যৌন নিপীড়ন: জোরালো হচ্ছে বিচারের দাবি, অস্থির জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

যৌন নিপীড়ন: জোরালো হচ্ছে বিচারের দাবি, অস্থির জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) যৌন নিপীড়নের তদন্ত ও বিচারের দাবিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। শিক্ষার্থীরা ফাইরুজ অবন্তিকা ও অঙ্কন বিশ্বাসের অপমৃত্যু, শিক্ষার্থীদের ওপর সকল ধরনের যৌন নিপীড়ন, প্রশাসনিক ও একাডেমিক  নিপীড়নের দ্রুত তদন্ত ও বিচারের দাবিতে সরব হয়ে উঠেছেন। তারা একের পর এক শোক মিছিল, মানববন্ধন, মশাল মিছিল, সংবাদ সম্মেলন, স্মারকলিপি প্রদানের মতো কর্মসূচি পালন করছেন।

গত ১৫ই মার্চ  ফাইরুজ অবন্তিকা আইন বিভাগের আম্মান সিদ্দিক নামে তার সহপাঠী ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে দায়ী করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এ ঘটনার পরপরই সুষ্ঠু বিচার দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। আর একে একে বের হতে থাকে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া নানা ধরনের যৌন নিপীড়নের ঘটনা। যা এতদিন লোকান্তরেই ছিল। প্রক্টর অফিসে বিচার দিয়ে বিচার না পাওয়া, মানসিক ভোগান্তির শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে প্রায় অনেক শিক্ষার্থীর মুখে।  এরই মধ্যে শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তোলায় হত্যাসহ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের হুমকি পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম ও টেলিভিশন বিভাগের ছাত্রী কাজী ফারজানা মিম প্রতিকার চেয়ে চ্যান্সেলরের কাছে আবেদন করেছেন।

অভিযোগকারী এই শিক্ষার্থী আবেদনে বলেন, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে বিচার চেয়ে আবেদন করেছিলেন। বিচার এখনো পাননি। উল্টো অভিযুক্ত শিক্ষক ও তার সমর্থনে বিভাগের চেয়ারম্যান তাকে স্নাতক পরীক্ষায় একাধিক বিষয়ে ফেল করিয়েছেন।

অভিযুক্ত শিক্ষকেরা তাকে বহিষ্কারের হুমকি দেন। অন্য শিক্ষার্থীদের থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে মানসিকভাবে নির্যাতন করেন। তারা মৃত্যুর হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। তাকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিচ্ছেন। তাই তিনি বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও  জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম সমাবর্তনের শিক্ষার্থী এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির বিতার্কিক অঙ্কন বিশ্বাসের মৃত্যুর বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে। অবন্তিকা ও অঙ্কনের মৃত্যুর সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে করা সংবাদ সম্মেলনে এ ঘটনাটি উঠে আসে। এসময় শিক্ষার্থীরা জানান, ডিবেটিং ক্লাবের সাবেক সভাপতি শাকিল আহমেদের সঙ্গে অঙ্কনের বিবাহিত জীবন প্রথমে স্বাভাবিক থাকলেও বিভিন্ন স্ক্রিনশট ও ভয়েস এসএমএস’র মাধ্যমে জানা যায় শাকিল দীর্ঘ সময় ধরে অঙ্কনকে ম্যানিপুলেট এবং ব্ল্যাকমেইল করে আসছিল। শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের হদিসও পাওয়া যায়। 

পরবর্তীতে  ২০২২ সালের ২৪শে এপ্রিল শাকিলের বাসায় অঙ্কন অজ্ঞান হয়ে পড়লে শাকিল তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এরপর হাসপাতালগুলো তাকে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে একটি পুলিশ কেইসের আওতায় অঙ্কনকে আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। লাইফ সাপোর্টে থাকাকালীন সময়ে একে একে কার্ডিয়াক এরেস্ট, ব্রেন স্ট্রোক এবং ধীরে ধীরে প্রতিটি অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ অচল হয়ে পড়ে। পারিবারিকভাবে চিকিৎসার জন্য অর্থ সংকট পড়লে বিভাগের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলনের ব্যবস্থা করা হয়। যেখানে শাকিল নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। 
শেষ পর্যন্ত অঙ্কন বিশ্বাস ৮ই মে  রাতে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর দুই ঘণ্টার মধ্যে দ্রুত সময়ের মধ্যে অঙ্কন বিশ্বাসকে দাহ করা হয়। তার অপমৃত্যুর পর শিক্ষার্থীরা শোকসভা ও মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচির মাধ্যমে সুষ্ঠু বিচারের দাবি করে। পুলিশ জানায়, মামলা দায়ের করা হলেই অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু তদন্ত শুরু করা হবে। কিন্তু অঙ্কন বিশ্বাসের পরিবার এই অপমৃত্যুর জন্য কোনো মামলা দায়ের করেনি। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দাবি জানালেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাদী হয়ে মামলা করেনি।

শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়নের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া সোমা বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়নের যতগুলো ঘটনা প্রকাশ্যে আসে তার অনেকগুলোই অপ্রকাশ্য থেকে যায়। আর প্রকাশ্যে যতগুলো আসে সেগুলোরও সুষ্ঠু বিচার হয় না। এতে করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেই চলছে। এ বিচার না হওয়ায় ভুক্তভোগীকে একটা মানসিক ট্রমার মধ্যে দিন পার করতে হয়। একটা পর্যায়ে সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নিয়ে থাকে। 

সার্বিক বিষয়ে  বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. সাদেকা হালিম বলেন,  ইতিমধ্যে আমরা যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছি।  যৌন নিপীড়নের বিষয়ে পূর্বে যতগুলো অভিযোগ পড়েছে তা খুব দ্রুত তদন্ত করে সেগুলোর নিষ্পত্তি করা হবে।  বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসের যৌন নিপীড়ন বক্সগুলো পরিষ্কার করে নতুন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বক্সগুলোর তালার চাবি আমার কাছে থাকবে। আমি নিজে বক্সগুলো খুলে চেক করবো প্রতিনিয়ত। আমি সবসময় মেয়েদের জন্য দাঁড়াবো।

উল্লেখ্য, আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় আটক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকীকে রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।-মানবজমিন