অন্যের দুর্নীতির দায় সরকারি ব্যাংকের ঘাড়ে

অন্যের দুর্নীতির দায় সরকারি ব্যাংকের ঘাড়ে

প্রায় বছর তিনেক ধরে ধুঁকছে ব্যাংকবহির্ভূত পাঁচ আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরাই ঋণের নামে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এখন জমানো অর্থ ফেরত পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন আমানতকারীরা। মালিকদের দুর্নীতির কারণে রুগ্ন ওইসব প্রতিষ্ঠানেও অর্থ জমা রেখেছে সরকারি ৫ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর প্রায় এক হাজার কোটি টাকা আটকে গেছে। সেই টাকা উদ্ধারে কোনো আশা দেখছে না ব্যাংকগুলো।

সংশ্লিষ্টরা জানান, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কর্মকর্তারা ওই সব প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখছেন। এভাবে টাকা আটকে গেলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না ব্যাংক। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে পিপলস লিজিং, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, ফার্স্ট ফাইন্যান্স ও এফএএস ফাইন্যান্স। এখানে আমানত রেখে ও কলমানিতে টাকা দিয়ে তা আর আদায় করতে পারছে না সরকারি পাঁচ ব্যাংক। কিন্তু এ টাকা খেলাপি হিসেবে দেখানোর নিয়ম নেই।

জনগণের আমানতের এ টাকা ছাড়াই সরকারি ব্যাংকগুলো যে ঋণ বিতরণ করেছে, তার ৩১ দশমিক ৫২ শতাংশে খেলাপি হয়ে গেছে। সরকারি ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণ ৫৪ হাজার ৯২২ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের অর্ধেকের বেশি।

দেশের সবচেয়ে বড় সোনালী ব্যাংক ১০০ কোটি টাকা আমানত রেখে আর ফেরত পাচ্ছে না। ওই টাকা ফেরত চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে অনুরোধ পাঠানো হয়। বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া পিপলস লিজিংয়ের ৪৫ কোটি টাকা আমানত রেখে বিপাকে পড়েছে ব্যাংকটি। এ ছাড়া বিআইএফসিতে ২০ কোটি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে ১৭ কোটি, ফার্স্ট ফাইন্যান্সে ১২ কোটি এবং এফএএস ফাইন্যান্সে ৭ কোটি টাকা আমানত রেখে ফেরত পাচ্ছে না সোনালী ব্যাংক।

রুগ্ণ চার আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি ৪ হাজার কোটি টাকা রেখেছে খেলাপি ঋণের শীর্ষে থাকা জনতা ব্যাংক। পিপলস লিজিংয়ে ৫৫ কোটি, ইন্টারন্যাশাল লিজিংয়ে ৪৭ কোটি, ফার্স্ট ফাইন্যান্সে ২৮ কোটি ও এফএএস ফাইন্যান্সে ১০ কোটি টাকা আমানত রাখে জনতা ব্যাংক।

১৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রায় হাজার কোটি টাকা আমানত রেখে বিপাকে পড়েছে রূপালী ব্যাংক। একটি বাদে ১২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে সর্বনি¤œ দুই থেকে তেরোবার পর্যন্ত টাকা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু টাকা ফেরত পায়নি ব্যাংকটি। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিষয়টি জানিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বন্ধ হতে যাওয়া পিপলস লিজিংয়ে ১৪৩ কোটি টাকা রেখেছে। এখন প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো আশা নেই। বিআইএফসির কাছে ৬২ কোটি টাকা আদায়ে তেরোবার চিঠি দিয়েছে ব্যাংকটি।

ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের রাখা ১১৯ কোটি টাকা আদায়ে চিঠি দিয়েছে পাঁচবার। এফএএস ফাইন্যান্সে ১১২ কোটি টাকা আদায়ে দ্বিতীয়বারের মতো তাগাদা দেওয়া হয়েছে। ফার্স্ট ফাইন্যান্সের কাছে ৫১ কোটি টাকা আদায়ে চিঠি দিয়েছে ছয়বার। এর বাইরে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে ৪৩ কোটি, ফারইস্ট ফাইন্যান্সে ৪২ কোটি, রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে ২২৯ কোটি, হজ ফাইন্যান্সে ১ কোটি, ফনিক্স ফাইন্যান্সে ২২ কোটি, ইউনিয়ন ক্যাপিটালে ২২ কোটি এবং আইসিবি ইসলামী ব্যাংকে ২০ কোটি টাকা আমানত রেখে তা ফেরত পাওয়ার চেষ্টায় রয়েছে রূপালী ব্যাংক।

রুগ্ণ ৫ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ২১৬ কোটি টাকা রেখে আটকে গেছে অগ্রণী ব্যাংক। ব্যাংকটি ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে ৫০ কোটি, পিপলসে ৬১ কোটি, এফএএসে ৪২ কোটি, ফার্স্টে ৩৯ কোটি এবং বিআইএফসিতে ২৪ কোটি টাকা আমানত রেখে ফেরত পাচ্ছে না। এসব প্রতিষ্ঠানে আমানত রেখে ফেরত না পেলেও কলমানিতে নতুন করে টাকা দেয় অগ্রণী ব্যাংক। ওই টাকাও আদায় হয়নি। পাওনা টাকার মধ্যে পিপলস লিজিংকে ২৪ কোটি, এফএএসে ৭ কোটি, ফার্স্টকে ৬ কোটি এবং বিআইএফসিকে কলমানিতে ৪ কোটি টাকা ধার দেয় অগ্রণী ব্যাংক।

খেলাপিতে ধুঁকতে থাকা বিডিবিএলেরও ১০০ কোটি টাকা আটকে আলোচিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। পিপলসে ৩০ কোটি, বিআইএফসিতে ২২ কোটি, এফএএসে ১৬ কোটি, ফার্স্টে ১৫ কোটি এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে ৩ কোটি টাকা আটকে গেছে ব্যাংকটির।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি ব্যাংকগুলোতে আমানত সবসময় অনেক বেশি থাকে। ঋণ বিতরণ কম করায় তাদের কাছে অলস টাকাও বেশি থাকে। টাকা নেওয়ার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ব্যাংক ধরনা দেয় সরকারি ব্যাংকগুলোয়। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে অনৈতিক সুবিধা ভোগ করে যেনতেন প্রতিষ্ঠানে টাকা জমা রাখেন। পরে ওই টাকা আর ফেরত পাওয়া যায়নি।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, টাকা রাখার জন্য ব্যাংকের নীতিমালা রয়েছে। যেহেতু আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্স আছে, তাই তারা টাকা পাওয়ার যোগ্য। দুর্বল প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখার বিষয়ে কয়েকটি সরকারি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, নিজস্ব মাপকাঠির ভিত্তিতে কোথায় টাকা রাখা যাবে সেটি নির্ধারণ করা হয়। কোন কোন প্রতিষ্ঠান একেবারেই দুর্বল, তার তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকটগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘রেড জোনে’ অন্তর্ভুক্ত করে থাকে। কিন্তু সেটি আমাদের দেওয়া হয় না। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানলেও আমরা সহজে বুঝতে পারিনি কাদের অবস্থা একেবারেই শোচনীয়।

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উভয় সংকটে রয়েছে। তাদের দেওয়া লাইসেন্সে ব্যবসা করছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি কোনো তালিকা দেয় এগুলোর অবস্থা খারাপ, তা হলে সেসব ব্যাংক থেকে সবাই জমানো অর্থ ফেরত নেবে এবং নতুন করে টাকা রাখবে না। প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যাবে। তবে এ আশঙ্কা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কেননা সব জানার পরও জনগণের টাকা দুর্নীতগ্রস্ত মালিকরা আত্মসাৎ করার সুযোগ পাবেন- এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা হতে পারেন না।