সাউথ এশিয়া পারসপেক্টিভস-এ জন ড্যানিলোয়িচের বিশ্লেষণ

বাংলাদেশ সরকারকে স্বৈরাচারের পথে হাঁটার মূল্য চুকাতে হবে

বাংলাদেশ সরকারকে স্বৈরাচারের পথে হাঁটার মূল্য চুকাতে হবে

যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন যেহেতু তাদের নীতি নির্ধারণী বিষয়গুলো পুর্নবিবেচনা করে থাকে, তাই তাদের উচিত কংগ্রেসের সাথে পরামর্শ করে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিতে প্রভাব খাটাতে সবধরনের সম্ভাব্য পদক্ষেপকে ব্যবহার করা। এমনকি এটাও স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, এভাবে স্বৈরাচারের পথে হাঁটা অব্যাহত রাখলে এর জন্য সত্যিকারের মূল্য চুকাতে হবে।

শুক্রবার বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক ম্যাগাজিন সাউথ এশিয়া পারসপেক্টিভসে এডিটর এ্যাট লার্জ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ডেপুটি মিশন প্রধান জন এফ ড্যানিলোয়িচের লেখা এক বিশ্লেষণে এই মন্তব্য করা হয়েছে।

"টাইম ফর এ ডিফরেন্ট এপ্রোচ ইন বাংলাদেশ" শিরোনামের এই বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সময় এসেছে বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কের বিষয়টি পুর্নবিবেচনা করার। এই সরকারের সঙ্গে হিসাব কষতে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত নতুন নীতি বেছে নেওয়া।  

জাস্ট নিউজ পাঠকদের জন্য বিশ্লেষণটি অনুবাদ করেছেন সাংবাদিক তাশফিন চৌধুরী। বিশ্লেষণটির অনুবাদ নিচে তুলে ধরা হলো:

গণতন্ত্র আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে বিগত এক বছর জুড়ে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টায় কূটনৈতিক দৌড়ঝাপের কোন কমতি রাখেনি যুক্তরাষ্ট্র। এ বছরের মে মাসে ভিসানীতি ঘোষণার বিষয়টি বেশ আলোড়ন তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্রের এই কূটনীতিক পদক্ষেপ সরকারের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেশটির সম্পৃক্ততা বাড়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। 

ঢাকা এবং ওয়াশিংটনে পার্টনারশীপ ডায়লগ, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক ফোরামের ব্যানারে আয়োজিত বিভিন্ন বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা কূটনৈতিক তৎপরতায় সক্রিয় ছিল। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা আলোচনা করেছেন  দুই দেশের সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্র এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজের কৌশল নিয়ে। এসব আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের জোর দেবার বিষয়টি বাংলাদেশকে জানিয়ে দিয়ে বলেছে-- বাংলাদেশে মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জায়গাটি আরও সামনে এগিয়ে নেবার ক্ষেত্র তৈরি করবে। একইসঙ্গে অগ্রসরমান ইন্দো-প্যাসিফিক পার্টনারশীপে বাংলাদেশের অবস্থানকে অধিকতর সুসংহত করবে। মে মাসে ভিসানীতি ঘোষণার পর স্বল্প সংখ্যক বাংলাদেশির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দেশটি। বাংলাদেশে একটি অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে দেশটি যে কৌশল অবলম্বন করেছে সে ক্ষেত্রে এই সীমিত মাত্রার নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ যেন অনেকটা শাসনের চাইতে আদর বেশী হয়ে যাবার মতো ঘটনা।

এটা এখন স্পষ্ট যে--প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকারকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে পরিবেশ তৈরিতে যে তৎপরতা যুক্তরাষ্ট্র চালিয়েছিলো তা ব্যর্থ হয়েছে। বিভিন্ন দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র সংলাপের যে আহবান জানিয়েছিলো বাংলাদেশ সরকার শেষমেশ সেই আহবানকে প্রত্যাখান করেছে। তারা সমঝোতা থেকে দূরে থাকাটাই বেশী করে বেছে নিয়েছে। আর এসব ঘটছে এমন একটা সময়ে যখন অক্টোবরের শেষ দিকে রাজনৈতিক সংঘাত শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করেছে, বিরোধীদলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে জেলে আটকে রাখা হয়েছে এবং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আরেকটি একতরফা নির্বাচন আয়োজনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। নির্বাচনে ভোটার ভোট দিতে যায় কীনা এবং ভোটের ফলাফল কতটা বৈধতা পায়--এই দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে সরকারের সফলতা। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে সরকার পার পেয়ে গিয়েছিল, ১৯৯৬ সালের নির্বাচন ব্যর্থ হয় এবং ১৯৮৮ সালের নির্বাচন আংশিক পার পেয়ে যায়। এখন দেখার বিষয় একই পরিস্থিতির মধ্যে ২০২৪ সালের নির্বাচনকে কতটা সুষ্ঠু বলা যাবে।সংলাপ আর সমঝোতার ব্যর্থ চেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ জনশক্তির সময় অপচয়ের পর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সময় এসেছে বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কের বিষয়টি পুর্নবিবেচনা করার। এই সরকারের সঙ্গে হিসাব কষতে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত নতুন নীতি বেছে নেওয়া। বিশ্বজুড়ে অস্থিরতার সময়টাতে ঢাকার দৃশ্যপটে অনেক কিছু ঘটছে। ঠিক এসময়টাতে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন, ইসরাইলে হামাসের হামলা ও তার প্রতিক্রিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার নিরাপত্তায় চীনের ক্রমবর্ধমান হুমকি মোকাবিলায় তার স্বল্প শক্তি ব্যয় করছে। যুক্তরাষ্ট্র তার সীমান্তের ভিতরে সংকটের মুখে পড়েছে। দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং অর্থনীতির নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। এই পরিস্থিতিতে এ প্রশ্ন উঠাটা যৌক্তক যে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত নয় কী তার জনশক্তিকে পুর্নবিন্যাস করে এমন জায়গায় নিয়োজিত করা যেখানে তারা অধিক ভালো করবে।

