তারল্য সংকট কাটাতে ব্যাংকগুলোর হিমশিম

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই ধার ৫৩ হাজার কোটি

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই ধার ৫৩ হাজার কোটি

উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে কমেছে মানুষের সঞ্চয় ক্ষমতা। আস্থাহীনতার কারণে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অনেকে রাখছেন হাতে। আবার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির বিপরীতে বাজারের টাকা উঠে আসছে। সব মিলিয়ে চরম তারল্য সংকটে পড়েছে ব্যাংক খাত। ধারদেনা করে দৈনন্দিন খরচ মেটাচ্ছে অনেক ব্যাংক। গত সোমবার পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আন্তঃব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৭ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই ধার ৫৩ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। এর আগে কখনও এত ধার নেওয়ার নজির নেই। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, কয়েকটি ব্যাংকের কারণে পুরো ব্যাংক খাতের এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। সাধারণত বেসরকারি খাতে ঋণ চাহিদা বাড়লে তারল্য সংকটে পড়ে ব্যাংক খাত। এখন তেমন বিনিয়োগ চাহিদা না থাকায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের আশপাশেই রয়েছে। এরপরও ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট সৃষ্টির প্রধান কারণ বিভিন্ন জালিয়াতি ও আস্থাহীনতা। আস্থা না থাকায় অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিজের কাছে রেখে নিশ্চিন্ত থাকছেন কয়েকটি ব্যাংকের গ্রাহক। অনেকে ব্যাংকে টাকা না রেখে ডলার কিনে ঘরে রাখছেন। মানুষের সঞ্চয় ক্ষমতাও কমেছে। আবার দীর্ঘদিন চলমান ডলার সংকট মেটাতে গিয়ে রিজার্ভ থেকে বিক্রি অব্যাহত আছে। এই অর্থবছরে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ৫৯০ কোটি ডলার বিক্রির বিপরীতে উঠে এসেছে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে সরকারকে সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ দেওয়া বন্ধ রেখেছে। অথচ বাণিজ্যিক ব্যাংককে এভাবে ধার দেওয়ার প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে একই। এটাও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে সরবরাহ করার মতো। তিনি বলেন, কয়েকটি ব্যাংকের কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। এগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে এভাবে তারল্য সহায়তা দেওয়া ঠিক না। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের তারল্য দিচ্ছে, অথচ শাস্তি দিচ্ছে না। এমনকি প্রশ্নও করছে না টাকা কোথায় যাচ্ছে। ব্যাংক খাত ঠিক করতে চাইলে এদের আটকাতে হবে। তিনি বলেন, সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর মূল সমস্যা সুশাসন। এসব ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে পুনর্গঠন করতে হবে। কীভাবে পরিস্থিতির উন্নতি করবে, সেই পরিকল্পনা নিতে হবে। এরপর প্রয়োজন মতো তারল্য দেওয়া না দেওয়ার বিষয়টি দেখতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিটি ব্যাংকের একটি চলতি হিসাব রয়েছে। এ হিসাবের বিপরীতে ব্যাংকগুলো বিধিবদ্ধ নগদ জমা (সিআরআর) সংরক্ষণ এবং এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকের চেক ক্লিয়ারিংসহ বিভিন্ন পরিশোধ নিষ্পত্তি করে। বর্তমানে শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংক সিআরআর ও বিধিবদ্ধ তারল্য (এসএলআর) সংরক্ষণ তো দূরে থাক, বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টই খালি করে ফেলেছে। উল্টো গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব ব্যাংকের কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৩ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা পাওনা দাঁড়িয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সাধারণভাবে কোনো ব্যাংক এ অবস্থায় যাওয়ার পর ওই ব্যাংকের চেক ক্লিয়ারিং বন্ধ থাকার কথা। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ সুবিধায় চেক ক্লিয়ারিং অব্যাহত আছে। নতুন ঋণও দিচ্ছে এসব ব্যাংক। নানা কারণে এখন এ রকম হলেও একটি সময় শুধু ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের কাছে ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকত। কেউ সংকটে পড়লে এদের থেকে ধার নিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো প্রতিদিন বিভিন্ন মেয়াদে ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার নিচ্ছে। সোমবার বিভিন্ন ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয় ১৫ হাজার ১২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৫টি ব্যাংক এক দিন মেয়াদি ধার নিয়েছে ৭ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। ২০টি ব্যাংক ও দুই আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাত দিন মেয়াদি ধার নেয় ৭ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। আর শরিয়াহভিত্তিক তিন ব্যাংক ১৪ দিন মেয়াদি ধার নেয় ৪৮৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত সোমবার ধারের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। এক দিন মেয়াদি ধারের বাইরে তিন দিন মেয়াদি ধার ছিল ২৪ কোটি টাকা। সাত দিন মেয়াদি ধার ৩৮ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের ১৪ দিন মেয়াদি ধারের স্থিতি ৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, সোমবার আন্তঃব্যাংক কলমানিসহ বিভিন্ন মেয়াদে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংক থেকে ৪ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা ধার নিয়েছে। এর মধ্যে এক দিন মেয়াদি কলমানিতে গড়ে ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ সুদে ধারের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা। বাকি ধার নিয়েছে বিভিন্ন মেয়াদে। সব মিলিয়ে ধারের স্থিতি ছিল ১৩ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা।কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোকে ট্রেজারি বিল, বন্ডের মতো বিভিন্ন উপকরণ বন্ধক রাখতে হয়। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো যেহেতু সুদভিত্তিক বিল ও বন্ড কিনতে পারে না, সে কারণে এসব ব্যাংকের হাতে ধার নেওয়ার মতো উপকরণ থাকে কম। সংকটে পড়া পাঁচ ব্যাংকের জন্য যেটুকু ছিল, তা বেশ আগেই শেষ হয়েছে। ফলে এখন বিশেষ উপায় ছাড়া আর ধার পাচ্ছে না।-সমকাল