কেন এত ‘ভৌতিক মামলা'?

কেন এত ‘ভৌতিক মামলা'?

ঢাকা, ১০ সেপ্টেম্বর (জাস্ট নিউজ) : নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের জের ধরে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ‘ভুয়া' মামলায় হয়রানির অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ পুলিশের বিরুদ্ধে৷

এমনই একটি মামলার বাদী হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার এসআই মো. নাইউম ঘটনা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারেননি৷ মামলাটি ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের' নির্দেশে করার কথা স্বীকার করেছেন তিনি৷

মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলছেন, সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলন ঘিরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় অর্ধশত মামলা দায়ের করা হয়েছে, যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই৷

এসব মামলা দিয়ে ‘ভয়ের পরিবেশ' সৃষ্টির পাশাপাশি পুলিশের ঘুষ বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি৷

গত ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পরনিরাপদ সড়কের দাবিতে ঢাকার রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীরা৷ পরিবহন খাতের ‘নৈরাজ্যে নাজেহাল' সাধারণ মানুষ তাদের আন্দোলনে সমর্থন দেন৷ এক পর্যায়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন৷

প্রায় সপ্তাহব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের শেষ দিকে বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়৷ ওই আন্দোলনে উসকানির অভিযোগে খ্যাতনামা আলোচিত্রী শহিদুল আলমসহ অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়৷

পরে গ্রেপ্তার করা হয় যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরীকে৷ তাঁকে এখন নানা মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তাঁর সহকর্মীদের৷

ডয়চে ভেলের অনুসন্ধানে এই অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে৷ বুধবার রাতে আটক করে মোজাম্মেলের বিরুদ্ধে মিরপুর থানায় যে চাঁদাবাজির মামলা দেওয়া হয়েছে, সেই মামলার বাদীই তাঁকে চেনেন না৷

‘ভুয়া' মামলার আরেকটি নজির হবিগঞ্জ সদর মডেল থানায় এসআই নাইউমের করা মামলা৷ গত ১২ আগস্ট দায়ের করা ওই মামলার নম্বর ১৪৷ সেই মামলার এজাহারে যে ঘটনার কথা বলা হয়েছে তা ৩০ জুলাইয়ের৷ ঘটনাস্থল হবিগঞ্জ শহরের জে কে অ্যান্ড হাই স্কুলের সামনে ৭০-৮০ জন আসামির সবাই অজ্ঞাত পরিচয়ের৷ অভিযোগ– সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, যানবাহন ও সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিসাধন এবং সরকার উৎখাতের চেষ্টা৷

মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা নাইউম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মামলাটি করা হয়েছে ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে৷ ঘটনার সময় করা হয়নি৷ পরে করা হয়েছে৷''

ওই দিন কী ঘটেছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘ওই সময় তো ছাত্ররা সারা দেশেই আন্দোলন করেছে৷ মিছিল করেছে৷''

জে কে অ্যান্ড হাইস্কুলের সামনে ৩০ জুলাই ঠিক কী ঘটেছিল জানতে চাইলে তিনি সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি৷ তিনি বলেন, ‘‘ছাত্ররা গাড়ি থামিয়েছে , মিছিল করেছে৷ ভিডিও ফুটেজও আছে৷''

এরপর তাঁকে প্রশ্ন করা হয়– যানবাহন ভাংচুর, সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি, সরকার উৎখাতের চেষ্টার অভিযোগ যে করেছেন, এগুলো কি ঘটেছে?

জবাবে এসআই নাইউম বলেন, ‘‘আমার এখন মনে নেই, কাগজ দেখে বলতে হবে৷''

এই মামলার তদন্ত করছেন ওই থানার এস আই নাজমুল ইসলাম৷ তিনি ডয়চে ভেলের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘তখন ছাত্ররা বিভিন্ন জায়গায় মিছিল বের করেছে৷ স্কুলের সামনের ঘটনায় যে মামলা হয়েছে, তার তদন্ত চলছে৷ এখনো বলা যাবে না যে, ঘটনা ঘটেছে নাকি ঘটে নাই৷ তদন্ত চলছে, বাদী বলতে পারবে কী হয়েছে৷''

টট্টগ্রামের সাংবাদিক হুমায়ূন মাসুদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নিরাপদ সড়কের কোনো আন্দোলন চট্টগ্রাম মহানগীর বাইরে হয়নি৷ কিন্তু এর মধ্যে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ৬ আগস্ট সকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ছোট কমলদহ এলাকায় একটি পিকআপ ভ্যান ভাংচুরের অভিযোগ দিয়ে অজ্ঞাত ৭০-৭৫ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছে পুলিশ৷ওই মামলায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে৷ এলাকার মানুষ আতঙ্কে আছেন৷''