বাইডেন প্রশাসন এবং কংগ্রেসকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। প্রথমেই বিষয়টা নিয়ে বোধোদয় হওয়া উচিত স্টেট ডিপার্টমেন্টের। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের উচিত পিটার হাসকে পুনরায় নির্দেশনা দেওয়া এবং সামনে এগুতে হলে কী করা উচিত সে বিষয়ে তাকে পরামর্শ দেওয়া। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এবং তার দল যথেষ্ট চাপের মধ্যে থেকে বিগত এক বছর ভীষণ রকমের কাজ করেছে। কাঙ্খিত নীতির লক্ষ্য বাস্তবায়িত না হবার দায় তাদের ওপর চাপানো উচিত হবেনা।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিরা যেহেতু তাদের নীতি নির্ধারণী বিষয়গুলো পুর্নবিবেচনা করে থাকে, তাই তাদের উচিত কংগ্রেসের সাথে পরামর্শ করে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিতে প্রভাব খাটাতে সবধরনের সম্ভাব্য পদক্ষেপকে ব্যবহার করা। এমনকি এটাও স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, এভাবে স্বৈরাচারের পথে হাঁটা অব্যাহত রাখলে এর জন্য সত্যিকারের মূল্য চুকাতে হবে। শায়েস্তা করার ব্যবস্থা নিতে যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন সহায়তা কর্মসূচি এবং দ্বিপাক্ষিক কর্মসূচি ও জাতিসংঘের বিশেষ সংস্থাগুলোর মতো আরও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যে সহযোগিতা দেওয়া হয় তা বন্ধ করার মতো পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং গোয়েন্দাদেরকে যুক্তরাষ্ট্র যেসব সামরিক সহায়তা দিয়ে থাকে সেগুলোকেও ততক্ষণ পর্যন্ত বন্ধ রাখতে হবে যতক্ষণ এই বাহিনীগুলো সরকারের নির্দেশে বিরোধীদের নিপীড়ন করবে।

সর্বোচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক যোগাযোগ যেমন-- বার্ষিক অংশীদারিত্ব সংলাপ, এছাড়া নিরাপত্তা এবং অর্থনীতি সংক্রান্ত সংলাপও বন্ধ রাখতে হবে। এগুলোর বাইরে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে যুক্তরাষ্ট্রের ভোট দেবার যে ক্ষমতা রয়েছে সেটা দিয়ে এ বিষয়টা নিশ্চিত করতে হবে যে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো যেন বাংলাদেশ সরকারের বাজে আচরণের কারণে তাদের পুরস্কৃত না করে। সর্বশেষ যেটা করতে হবে সেটা হল-- বাংলাদেশে শ্রমিকদের অধিকার ক্রমাগত হুমকির মুখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন এবং কংগ্রেসকে বাণিজ্য নীতির বিষয়টি ভালো করে খতিয়ে দেখতে হবে যাতে করে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেবার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। একইসময়ে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার কর্মী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সরকারের ক্রমাগত নিপীড়ন থেকে সুরক্ষা দিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায় তা নিয়ে ওয়াশিংটনকে কাজ করা উচিত।

বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদ বন্ধে যত ধরনের কৌশলগত পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, এর বাইরে যদি উল্লেখযোগ্য শাস্তিমূলক পদক্ষেপগুলোর কোনো একটি প্রয়োগ করা হয় তাহলে সেটি হবে ভিন্ন রকমের কিছু। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের জন্য চাপ তৈরিতে গৎবাধা যেসব নীতি যুক্তরাষ্ট্র অবলম্বন করেছে তার কারণেই হয়তো এই অবস্থা (কর্তৃত্ববাদ) তৈরি হয়ে থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের এমন নীতির কারণে একটি মিশ্র বার্তা পৌঁছেছে বাংলাদেশের সরকার এবং সব পক্ষের পর্যবেক্ষকদের কাছে। চলমান পরিস্থিতিতে এটা ভাবা বাস্তবসম্মত হবেনা যে, যুক্তরাষ্ট্র তার গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের পথ ছেড়ে ভারত, চীন এবং রাশিয়ার পথে হাঁটবে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিকল্প হল নিজেদের পদক্ষেপগুলোকে পুনরায় সাজানো এবং অন্য গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে তাদের নীতি অনুসরণ করার বিষয়টি বুঝানো।

সময়ের দোলকটি যখন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের দিকে ফিরে আসবে ঠিক তখনি যুক্তরাষ্ট্রের উচিত দেশটির সাফল্যের জন্য  পুরোদস্তুর বিনিয়োগে পুনরায় মন দেওয়া। এর আগে বাংলাদেশের জন্য বাজে কাজে শুধু শুধু টাকা নষ্ট করা বন্ধ করার এখনি উপযুক্ত সময়। এটা মনে মনে ভেবে কোনো লাভ নেই যে দেশটির সঙ্গে শুধু যোগাযোগ রক্ষা করে কাঙ্খিত লক্ষ্যগুলো অর্জন করা যাবে।