কাশ্মীরে দখলদারিত্বের প্রশ্ন উপেক্ষা করেই ভারতীয় যুদ্ধের দামামা

কাশ্মীরে দখলদারিত্বের প্রশ্ন উপেক্ষা করেই ভারতীয় যুদ্ধের দামামা

আদিল আহমেদ ধর নামের বছর কুড়ির এক তরুণ গত বৃহস্পতিবার কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আধাসামরিক বাহিনীর ওপর আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে ৪৫ জওয়ানকে হত্যা করেন।

১৯৮৮ সালে ভূস্বর্গ নামে পরিচিত হিমালয় অঞ্চলটিতে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হলে ভারতের এটাই সবচেয়ে বড় ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা। ইতিমধ্যে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। আবার একইসময়ে ভারতজুড়ে কাশ্মীরিদের ওপর নিপীড়নও বাড়ছে।

ভারতে উগ্র দেশপ্রেমের জোয়ারে কাশ্মীরের সহিংসতার মূল কারণটি পুরোপুরি পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর সেটা হচ্ছে উপত্যকাটিতে ভারতীয় দখলদারিত্ব।

২০১৮ সালের মার্চে জইশ-ই-মোহাম্মদের (জেইএম) অধীনে বিদ্রোহীদের দলে ভেড়েন আদিল আহমেদ ধর। পাকিস্তানভিত্তিক মাসুদ আজহারি সংগঠনটির নেতা।

আদিল হলেন কাশ্মীর ইনতেফাদার সময়ে বেড়ে ওঠা একটি প্রজন্মের সদস্য। ২০০৮ সাল থেকে শুরু হওয়া কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য গণআন্দোলনই হচ্ছে এই ইনতেফাদা। যেটা ভারত দমন করে দিয়েছে।

পুলওয়ামায় হামলার পর পরই পাকিস্তানের ওপর ভারত দায় চাপালে প্রতিবেশী দেশটি তা অস্বীকার করে। তবে সব শ্রেণিপেশার ভারতীয়রা এ হামলার নিন্দায় শামিল হয়েছেন। রাজনীতিবিদ, সেলিব্রেটি, সাংবাদিক ও সাধারণ গণমানুষ- সবাই সরব প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

তারা হামলার প্রতিশোধের কথা বলছেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দিচ্ছেন। গণহত্যাসহ কাশ্মীরিদের শাস্তি দাবি করছেন।

জওয়ানদের গাড়িবহরে হামলার পর বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসরত কাশ্মীরি মুসলমান ও শিক্ষার্থীরা সংঘবদ্ধ লোকজনের হামলার শিকার হচ্ছেন। ভারতের বিভিন্ন কলেজে অধ্যায়নরত কাশ্মীরি শিক্ষার্থীদের বেধড়ক মারধর করা হয়েছে।

তাদের জোর করে বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। আতঙ্কে কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে গেছেন।

বাড়িওয়ালারা নিজেদের বাড়ি থেকে ভাড়াটে কাশ্মীরিদের বের করে দিয়েছেন। হামলাকারীরা ব্যবসায়ীদের দোকানপাট তছনছ করে দিয়েছেন।

হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ জম্মুতে উগ্র হিন্দুসভার লোকজন কাশ্মীরিদের বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করলে সেখানে কারফিউ জারি করা হয়েছে।

সব মিলিয়ে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, অধিকাংশ ভারতীয় লোকজন কাশ্মীরিদের নিজেদের লোক বলে মনে করেন না। কেবল তাদের ভূমির ওপর দাবি প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন তারা। যদিও সেই দাবির কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।

একটি বিভৎস হামলা থেকে সুবিধা আদায়ের চেষ্টায় বারখা দত্তের মতো ভারতীয় রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকররা খুবই নোংরাভাবে কাশ্মীরের সরেজমিনের বাস্তবতাকে ভুলভাবে তুলে ধরে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। ইসলামি মৌলবাদের একটা স্বাভাবিক দৃশ্যপট এঁকে যাচ্ছেন।

কাজেই কাশ্মীরে যা ঘটছে, তা নিয়ে সামান্য নজর রাখলেই ভারতীয় যুদ্ধংদেহী নীতি ও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদের বাড়বাড়ন্ত অবস্থা সহজেই টের পাওয়া যাবে। যা ভারতকে ভালোভাবেই জাপটে ধরেছে।

ইসলামি মৌলবাদের মতো আলঙ্কারিক পরিভাষা সেখানে কাঠামোগত সহিংসতার বিবরণ প্রকাশে ব্যর্থ হয়েছে। এ সহিংসতা ভারতীয় সামরিক দখলদারিত্বের অধীনে কাশ্মীরিদের নৈমিত্তিক জীবনের অংশ হয়ে গেছে।

কাশ্মীরকে নিজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ভারত জোরালো দাবি করে আসলেও উপত্যকাটি আসলে একটি অধিকৃত অঞ্চল। ১৯৪৭ সাল থেকে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এ নিয়ে দ্বন্দ্ব লেগে আছে।

হাতে গোনা কয়েকশ বিদ্রোহীর হাত থেকে রেহাই পেতে কাশ্মীরে সাত লাখের বেশি ভারতীয় সেনা মোতায়েন করা আছে। প্রতিবেশী পাকিস্তান বিদ্রোহীদের ঠাঁই দিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ ভারতের।

