বাছাই...। ব্যস, এটুকুই। তা ছাড়া কোনো দল চ্যাম্পিয়ন হলে সবার আগে অভিনন্দন বার্তা দিতেন। শোক বার্তাও দিতেন সবার আগে।

সেই নিবেদিতপ্রাণ মনসুর আলীর কথাবার্তায় মিশে থাকত অদ্ভুত এক সারল্য। বিয়ে করেননি। খেলায় খেলায় সারা বেলা কাটিয়ে দেন। বিয়ের নিয়ে প্রশ্ন করলে বলতেন, ‘বিয়ে করার সময় কই। এই খেলা...ওই খেলা।’ এভাবেই খেলার দুনিয়ায় নিজেকে উৎসর্গ করে মনসুর আলী হয়ে ওঠেন ব্যতিক্রমী এক চরিত্র।

খেলার টানে ঘুরে বেড়াতেন এখানে-সেখানে। কখনো গ্রামের মেঠোপথে, কখনো জেলার কোনো এক স্টেডিয়ামে। কোনো খেলোয়াড়কে মনে ধরলে ঢাকায় নিয়ে আসতেন। এরপর নিজের দলে রাখতেন বা তাঁর ভাষায়, কোনো কর্মকর্তার হাতে–পায়ে ধরে অন্য ক্লাবে হয়তো ঢুকিয়ে দিতেন। এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন ‘খেলার ফেরিওয়ালা’।

১৯৮৭ সালে নিজের নামে প্রতিষ্ঠা করেন মনসুর স্পোর্টিং ক্লাব। এই ক্লাবের অধীনে ছিল বেশ কয়েকটি দল। তাঁর ভিজিটিং কার্ডে থাকত সেসবের বর্ণনা। গর্বিত কণ্ঠে বলতেন, ‘এখন ছয়টি আইটেম চালাই—ফুটবল, ক্রিকেট, হ্যান্ডবল, টিটি, ব্যাডমিন্টন ও রাগবি।’

তবে ফুটবলই ছিল মনসুর আলীর প্রাণের খেলা। প্রাণের আনন্দে সংগঠকদের দুয়ারে দুয়ারে হাঁটতেন স্পনসরের জন্য। প্রত্যাখ্যাতই হতেন বেশি। পাওয়া সামান্য কিছু অর্থ দিয়ে দলগুলো চালাতেন। নিজেই বলতেন, ‘প্রতিবছর আমার টিমগুলোর রেজাল্ট কিন্তু ভালো।’

প্রায় ৩৫ বছর ধরে পাইওনিয়ার ফুটবল লিগে খেলছে মনসুর স্পোর্টিং ক্লাব। দলটাকে ওপরে তুলতে নাকি ভয় পেতেন। পাইওনিয়ার লিগে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকায় একটা দল গড়া যায়। কিন্তু তৃতীয় বিভাগে তুললেও আট থেকে দশ লাখ টাকা লাগবে। এত টাকা কে দেবে? তাই দলটাকে পাইওনিয়ারেই রাখতেন।

জীবনটাকে তিনি দেখতেন মাঠ থেকে মাঠ দাবড়ে বেড়ানোর আনন্দের উপলক্ষ হিসেবে। ভালোবাসতেন আবাহনী, আর্জেন্টিনা, মেসি। আর ভালোবাসতেন পান খেতে। মুখটা তাই লাল হয়ে থাকত সারাক্ষণ। এসব নিয়ে গল্পে একবার সরল হাসিতে গড়াগড়ি খান মনসুর, ‘ক্রীড়াসাংবাদিক রুমি ভাই (প্রয়াত মাসুদ আহমেদ রুমি) একবার আমাকে মজা করে বললেন, “ওই, তুই এখনো বসে আছিস। কাবাডি তো স্বর্ণ পাইছে...।” আমি তাড়াতাড়ি প্রেস রিলিজ লিখে অভিনন্দন জানালাম কাবাডি দলকে। আসলে ওরা স্বর্ণ পায়নি। রুমি ভাই মজা করছিলেন। পরে বললেন, “তুই এটা কী করলি রে মনসুর!’

খেলার নেশায় একসময় চাঁদপুরের বাড়িতে কম যাওয়া হতো। কৌশলে তাঁকে বাড়ি পাঠাতে কত মজার কাণ্ড করতেন বন্ধরা! মনসুর আলী বলেছিলেন, ‘বন্ধুরা পত্রিকায় প্রেস রিলিজ দিল, আমার আব্বা-আম্মা নাকি মারা গেছেন। আমি বাড়ি গিয়ে দেখি তাঁরা সুস্থ, হা হা হা!’

লেখাপড়া করেন ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। বেড়ে ওঠেন পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারে। ‘ওখানে হোটেল ছিল আমাদের, বড় ভাইয়ের সঙ্গে এগুলো চালাতাম। তখনকার সময় প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার পরোটা আর গরুর গোশত বিক্রি হতো। খাজা নূর হোটেল, জুতার দোকান...কত-কী ছিল!’ বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন মনসুর আলী। কাঁচা পণ্যের ব্যবসা করে জীবনের চাকা সচল রেখেছিলেন। নিজ ফুটবল দলের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিটি চালু রাখেন দনিয়া ধোলাইরপাড় মাঠে। আজ বুধবার সেই ধোলাইরপাড় স্কুল মাঠে বেলা ১১টায় তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।

খেলার অঙ্গনে চরিত্রের কমতি নেই। তবে মনসুর আলী ছিলেন ব্যতিক্রম। এমন মানুষ ক্রীড়াঙ্গনকে শুধু দিয়েই গেছেন। বিনিময়ে তেমন কিছু পাননি। না পাওয়ার দীর্ঘশ্বাস নিয়েই তিনি চলে গেলেন ক্রীড়াঙ্গনকে কাঁদিয়ে।-প্রথম আলো