বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ৮৬ শতাংশই ব্যাংকঋণ সঙ্কটে ব্যাংক খাত

বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ৮৬ শতাংশই ব্যাংকঋণ সঙ্কটে ব্যাংক খাত

বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে ব্যাংকঋণ। অর্থাৎ ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে ২৮ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক থেকেই নেয়া হয়েছে ২৪ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা, যা মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রায় ৮৬ শতাংশ। বাকি মাত্র ১৪ শতাংশ হলো সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য ঋণ। অথচ গত বছরের একই সময়ে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংকঋণ ছিল মাত্র ৪০ শতাংশ। আর ৬০ শতাংশ ছিল ব্যাংকবহির্ভূত খাত অর্থাৎ সঞ্চয়পত্রসহ অন্যান্য খাত। প্রধান প্রধান অর্থনৈতিক সূচক নিয়ে তৈরি বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ মাসিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য উঠে এসেছে।

ওই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দুই মাসে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে প্রকৃত বিদেশী ঋণ এসেছে ৪ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে এসেছিল ৪ হাজার ১২৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে বিদেশী ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ। কিন্তু সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ ব্যাপক হারে কমে গেছে। যেমন গত বছরের দুই মাসে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ এসেছিল ৯ হাজার ৯২ কোটি টাকা। আর বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট ঋণ ছিল ১৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত বছরের আলোচ্য সময়ে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে সঞ্চয়পত্রের অবদান ছিল প্রায় ৬০ শতাংশ। কিন্তু চলতি অর্থবছরের আলোচ্য সময়ে তা উল্টো হয়েছে। বর্তমান সময়ে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে সঞ্চয়পত্রের অবদান মাত্র ১৪ শতাংশ।

ব্যাংকিং খাত থেকে অস্বাভাবিক ঋণ নেয়ায় বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে টান ধরেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত আগস্ট থেকে বেসরকারি খাতের ঋণের স্থিতি ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা থেকে কমে নেমেছে ৯৭ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগস্ট শেষে বেসরকারি খাতের ঋণের স্থিতি কমেছে ২১ হাজার কোটি টাকা। ঋণের স্থিতি কমে যাওয়ার পাশাপাশি বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধিও কমে গেছে। যেমনÑ গত বছরের আগস্ট শেষে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। চলতি বছরের একই সময়ে তা কমে নেমেছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, সরকার ব্যাংক খাত থেকে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে বেশি ঋণ নিচ্ছে। অপর দিকে আমানতের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বাড়ছে না। অপর দিকে ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুযোগ দেয়ায় ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায়ও কমে গেছে। সবমিলে ব্যাংকগুলোর নগদ তহবিলে টান পড়েছে। ফলে যেটুকু তহবিল পাওয়া যাচ্ছে তার একটি বড় অংশ সরকারকে বাধ্যতামূলকভাবে ঋণের জোগান দিতে হচ্ছে। এতে বেসরকারি খাতে আর আগের মতো ঋণ বিতরণ করা যাচ্ছে না। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধিতে।

এ দিকে ব্যাংকগুলোকে সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ বিতরণের জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাত থেকে ১০ শতাংশের নিচে আমানত পাচ্ছে না। ফলে ব্যাংকগুলো পড়েছে উভয় সঙ্কটে। এক দিকে এক অঙ্কে ঋণ বিতরণের চাপ, অপর দিকে তহবিল সঙ্কট। পাশাপাশি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাওয়া। সবমিলেই প্রায় প্রতিটি ব্যাংকেই এখন এক ধরনের অস্থিরতা শুরু হয়েছে। এতে ব্যাংকের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে, কিন্তু ব্যয় কমছে না। একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান জানান, ছোটখাটো একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেছনে মাসিক বেতন-ভাতা হিসেবে ব্যয় হয় প্রায় ৫ কোটি টাকা। ভবন ভাড়া, নানা ইউটিলিটি বিলতো রয়েছেই। সবমিলেই ব্যাংকগুলোতেই এখন আয়-ব্যয়ের সমন্বয় করা যাচ্ছে না। অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে ব্যাংকগুলো মুনাফা দেখাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সঠিকভাবে তদারকি করলে বছর শেষে বেশির ভাগ ব্যাংকেরই লোকসান গুনতে হতো। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড় দেয়ায় মুনাফা না হলেও ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে আয় দেখানো হচ্ছে। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ব্যাংকিং খাতের জন্য সামনে দুর্দিন আসবে বলে তিনি মনে করেন।

এমজে/