দিনে ৩০ লাখ টাকা আয় ওসির, স্ত্রীর নামে বিলাসবহুল বাড়ি

দিনে ৩০ লাখ টাকা আয় ওসির, স্ত্রীর নামে বিলাসবহুল বাড়ি

* তাহিরপুর থানায় যোগদানের পর চাঁদাবাজি, মিথ্যা মামলা দিয়ে মানুষকে হয়রানি-
* রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ-
* যাদুকাটা নদীতে ২০০ ড্রেজার বসিয়ে অবৈধ টাকার মালিক-
* ড্রেজারপ্রতি ১৫ হাজার টাকা করে প্রতিদিন ৩০ লাখ টাকা আয়-
* অবৈধ টাকা দিয়ে ভারত ও সিলেটে বাড়ি নির্মাণ-
* দুর্নীতির অধিকাংশ টাকা বিদেশে পাচার-

দৈনিক ৩০ লাখ টাকা আয় করা সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থানা পুলিশের সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নন্দন কান্তি ধর এবার একটি মিউজিক ভিডিওটিতে মডেল হয়েছেন।২০১৭ সালে তাহিরপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিলাসবহুল জীবনযাপন শুরু করেন নন্দন কান্তি ধর। তাহিরপুর থানার ওসি থাকা অবস্থায় মিউজিক ভিডিওটির মডেল হন তিনি।

‘তুমি শুধু তুমি’ মিউজিক ভিডিওর মাধ্যমে নিজেকে মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেন ওসি নন্দন কান্তি। চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সময় সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণে ছিলেন তিনি।

এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ওসি নন্দন কান্তির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মিথ্যা মামলা দিয়ে মানুষকে হয়রানি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। চাঁদাবাজির টাকায় বিলাসবহুল জীবনযাপন এবং দায়িত্বে থাকা অবস্থায় মিউজিক ভিডিওর মডেল হওয়ার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে পুলিশ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

এর আগে মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) দুপুরে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়ে ওসি নন্দন কান্তি ধরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ দেন তাহিরপুর উপজেলার উত্তর বড়দল এলাকার বাসিন্দা সেলিম ইকবাল।

দুদকে অভিযোগ দেয়ার পরই ২০১৮ সালে একটি মিউজিক ভিডিওতে ওসির মডেল হওয়ার বিষয়টি সবার নজরে আসে। একই সঙ্গে ওসি নন্দন কান্তির মডেল হওয়া ‘তুমি শুধু তুমি’ মিউজিক ভিডিওর গানটি ভাইরাল হয়।

দামি ব্র্যান্ডের গাড়ির পাশে ওসি নন্দন কান্তি ও তার স্ত্রী। ডান পাশে ফেসবুকে আপলোড করা মদের বোতলের ছবি

ইউটিউব চ্যানেলের তথ্য অনুযায়ী, সংগীত শিল্পী শুভ চৌধুরী ও পপি চৌধুরীর গাওয়া গানের মডেল হয়েছেন ওসি নন্দন কান্তি ধর। তার সহযোগী মডেল হিসেবে রয়েছেন উর্মি। ২০১৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউটিউব চ্যানেলে এ গানটি আপলোড করা হয়। ওই সময় তাহিরপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন নন্দন কান্তি।