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিরসরাই থানার ওসি জাহেদুল কবির ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ভোরবেলার ঘটনা৷ তাই স্থানীয় কেউ দেখেনি৷ আর লোকজনের সামনে সাক্ষী রেখে গাড়ি ভাংচুর করতে হবে, এমনতো কোনো কথা নেই৷ এই মামলায় আমরা এরই মধ্যে তিন জনকে আটক করেছি৷''

এই ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা-বিশৃঙ্খলা নিয়ে ঢাকা মহানগরে ৪৩টিসহ ৯৫টি মামলা দায়েরের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে বাংলাদেশের দৈনিক প্রথম আলো'র এক প্রতিবেদনে৷

‘‘তবে এই হিসাব চূড়ান্ত নয়'' পুলিশ সদর দপ্তরে আরো মামলার তালিকা আসছে,'' বলছেন তারা৷ প্রথম আলো'র প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় নাশকতার অভিযোগ এনে আরো কয়েকটি জেলায় এমন আরও ‘ভুতুড়ে' মামলা করে রেখেছে পুলিশ৷ মাঠপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘ওপরের নির্দেশে' এসব মামলা হয়েছে৷''

এসব মামলা দিয়ে আরো অনেককে হয়রানি করা হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান৷

তিনি বলেন, যাত্রী কল্যাণ সমিতির মোজাম্মেল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলাটি ‘ভুয়া', তাই তাঁকে আটক রাখতে নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করেছে পুলিশ৷

‘‘এখানেও যেসব মামলায় অজ্ঞাত আসামি আছে, সেই মামলাগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে৷'' মোজাম্মেলকে চাঁদাবাজির এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে শনিবার তাঁকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ৷ এরপর সোমবার মোজাম্মেল হককে কাফরুল থানার পুরনো একটি চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আরো ১০ দিনের রিমান্ডের আবদেন জানানো হয় আদালতে৷

নাশকতার ওই মামলা দায়ের করা হয়েছিল ৪ ফেব্রয়ারি৷ মামলার এজাহারে মোজাম্মেল হক চৌধুরীর নাম নেই৷ তবে অজ্ঞাত আসামি আছে৷ আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর এই আবেদনের ওপর শুনানির দিন রেখেছে আদালত৷ ওই দিন মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকেও আদালতে ডাকা হয়েছে৷

অবিলম্বে মোজাম্মেলের মুক্তি দাবি করে যাত্রীকল্যাণ সমিতির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব শামসুদ্দিন চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মোজাম্মেল হক চৌধুরীকে চাঁদাবাজির ভুয়া মামলায় আটকের পর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সারা দেশে বার্তা চাওয়া হয়৷ তাতে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা তো দূরের কথা, একটা জিডিও পাওয়া যায়নি৷ তারপরও তাঁকে আজ (সোমবার) হঠাৎ করে একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হয়৷ আমাদের আইনজীবীকে মামলার কাগজপত্রও দেখানো হয়নি৷''

আইনজীবী তুহিন হাওলাদার বলেন, ‘‘মোজাম্মেল হক চৌধুরীর নাম এজাহারে নেই, তাঁকে সন্দেহজনকভাবে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হয়েছে৷''

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাফরুল থানার ওসি মো. শামীম হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এজাহারে নাম না থাকলেও নাশকতার সঙ্গে তার যোগ আছে৷ আমাদের কাছে তথ্য-প্রমাণ আছে৷ তার ভিত্তিতেই তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হয়েছে৷''

জনগণের যাতে হয়রানি না হয়, সেজন্য এসব ‘ভুয়া' মামলার নিষ্পত্তি চেয়েছেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান৷

তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাম্প্রতিক সময়ে সারা দেশে প্রায় ৪৯টি ভৌতিক মামলা হয়েছে৷ এই ধরনের মামলা নানা কারণে হয়৷ অজ্ঞাত আসামির মামলাগুলোতে ভবিষ্যতে যে কাউকে আসামি দেখিয়ে আটক করা যাবে৷

‘‘সরকার তাই প্রতিপক্ষকে দমন করতে এই মামলাগুলো ব্যবহার করবে বলে আশঙ্কা রয়েছে৷ অন্যদিকে পুলিশ এসব মামলায় ফাঁসিয়ে গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করবে৷'' সূত্র: ডয়চে ভেলে।

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/২৩৫৮ঘ.)