ট্রাম্পের নির্দেশেই ইরানি জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা

ট্রাম্পের নির্দেশেই ইরানি জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা

ইরানের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা কাসেম সোলেমানি শুক্রবার ভোরে মার্কিন বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন। সোলেমানিকে হত্যা করা হয়েছে জানিয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন বলেছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশেই বাগদাদে সোলেমানির গাড়িবহর লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্র বিমান হামলা চালায়।

 

এতে সোলেমানিসহ সাতজন নিহত হয়েছে। এদিকে সোলেমানি হত্যার পর ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি বলেছেন, এ হামলার পেছনে থাকা ‘অপরাধীদের বিরুদ্ধে চরম প্রতিশোধ’ নেয়া হবে।

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানায়, ইরাকের রাজধানী বাগদাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মার্কিন হামলায় ইরানের রেভুলিউশনারি গার্ডসের অভিজাত বাহিনী কুদস ফোর্সের প্রধান মেজর জেনারেল কাসেম সোলেমানিসহ সাতজন নিহত হয়েছেন। ইরাকের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানায়, সোলেমানির সঙ্গে ইরাকি মিলিশিয়া কমান্ডার আবু মাহদি আল-মুহান্দিসও নিহত হয়েছেন। খবর বিবিসি, এপি ও রয়টার্সের।

পেন্টাগনের বিবৃতিতে বলা হয়, বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের লোকজনকে রক্ষায় প্রেসিডেন্টের নির্দেশনায় ইরাকে সোলেমানিকে হত্যা করেছে মার্কিন সেনাবাহিনী। পেন্টাগনের ভাষ্য, ভবিষ্যতে ইরানের হামলার পরিকল্পনা নস্যাৎ করতে জেনারেল সোলেমানিকে হত্যা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের যে কোনো স্থানে তার লোকজন ও স্বার্থ রক্ষায় সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া অব্যাহত রাখবে।

ইরাকে মার্কিন দূতাবাসে ইরানঘনিষ্ঠ মিলিশিয়া বাহিনীর নেতৃত্বাধীন হামলা-ভাংচুরের কয়েকদিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সোলেমানিকে লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে। পেন্টাগনের দাবি, বাগদাদের মার্কিন দূতাবাসে হামলার অনুমোদন দিয়েছিলেন জেনারেল সোলেমানি। ইরানের ভবিষ্যৎ আক্রমণের পরিকল্পনা বানচাল করতে এ হামলা চালানো হয়। সারা বিশ্বে মার্কিন নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় পদক্ষেপ নেয়া অব্যাহত রাখবে যুক্তরাষ্ট্র।

সোলেমানির নিহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের পতাকার একটি ছবি টুইট করেছেন। তবে এ হামলার সমালোচনা করে মার্কিন ডেমোক্র্যাটিক দলের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন টুইটারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘খড়কুটোর বাক্সে ট্রাম্প ডায়নামাইট ছুড়ে ফেলেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের একটি সংঘাতের মুখোমুখি পড়তে পারি আমরা। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক পরিচালক জেমস ক্ল্যাপার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এ পদক্ষেপের ফলে ওই অঞ্চলে থাকা আমেরিকানরা হুমকির মুখে পড়বেন।

ইরানি জেনারেল সোলেমানিকে হত্যায় মার্কিন সেনা অভিযানের সমালোচনা করেছে বিশ্বের পরাশক্তিরা। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, সোলেমানিকে হত্যার উদ্দেশ্যে মার্কিন অভিযানকে তারা অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ হিসেবে মনে করে। এ রাজনৈতিক অস্থির পরিস্থিতি শান্ত করতে সব পক্ষকে ‘বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে’ সংযম ধরে রাখার আহ্বান জানিয়েছে চীন। সংবাদ সম্মেলনে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গেং শুয়াং বলেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সব সময়ই জোর প্রয়োগের বিরোধী চীন।