দুদকে দেয়া অভিযোগে বলা হয়, ওসি নন্দন কান্তি ধর ২০১৭ সালে তাহিরপুর উপজেলায় যোগদানের পর থেকে বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজি, মিথ্যা মামলা দিয়ে মানুষকে হয়রানি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করেছেন। একই সঙ্গে যাদুকাটা নদীতে ড্রেজার বসিয়ে অবৈধ টাকার মালিক হয়েছেন ওসি নন্দন কান্তি।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, ওসি নন্দন কান্তি ধর ২০০ ড্রেজারের মালিক। প্রতিদিন ড্রেজারপ্রতি ১৫ হাজার টাকা করে প্রায় ৩০ লাখ টাকা আয় করেছেন। গত তিন বছর তাহিরপুর থানার ওসি থাকা অবস্থায় এসব টাকা অবৈধপথে অর্জন করেছেন তিনি। ওসি নন্দন কান্তি ধরের দুর্নীতির পরিমাণ এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, অবৈধ টাকা দিয়ে ভারত, সিলেটে বাড়ি নির্মাণ করেছেন। দুর্নীতির টাকা বিদেশে পাচার করেছেন ওসি নন্দন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নন্দন কান্তি ধর তাহিরপুর থানার ওসি থাকা অবস্থায় ঘুষ নিয়ে তাহিরপুরের আমতলী গ্রামের বিবাহিত কনস্টেবল সাইফুল ইসলামকে অবিবাহিত বলে প্রত্যয়নপত্র দিয়ে এসআই পদে সুপারিশ করেন। পরে কনস্টেবল সাইফুল ইসলাম এসআইয়ের ট্রেনিংয়ে গেলে বিয়ের বিষয়টি তদন্তে বেরিয়ে আসে। পরে কনস্টেবল সাইফুল ইসলামকে চাকরিচ্যুত করা হয়। একই সঙ্গে ওসি নন্দন কান্তি ধরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিভাগীয় পুলিশ কর্মকর্তা নির্দেশ দেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত ওসি নন্দন কান্তির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

স্থানীয় সূত্র জানায়, নন্দন কান্তি বিভিন্ন সময় বিদেশ ভ্রমণে গেলে মদপান করে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামি দামি মদের বোতলের ছবি ফেসবুকে আপলোড দেন। তার স্ত্রীর নামে সিলেটে রয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি।

তাহিরপুর থানা সূত্র জানায়, নন্দন কান্তি ধর তাহিরপুর থানার ওসি থাকা অবস্থায় তাহিরপুর থানা কোয়ার্টারে এসি ব্যবহার করেন। সাধারণ মানুষকে হয়রানি করেছেন। ঘুষ ও চাঁদাবাজির টাকায় সিলেট মহানগরীতে স্ত্রীর নামে তৈরি করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি, কিনেছেন দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি।

দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সময় সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় ভ্রমণে ওসি নন্দন

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাহিরপুর থানা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ওসি নন্দন কান্তি ধর অনেক অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ দেয়া হয়েছে। এখানে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় মিউজিক ভিডিও গানের মডেল হয়েছেন তিনি। দায়িত্বে থাকা অবস্থায় চলচ্চিত্র কিংবা গানের মডেল হতে পারেন না পুলিশের কোনো কর্মকর্তা। এসব করতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু বিলাসী জীবনযাপন করতে গিয়ে এসব কর্মকাণ্ড করেছেন ওসি নন্দন কান্তি। এতে বোঝা যায় দায়িত্বে চরম অবহেলা করেছেন তিনি।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তাহিরপুর থানা পুলিশের সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নন্দন কান্তি ধর বলেন, দুদকে অভিযোগ দেয়ার বিষয়টি আমি শুনেছি। আমার বিরুদ্ধে দুদকে মিথ্যা অভিযোগ দেয়া হয়েছে। দুদক অভিযোগ তদন্ত করলে সত্যতা বেরিয়ে আসবে। এ নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।

দায়িত্বে থাকা অবস্থায় মিউজিক ভিডিওটির মডেল হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নন্দন কান্তি ধর বলেন, গানের বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি কোনো গানের মডেল হইনি। ওই গানের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।

এ বিষয়ে সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, যেহেতু সাবেক ওসি নন্দন কান্তি ধরের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ দেয়া হয়েছে সেহেতু বিষয়টি তদন্ত করবেন দুদক কর্মকর্তারা। এর পাশাপাশি যদি কোনো পুলিশ কর্মকর্তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কোনো গানের মডেল হন কিংবা চলচ্চিত্রে অংশ নেন তাহলে সমস্যা হবে না। যদি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে গানের মডেল হন তাহলে নন্দন কান্তি ধরকে জবাবদিহি করতে হবে।

এমআই