এমপিও দুর্নীতিতে ৮৬ জন জড়িত

এমপিও দুর্নীতিতে ৮৬ জন জড়িত

ঢাকা, ১৫ ফেব্রুয়ারি (জাস্ট নিউজ) : বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিও কার্যক্রমের অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে শিক্ষা বিভাগের ৮৬ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। চিহ্নিত ব্যক্তিরা এমপিওভুক্ত সংক্রান্ত নথি আটকে রেখে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। অর্থের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে ফাইল নিষ্পত্তির সময় বাড়ানো-কমানো হয়। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈধ অনুমোদন ছাড়াই এমপিও তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার ঘটানাও ঘটাচ্ছে চক্রটি।

দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরে (মাউশি) পাঠানো হয়েছে। ২৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। বৈঠকে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ১৫ ফেব্রুয়ারির (আজ) মধ্যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে জানায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাভেদ আহমেদ বুধবার বলেন, এমপিও কার্যক্রমে দুর্নীতি করার দায়ে কিছু কর্মকর্তার নাম সংবলিত একটি তালিকা আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পেয়েছি। এটি আমাদের জন্য একটি ইনডিকেশন (নির্দেশনা)। আমরা এখন তালিকাটি পর্যালোচনা করছি। অপরাধী কেউই রেহাই পাবে না। অপরাধ অনুযায়ী অভিযুক্তদের ক্লোজড, বদলি, ওএসডি, শোকজসহ নানা ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে চিহ্নিত ওই ৮৬ ব্যক্তি মাউশি এবং মাঠপর্যায়ের বিভিন্ন দফতরে কর্মরত। তাদের মধ্যে মাউশির এক উপপরিচালক ও একজন সহকারী পরিচালক আছেন। এছাড়া ওই তালিকায় আছেন, আঞ্চলিক উপপরিচালক, জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং এসব দফতরের কর্মচারীরা। আরও আছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষকও। চিহ্নিতরা একটি সিন্ডিকেটভুক্ত। তালিকায় স্থান পাওয়া মাউশির সংশ্লিষ্ট শাখায় কর্মরত ‘ম’ আদ্যাক্ষরের উপপরিচালক ও ‘স’ আদ্যাক্ষরের সহকারী পরিচালক এমপিওভুক্তির নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির ‘গডফাদার’ হিসেবে সবার কাছে পরিচিত বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তারা জানান, দুর্নীতিবাজদের রক্ষার্থে এ দু’জন নানাভাবে অপচেষ্টা করে থাকেন।

সূত্র আরো জানায়, চিহ্নিতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ১ ফেব্রুয়ারি মাউশিকে নির্দেশনা পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেটি মাউশি মহাপরিচালকের দফতরে পৌঁছাতে সময় লেগেছে ১২ দিন। ১২ ফেব্রুয়ারি সেই তালিকা পেয়ে ওইদিনই ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন সংস্থাটির মহাপরিচালক। এর পরপরই তালিকার ওপর বিস্তারিত পর্যালোচনা শুরু হয়। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

চিহ্নিতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সংক্রান্ত মাউশিকে দেয়া মন্ত্রণালয়ের অফিস আদেশে বলা হয়, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণে দুর্নীতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গোপনীয় প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লিখিত সুনির্দিষ্ট অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে এ বিভাগকে (মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা) অবহিত করবে।

মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠিতে এমপিও কার্যক্রমে দুর্নীতি বন্ধে দুটি পদক্ষেপও নিতে বলা হয়। এর একটি হচ্ছে, ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এমপিও সফটওয়্যারটি আরো আধুনিক ও যুগোপযোগী করা। অপরটি হল নির্ধারিত সময়ের (২৮ ফেব্রুয়ারি) মধ্যে এমপিওভুক্তির সব কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি আধুনিক মনিটরিং ম্যাকানিজম (তদারকি ব্যবস্থা) তৈরি করা।

মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, কিছু কর্মকর্তার ব্যাপারে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশনা আমরা পেয়েছি। সেটি দ্রুত বাস্তবায়নের কাজ চলছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, যে ৮৬ জনকে এমপিও দুর্নীতির শিরোমণি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় তাদের মধ্যে মাউশির ৯ অঞ্চলের ৭ উপপরিচালকের নাম রয়েছে। এ সাতজনের মধ্যে চারজনের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে সরকারি তদন্ত কমিটি। তালিকাভুক্তদের মধ্যে কয়েকজন আছেন শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার অবশ্য মাউশির নেই।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাভেদ আহমেদ বলেন, আমরা আলাদা করেই অভিযুক্তদের বিষয়টি আমলে নিয়েছি। যাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে, সংশ্লিষ্ট শাখা তাদের ব্যাপারটি পর্যালোচনা করছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রায় এক মাস আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা এসেছে সত্যি, কিন্তু আমরা এমনভাবে ব্যবস্থা নিতে চাই, যাতে কেউ কোনো ফাঁকফোকরে বেরিয়ে যেতে না পারে। অভিযুক্তদের ব্যাপারে আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধান এখন চলছে। সেটির আলোকে ব্যবস্থা না নিলে সরকারের শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির পরিপন্থী হয়ে যেতে পারে। আর তখন অভিযুক্তরা পার পেয়ে যাবে। আমরা সেই সুযোগ দিতে চাই না।

প্রসঙ্গত, তদন্তে দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে এক ফাইলেই ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামের উপপরিচালকের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি অনুমোদিত হয়েছিল। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় আরও চার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও ছয় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাউশিকে বিভাগীয় মামলা দায়েরের নির্দেশও দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর গোপালগঞ্জ, সাতক্ষীরা, নেত্রকোনা ও নোয়াখালীর তৎকালীন শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার ফাইল অনুমোদন করেছিলেন মাউশির বিদায়ী মহাপরিচালক। কিন্তু রহস্যজনক কারণে অদ্যাবধি সেই ফাইল নিষ্পত্তি হয়নি। এখানেই শেষ নয়, চিহ্নিত এবং এমপিও দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পরও ‘জ’ আদ্যাক্ষরের এক উপপরিচালককে এক বছরের বেশি একই পদে বহাল রাখা হয়েছে। এমনকি তাকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এসব ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে অতিরিক্ত সচিব জাভেদ আহমেদ বলেন, অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও যদি দোষীদের বিরুদ্ধে ন্যূনতম ব্যবস্থা না নিয়ে আগের পদে বহাল রাখা হয়, তাহলে সেটা অবাক করার মতোই ঘটনা। তবে এবার আর কেউ রেহাই পাবেন না। শিক্ষামন্ত্রী এ সংক্রান্ত সভার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছেন। সেটি সামনে রেখেই আমরা আগাচ্ছি।

ভুক্তভোগী শিক্ষকরা জানিয়েছেন, শুধু উপপরিচালকরাই নন, এমপিওভুক্তির কাজে জেলা-উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা থেকেই শুরু হয় ঘুষের কারবার। মাধ্যমিক শিক্ষা খাত বিনিয়োগ কর্মসূচির (সেসিপ) অধীনে কিছুদিন আগে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। কিন্তু তাদের অনেকেই দুর্নীতিতে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়েছেন। শিক্ষকরা জানিয়েছেন, মাঠপর্যায়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মাউশি মহাপরিচালকের প্রতিনিধি হিসেবে থাকেন এসব কর্মকর্তা। এ সুযোগে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিয়োগ প্রার্থীদের কাছে বিভিন্ন অঙ্কের ঘুষ নেয়ার অভিযোগও আছে। এমপিও কার্যক্রমে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ খোদ মাউশির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তুলেছেন। সম্প্রতি মাউশিতে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ পরিদর্শনে যান। তখন মূল উপস্থাপনায় মাউশি পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন) অধ্যাপক ড. মো. সেলিম মিয়া মাঠপর্যায়ে এমপিও কার্যক্রমে এমপিও দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন।

এমনকি তৎকালীন মহাপরিচালক ড. এসএম ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, যে ব্যক্তির এমপিও ফাইল একবার নাকচ করা হয়। পরে দেখা যায়, একই কর্মকর্তা সেই ব্যক্তির ফাইল ইতিবাচক মন্তব্য দিয়ে নিষ্পত্তি করেন। এ ধরনের তৎপরতা নিয়েই যত প্রশ্ন। সুত্র: যুগান্তর

(জাস্ট নিউজ/ওটি/১০৪৩ঘ.)