জেনারেল সোলেমানি হত্যার ‘চরম প্রতিশোধ’ নেয়ার ঘোষণা ইরানের : সোলেমানি নিহত হওয়ার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে ইরানে। তার মৃত্যুতে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে ইরান। এ হত্যার ‘চরম প্রতিশোধ’ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ আল খামেনি। তিনি বলেন, এ হামলার নেপথ্যে থাকা ‘অপরাধীদের বিরুদ্ধে চরম প্রতিশোধ’ নেয়া হবে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ এ হত্যাকাণ্ডকে ‘মারাত্মক বিপজ্জনক’ ও ‘বোকামি’ বলে বর্ণনা করেছেন।

তিনি বলেন, এটি ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী পদক্ষেপ।’ যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের হঠকারিতার ফল ভোগ করবে বলে তিনি টুইট করেন। ইরানের রেভুলিউশনারি গার্ডস কর্পোরেশনের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রামেজান শরীফ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল কুদস ফোর্সের কমান্ডারকে হত্যার ‘কঠোর প্রতিক্রিয়া’ ভোগ করবে। টেলিভিশনে প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেইয়েদ মোহাম্মদ মারান্দি বলেন, প্রতিশোধের সময় আসন্ন। সোলেমানি নিহত হওয়ার জেরে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে গেছে।

ইরান সরকারের এক মুখপাত্র বলেছেন, এ ‘অপরাধী কার্যক্রম’- এর বিষয়ে আলোচনা করতে দেশটির শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তারা বৈঠকে বসেছেন।

মেজর জেনারেল কাসেম সোলেমানি : ১৯৯৮ সাল থেকে মেজর জেনারেল কাসেম সোলেমানি ইরানের কুদস ফোর্সের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। ইরান রেভুলিউশনারি গার্ডসের অভিজাত বাহিনী দেশের বাইরে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে থাকে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার আল আসাদের ইরান সমর্থিত সরকারকে মদদ দেয়া এবং ইরাকে ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সোলেমানি।

১৯৮০-র দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধে দায়িত্ব পালন করার সময় তিনি প্রথম পরিচিতি লাভ করেন। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক দীর্ঘসময় ধরে শত্রুভাবাপন্ন হলেও ইরাকে আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আদর্শগত দিক বিবেচনায় পরোক্ষভাবে একে অপরকে সহায়তা করেছিল তারা। দুই বৈরীভাবাপন্ন দেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ইরানের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করার ক্ষেত্রেও কয়েক বছরে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

জেনারেল সোলেমানিকে বর্তমান সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত সমরবিদ মনে করা হচ্ছিল। তিনি মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো সমরজগতের বিশেষ নজরে ছিলেন। সিআইএ-মোশাদের হিটলিস্টে সোলেমানি ছিলেন বলে বিভিন্ন খবরে জানা গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফরেন পলিসি’ জার্নাল ২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন পেশার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একটি তালিকা করে। এ তালিকার সমর খাতে জেনারেল সোলেমানিকে প্রথম স্থানে রাখা হয়। মার্কিন প্রশাসন তাকে একজন ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে বিবেচনা করে আসছিল। তিনি মার্কিন সরকারের কালো তালিকায় ছিলেন। তিনি ইসরাইল ও সৌদি আরবেরও মাথা ব্যথার কারণ ছিলেন।

সোলেমানি ইরানে হাজী কাসেম নামে পরিচিত। তিনি রেভুলিউশনারি গার্ডের একজন কমান্ডার হলেও অলিখিতভাবে তার পদমর্যাদা দেশটির যে কোনো সামরিক কর্মকর্তার ওপর ছিল। সোলাইমানি তার বাহিনীর পুরো কাজকর্মের জন্য দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির কাছে জবাবদিহি করতেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি জেনারেল সোলাইমানিকে ‘অর্ডার অব জুলফিকার’ পদক দেন। বিপ্লব-উত্তর ইরানে এ খেতাব তিনিই প্রথম পান।