বাংলাদেশে সাংবাদিকদের সুরক্ষার আহবান সিপিজেসহ তিন সংস্থার

বাংলাদেশে সাংবাদিকদের সুরক্ষার আহবান সিপিজেসহ তিন সংস্থার

জাতিসংঘের মানবাধিকার পর্যালোচনা অধিবেশনের প্রাক্কালে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের সুরক্ষার আহবান জানিয়েছে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট-সিপিজে।

জাতিসংঘের ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ-ইউপিআর (সর্বজনীন নিয়মিত পর্যালোচনা) ওয়ার্কিং গ্রুপের ৪৪তম অধিবেশনের জন্য পাঠানো এক প্রতিবেদনে এই আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ বেআইনি আটক, হয়রানি এবং বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমে গণমাধ্যমকে স্তব্ধ করতে ক্রমবর্ধমানভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।সিপিজে, রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস ও এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টার-এই তিনটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে প্রতিবেদনটি দাখিল করেছে। আগামী নভেম্বরে ইউপিআর অধিবেশন বসার কথা রয়েছে। সিপিজের ওয়েবসাইটে গতকাল বুধবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

প্রতিবেদনে সাংবাদিক হত্যা ও অপহরণের ক্ষেত্রে দায়মুক্তি, নিরাপত্তা হেফাজতে সংবাদকর্মীদের সঙ্গে সহিংস আচরণ এবং ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কারাগারে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এতে সরকারের সমালোচক নির্বাসিত সাংবাদিকদের পরিবারের সদস্যদের বেআইনি আটক, হয়রানি এবং তাদের সঙ্গে সহিংস আচরণের ঘটনাও তুলে ধরা হয়।

প্রতিবেদনের সূচনায় বলা হয়, এই প্রতিবেদনে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের উদ্বেগজনক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের মূল্যায়ন তুলে ধরেছে এই তিনটি সংস্থা। এর মধ্যে রয়েছে সুশীল সমাজের কাজের পরিধি সংকুচিত হওয়া; নির্বাচনের আগে মানবাধিকার সংগঠন, নাগরিক সংগঠন, সাংবাদিক ও বিরোধীদের লক্ষ্যবস্তু করা এবং র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। আগের নির্বাচনের মতো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সুশীল সমাজের কাজের পরিধি সংকুচিত করেছে এবং রাজনৈতিক দমন ও সহিংসতা বাড়িয়েছে।

সংস্থাগুলোর অভিযোগ, ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলের সদস্যদের ওপর আক্রমণ, ভোটারদের ভয় দেখানো এবং নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পক্ষপাতমূলক আচরণসহ নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটেছিল। ওই নির্বাচনে র‍্যাব ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী ভীতি ছড়ানো এবং ভোট জালিয়াতির কেন্দ্রে ছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, তৃতীয় ইউপিআরে সম্মতি দেওয়া সুপারিশ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ডিএসএ (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন), তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন এবং ঔপনিবেশিক আমলের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের (ওএসএ) অধীনে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি করছে। নির্বাসিত সাংবাদিকদের স্বজনদের হয়রানি; সাংবাদিক ও বিরোধী নেতাদের ওপর সহিংসতার মামলায় দায়মুক্তির সুযোগ প্রদান, ২০২৪ সালের জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে গণনজরদারি ও অনলাইন সেন্সরশিপসংক্রান্ত নতুন আইন প্রণয়ন এবং সংবাদমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ বিস্তৃত করছে।

সংস্থাগুলোর অভিযোগ, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগের মতো একইভাবে বিরোধী সদস্যদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গ্রেপ্তার এবং সহিংসতার লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড-১৯ মহামারির শুরুতে জনস্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করায় ২০২০ সালের মে মাসে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে ঔপনিবেশিক আমলের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ও দণ্ডবিধির অধীনে সাত দিন কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল। ফৌজদারি কার্যবিধিতে শর্তসাপেক্ষ জামিনের কোনো বিধান না থাকলেও পাসপোর্ট জমা দেওয়ার শর্তে তাকে জামিন দেওয়া হয়েছিল।

এতে বলা হয়, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে আদালত ছয় মাসের জন্য অস্থায়ীভাবে রোজিনা ইসলামের পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। এর পর থেকে যখনই তিনি বিদেশ ভ্রমণ করেন, পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার জন্য আদালতের কাছে তাকে অনুরোধ করতে হয়েছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালের জুলাইয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় এবং প্রমাণ না থাকায় মামলা থেকে রোজিনা ইসলামকে অব্যাহতি দিতে বলেছিল। কিন্তু ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে আদালত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। ২০২৩ সালের শুরুর দিকে কর্তৃপক্ষ রোজিনা ইসলামকে বিচারিক হয়রানি করতে থাকে। অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের অধীনে অভিযুক্ত ও দোষী সাব্যস্ত হলে রোজিনা ইসলামের ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড কিংবা সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।

প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে বলপূর্বক গুম, অপহরণ, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যুর সব অভিযোগ তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করা। পরিস্থিতির শিকার, তাঁদের পরিবার ও স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে এই কমিশন গঠন করতে হবে।

মানবাধিকার সংগঠন, নাগরিক সংগঠন ও সাংবাদিকদের সব ধরনের হয়রানি, ভীতি প্রদর্শন ও তাদের ওপর আক্রমণ বন্ধ করা। দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

এ ছাড়া প্রতিবেদনে বিরোধী নেতা ও সমর্থকদের সব ধরনের বেআইনি গ্রেপ্তার, আটক, হয়রানি ও তাদের ওপর আক্রমণ বন্ধ এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিতেরও সুপারিশ করা হয়েছে।