এই বিশাল সংখ্যক সেনাবাহিনী দিয়ে ভূস্বর্গের লোকজনকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। যদিও ভারত এমন দাবি অস্বীকার করছে।

কাশ্মীরিরা স্বাধীনভাবেই থাকতে পছন্দ করেন। তবে তাদের কেউ কেউ পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাওয়ার কথাও বলছেন।

ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সাল থেকে অহিংস আন্দোলন করে আসছে কাশ্মীরবাসী। কিন্তু ১৯৮৮ সাল থেকে সেখানে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবিতে সশস্ত্র বিদ্রোহী শুরু হয়।

এখন পর্যন্ত ৮০ হাজার কাশ্মীরি হত্যার শিকার হয়েছেন। নিখোঁজ রয়েছেন আরও আট হাজার। গ্রেফতার, নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বেশুমার।

যদি উপত্যকাটির লোকজনকে কেউ জিজ্ঞেস করেন, তারা বলবে, কাশ্মীরের বেসামরিক লোকজনের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধ করছে।

২০০৮ সাল থেকে বিক্ষোভকারীদের ওপর নিয়মিতভাবে তাজা ও ছররা গুলি ছুড়ে আসছে সেনারা। এভাবে কাশ্মীরিরা এক ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে শুরু করেন। পুরো উপত্যকাটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে।

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, কাশ্মীরে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ভারতীয় রাষ্ট্রের সহিংসতার ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কখনোই নিন্দা করেনি। আর এভাবেই প্রদেশটিতে কাঠামোগত সহিংস পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সেখানে যা ঘটছে, তা মুছে ফেলা হচ্ছে।

পুলওয়ামায় মর্মান্তিক হামলাটি ঘটেছে ভারতীয় সশস্ত্র সেনাদের বিরুদ্ধে। কোনো বেসামরিক লোক তাতে আক্রান্ত হননি। তারা টার্গেটও ছিলেন না। কিন্তু বেসামরিক কাশ্মীরি ও সশস্ত্র বিদ্রোহীদের আলাদা করে দেখে না ভারত।

বিক্ষোভকরীদের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রকাশ্য কর্মী হিসেবে বিবেচনা করে ভারতীয় জেনারেল ও রাজনীতিবিদরা। যে কারণে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের ওপর যেভাবে আচরণ করা হচ্ছে, নিরপরাধ বিক্ষোভকারীদের ওপরও একই ধরনের আচরণ করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে।

কেবল গত তিন বছরে হাজার হাজার বেসামরিক কাশ্মীরি ও বিদ্রোহী নিহত হয়েছেন। কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে নিপীড়নের বেলায় ভারত সবসময় আন্তর্জাতিক রীতিনীতি তাচ্ছিল্য করে আসছে।

বিক্ষোভকারীদের কোমরের ওপর টার্গেট করাসহ হাসপাতাল ও অ্যাম্বুলেন্সে হামলা চালানো হচ্ছে। এ ধরনের আচরণ যুদ্ধাপরাধের শামিল।

এছাড়া মানুষকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা যেমন হচ্ছে, তেমন দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিকরাও ভারতীয় বাহিনীর হামলা থেকে ছাড় পাচ্ছেন না। কাশ্মীরে বাকস্বাধীনতা ও অবাধ চলাচলেও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

ভারতে যেভাবে আইনবহির্ভূত সংঘবদ্ধ লোকজনের হামলার প্রবণতা চলছে, কাশ্মীরে কখনো তার প্রতিরূপ দেখা যায় না।

ভারতীয় বাহিনী গত তিন দশক ধরে কাশ্মীরের বেসামরিক লোকজনের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে আসছে। কিন্তু কাশ্মীরি লোকজন কখনো ভারতীয় বেসামরিক লোকজন ও পর্যটকদের হামলা কিংবা তাদের প্রতি বিরূপ আচরণ করেননি।

এক বিবৃতিতে কাশ্মীরের যৌথ প্রতিরোধ নেতৃবৃন্দ বলছেন, কাশ্মীরের লোকজন ও নেতৃবৃন্দ এ উপত্যকায় ঘটা প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানাচ্ছে।

পাকিস্তান হামলার ধকল সহ্য করছে না। নিরপরাধ কাশ্মীরি লোকজনও নির্যাতনের শিকার।

এ যুদ্ধাবস্থার মধ্যে কাশ্মীরের কারও কারও প্রশ্ন, ঠিক এসময়ে কেনো হামলাটি ঘটল। ভারতের জাতীয় নির্বাচনের মাত্র হাতে গোনা কয়েক সপ্তাহ বাকি আছে। কেন ভারতের বিশাল গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক এ হামলাকে ঠেকিয়ে দিতে পারল না।

এটা স্পষ্ট যে ভারতীয়দের কর্মসংস্থানে ব্যর্থ এবং বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পর জনসমর্থন আদায়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখন হামলাকে ভালোভাবেই পুঁজি করবেন।

আসল কথা হচ্ছে, সবসময়ই সংকট মুহূর্তে ভারত রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রদর্শনের একটি জায়গা হচ্ছে কাশ্মীর।

কাজেই এখন কাশ্মীর সংকটের মূলকারণ ভারতীয় দখলদারিত্ব ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার হরণ নিয়ে কথা বলার সময় এখনই। এরপরই নিহত কাশ্মীরি ও ভারতীয়দের সংখ্যার হিসাব করতে হবে।

এমজে/