আটলান্টিক কাউন্সিলের প্রতিবেদন

বাংলাদেশে রাজনৈতিক অধিকার আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে

বাংলাদেশে রাজনৈতিক অধিকার আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে

স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধির বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশ পিছিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাধীনতা সূচকে ১৬৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১তম এবং সমৃদ্ধি সূচকে ৯৯তম। বাংলাদেশ ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বাধীনতাবঞ্চিত’ এবং সমৃদ্ধির সূচকে ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ নয়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

মঙ্গলবার প্রকাশিত আটলান্টিক কাউন্সিলের বৈশ্বিক প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০০ সালে স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৬। আর সমৃদ্ধি সূচকে ১০৭।

প্রতিবেদনে দুটি পৃথক সূচক রয়েছে—স্বাধীনতা সূচক ও সমৃদ্ধি সূচক। বিশ্বের ১৬৪টি দেশের স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধির ধরন অনুযায়ী ক্রম বা অবস্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। আইন, অর্থনীতি ও রাজনীতিকে বিবেচনায় নিয়ে স্বাধীনতা সূচক এবং আয়, স্বাস্থ্য, অসমতা, পরিবেশ, সংখ্যালঘু অধিকারের মতো বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সমৃদ্ধি সূচকে। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংকসহ ১১টি সংস্থার তথ্যসহ বিভিন্ন পর্যায়ের গবেষণার ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) ও দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন যৌথভাবে আটলান্টিক কাউন্সিলের বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ফলাফল জানাতে মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে এক আলোচনা সভার আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আটলান্টিক কাউন্সিলের ফ্রিডম অ্যান্ড প্রসপারিটি সেন্টারের পরিচালক জোসেফ লেমোইন। তিনি বলেন, উপাত্তগুলোয় দেখা গেছে, যেসব দেশে বেশি স্বাধীনতা রয়েছে, সেসব দেশে অধিকতর সমৃদ্ধিও দেখা যায়। অন্যদিকে যেসব দেশে স্বাধীনতা কম, সেখানে সমৃদ্ধির মাত্রা কম।

জোসেফ লেমোইন আরও বলেন, যেসব দেশ শক্তিশালী আইনি ব্যবস্থাসহ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে উৎসাহিত করে, তারা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আরও বেশি করে স্বাগত জানায়। এসব দেশ কম স্বাধীনতা থাকা দেশগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভুটান (৬১), নেপাল (৮৬), শ্রীলঙ্কা (৯৭), ভারত (১০৪) ও পাকিস্তান (১১৩)। এর মধ্যে ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ভারত ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বাধীন’ এবং পাকিস্তান ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বাধীন নয়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। সার্কভুক্ত দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ আফগানিস্তান রয়েছে তালিকার সর্বশেষ ১৬৪তম অবস্থানে।

সমৃদ্ধির সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে শ্রীলঙ্কা। সূচকে শ্রীলঙ্কার অবস্থান ৭২তম এবং দেশটি ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ’। এই সূচকে বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে ভুটান (১১১), নেপাল (১৩১), ভারত (১৪৬), পাকিস্তান (১৫০) ও আফগানিস্তান (১৬৩)।

অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, প্রতিটি দেশ দুর্নীতি দমন এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার সুরক্ষিত রাখার জন্য লড়াই করছে। কিন্তু মূল বিষয় হলো সমস্যাগুলো এড়িয়ে যাওয়া নয়, সক্রিয়ভাবে স্বীকার ও মোকাবিলা করা জরুরি।

রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার গুরুত্বের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ টানেন। তিনি বলেন, ‘সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে দেখেছি, ক্ষমতাসীন দল নিজেরাই তাদের দলীয় গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ করে দিয়েছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের অংশগ্রহণই বলে দেয় যে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন কতটা জরুরি। আর আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও আমরা এটা দেখতে পাব।’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘পিছিয়ে থাকার রাজনৈতিক প্রবণতা আগামী দিনের বাংলাদেশের বর্ধনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এটি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের আরেকটি রাজনৈতিক বোঝাপড়ার প্রয়োজন।’

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার যে প্রবণতা, সেটা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এটি যেমন বৈশ্বিক একটি প্রবণতা, এটি আঞ্চলিক প্রবণতাও বটে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অধিকার আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও গণতন্ত্র ও সুশাসনের স্বাধীনতায় পিছিয়ে বাংলাদেশ।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরিত করার লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ তার রূপকল্প–২০৪১ নিয়ে এগিয়ে চলেছে। এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অগ্রগতির প্রতি অগ্রাধিকার, বাংলাদেশের জনগণের ক্ষমতায়ন ও গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে মজবুত করার অঙ্গীকারের প্রতিফলন।

সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বিশেষ করে জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন ‘দলীয় আধিপত্য’–ব্যবস্থার প্রবণতাকে শক্তিশালী করেছে, যেখানে আওয়ামী লীগ তার শাসনকালের মেয়াদ বাড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতি স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি দিলেও এ ধরনের ব্যবস্থা সুশাসনের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। এসব ঝুঁকি কমাতে রাজনীতি, সরকার ও অর্থনীতিতে সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা জরুরি।