যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্টের টেবিল ১৪০ বছরের পুরনো

যুক্তরাষ্ট্র  প্রেসিডেন্টের টেবিল ১৪০ বছরের পুরনো

যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন হোয়াইট হাউসের একটা ট্রেডিশন বা ঐতিহ্য রয়েছে। আর সেটা হচ্ছে, তল্পিতল্পা নিয়ে ওঠার আগেই যতটা সম্ভব এর সাজসজ্জা করে নেন নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবার। এই সাজসজ্জায় কেউ লাখ লাখ ডলার খরচ করেন। আবার কেউ ছোটখাটো কিছু পরিবর্তনও আনেন। কিন্তু ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী প্রেসিডেন্টরা যা কিছুই করুন না কেন, হোয়াইট হাউসের একটি মাত্র জিনিসে কখনই এদিক-সেদিক হয় না। সেটা হচ্ছে প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ওভাল অফিসের সাদামাটা একটা টেবিল ‘রেজল্যুট ডেস্ক’, যা ১৮৮০ সালে ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়ায় পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে হোয়াইট হাউসে আসে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ প্রেসিডেন্টই ১৪০ বছর ধরে ওক কাঠের তৈরি বিশাল এই টেবিলটা ব্যবহার করেছেন। প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির সময়ে দেশজুড়ে ব্যাপক পরিচিতি পায় এটা। টেবিলটি সামনে করে বসে আছেন প্রেসিডেন্ট কেনেডি। আর তার ছোট্ট দুই ছেলে-মেয়ে এর নিচে লুকোচুরি খেলছে- এমন একটা ছবি মার্কিনিদের নজর কেড়েছিল। টেবিলটি আজ মার্কিন রাজনৈতিক সংস্কৃতির ঐতিহাসিক অনুষঙ্গও। কিন্তু এর রয়েছে এক অবাক করা অতীতও।

ব্রিটিশ জাহাজের কাঠ থেকে তৈরি
টেবিলের ইতিহাস একটি ব্রিটিশ নৌজাহাজের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। ওক কাঠের এইচএমএস রেজল্যুট নামের এক পরিত্যক্ত জাহাজের পাটাতন কেটে তৈরি করা হয় এটা। ৬০০ টন ওজনের জাহাজটিকে ১৮৫২ সালে আর্কটিক সাগরে অভিযানে পাঠান তৎকালীন ব্রিটিশ রানী ভিক্টোরিয়া।

জাহাজটির দায়িত্ব ছিল, আরেক অভিযানে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া জাহাজ ফ্রাঙ্কলিন এক্সপেডিশনকে খুঁজে বের করা। কিন্তু অভিযানের কিছুদিনের মধ্যেই বিরুপ আবহাওয়ার কারণে বরফে আটকে যায় জাহাজটি। কোনোভাবে উদ্ধারের সম্ভাবনা না দেখে ১৮৫৪ সালে এটাকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ঘটনাক্রমে তিমি শিকারে গিয়ে জাহাজটি আবিষ্কার করেন জেমস বাডিংটন নামের এক মার্কিন ক্যাপ্টেন। উদ্ধার করে এটাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসেন তিনি।

রানীর পক্ষ থেকে উপহার
আর্কটিক সাগর থেকে উদ্ধারের পর মার্কিন শিপইয়ার্ডে আনা হয় জাহাজটি। এরপর মেরামত করে ব্রিটেনকে ফিরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। ফলে জাহাজটি দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কে ‘শান্তির পায়রা’ হয়ে ওঠে। আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ব্রিটেন পৌঁছায় এটা। কিন্তু মার্কিন মহানুভবতার কথা ভুলে যাননি রানী ভিক্টোরিয়া। বড় মনের পরিচয় দিয়ে জাহাজের পাটাতন থেকে তৈরি একটি টেবিল আমেরিকাকে উপহার দেন তিনি।

১৮৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছায়
আরও কয়েক বছর সেবা দেয়ার পর ১৮৭৯ সালে পরিত্যক্ত হয় জাহাজটি। এর ওক কাঠের পাটাতন থেকে একটি টেবিল তৈরির নির্দেশ দেন রানী ভিক্টোরিয়া। কয়েকদিনের মধ্যে একটি টেবিল তৈরি হয়ে যায়। দুই দেশের মধ্যে শুভেচ্ছার বার্তা হিসেবে খোদাই করা হয় রানী ভিক্টোরিয়া ও তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট রাদারফোর্ড বি হায়েসের চিত্র।

আর্কটিকে ব্রিটিশ নৌজাহাজের খোঁজে সহায়তার জন্য উপহার হিসেবে প্রেসিডেন্ট হায়েসকে টেবিলটি পাঠানো হয়। ১৮৮০ সালের নভেম্বরে এটা হোয়াইট হাউসে এসে পৌঁছায়।

রুজভেল্টের টেবিল সংস্কার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় টেবিলটিতে প্রথমবারের মতো উল্লেখযোগ্য সংস্কার আনেন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট। টেবিলটির নিচের দিকে ফাঁকা ছিল। এর ফলে এর সামনের দিক থেকে প্রেসিডেন্টের পা দেখা যেত। আর যাতে পা দেখা না যায়, ফাঁকা জায়গাটায় নতুন একটা তক্তা যোগ করার নির্দেশ দেন রুজভেল্ট। কিন্তু এ সংস্কার দেখার আগেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

প্রথমবারের মতো প্রদর্শনীতে বাইরে
প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির সময় টেবিলটি ব্যাপক পরিচিতি পায়। কিন্তু তার গুপ্তহত্যার পর এটাকে বছরব্যাপী এক প্রদর্শনীর জন্য কেনেডি লাইব্রেরিতে রাখা হয়। এক বছর পর ১৯৬৬-৭৭ পর্যন্ত প্রায় ১১ বছরের জন্য স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউশনের একটি প্রদর্শনীতে ব্যবহার করা হয়।

প্রদর্শনী থেকে ফের হোয়াইট হাউসে : প্রায় এক যুগ পর টেবিলটি হোয়াইট হাউসে ফিরিয়ে আনার দাবি জানান প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। তার জেদের কারণে অবশেষে আরেকবার হোয়াইট হাউসের মুখ দেখে রেজল্যুট ডেস্ক। এরপর থেকে এর ব্যবহার করেছেন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান, বিল ক্লিনটন, জর্জ ডব্লিউ বুশ, বারাক ওবামা ও সর্বশেষ ডোনাল্ড ট্রাম্প।

এমজে/