বিশৃঙ্খলায় টালমাটাল ভারতীয় কংগ্রেস

বিশৃঙ্খলায় টালমাটাল ভারতীয় কংগ্রেস

২০১৯ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর থেকে এই দেড় বছরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (কংগ্রেস) দৃশ্যত রাজনীতির মাঠে খেই হারিয়ে ফেলেছে। নির্বাচনের পর থেকেই দলটিতে একের পর এক ধাক্কা। সবশেষ ধাক্কা লেগেছে এই আগস্টে। দলের ২৩ জন জ্যেষ্ঠ সদস্য – যাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের বড় অংশই কংগ্রেসের সাথে – তারা দলের অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর কাছে চিঠি পাঠিয়ে বলেছেন যে, ১৩৫ বছরের পুরনো এই দলটির ভবিষ্যৎ এখন ‘ঝুঁকিতে’।

বিদ্রোহীরা স্পষ্ট করেই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, দলের নেতৃত্বই এই বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী। যে কোনো রাজনৈতিক দলেই এ ধরনের চিঠিকে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হয়। আর কংগ্রেসের ক্ষেত্রে সেই জায়গায় রয়েছেন সোনিয়া গান্ধী, আর তার ছেলে সাবেক কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জটা যদিও নতুন কিছু নয়, কিন্তু বর্তমান সঙ্কটটা এমন সময় মাথাচাড়া দিলো, যখন ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) তাদের ক্ষমতার জন্য পরোক্ষভাবে হুমকিস্বরূপ এমন যে কোন কিছুকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।

পরিস্থিতি আসলেই মারাত্মক। শীর্ষ কংগ্রেস নেতারা বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন। সকল প্রতিরোধ আন্দোলন হারিয়ে গেছে। বিরোধীদের মধ্যে অনৈক্য। কংগ্রেসের কাছে এই বিদ্রোহটা আসার জন্য এর চেয়ে খারাপ সময় যেন আর হতে পারে না। কিন্তু এটাও সত্য, বিদ্রোহ আসে সবসময়ই খারাপ সময়েই, যদিও সেখানে আগাম কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বিদ্রোহের আগে সবসময় সিস্টেমের মধ্যে একটা অভিযোগ আর অনুযোগের শব্দ শোনা যায়। তবে নেতৃত্ব দক্ষ হলে মাঠপর্যায়ে কী হচ্ছে, না হচ্ছে, তা তাদের কানে আসবে। লক্ষণের বিষয়ে সতর্ক থাকবে। কিন্তু কংগ্রেসের নেতারা এই অসন্তোষের ব্যাপারে স্পষ্টতই অচেতন ছিলেন।

দিল্লীতে কংগ্রেসের ভেতরকার খবর রাখেন এমন এক ব্যক্তি বলেন, “চিন্তা করুন যে, মহারাষ্ট্রের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বিরাজ চৌহানের মতো ব্যক্তিকে রাহুল গান্ধীর সাথে দেখা করার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। অথচ এই ব্যক্তিকে সোনিয়া গান্ধী নিজের হাতে তুলে এনেছিলেন। পরিবারের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি।” চিঠিতে যে ২৩ জন স্বাক্ষর করেছেন, তাদের মধ্যে চৌহানও ছিলেন।

সংবাদপত্রের সম্পাদক থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া এম জে আকবর বলেন, “গান্ধীদের সাথে সাক্ষাতের জন্য দলের অনুগতদের শুধু ঘণ্টা নয়, দিনের পর দিনও অপেক্ষা করতে হয়েছে।” এখন বিজেপি’র এমপি হলেও আকবর একসময় রাজিব গান্ধীর অনুগত ছিলেন। তিনি বলেন, “আজকের রাজনীতিতে এ ধরনের বংশীয় আচরণ আর কাজ করবে না। সত্যি বলতে কি, ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর থেকেই এই দলটি তাদের ভোটারদের সাথে সম্পৃক্ততা হারাতে শুরু করেছে। প্রতিটি দলই ভোট ব্যাংকের রাজনীতিতে জড়িত, কিন্তু কংগ্রেস পুরোপুরি নিজের দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে সামগ্রিক জনগণের সাথে সংস্পর্শ হারিয়ে ফেলেছে।”

২০১৯ সালের নির্বাচন পর্যন্ত কংগ্রেসের প্রায় ২০ শতাংশ ভোট ছিল, সংখ্যায় যেটা প্রায় ১২০ মিলিয়ন। মাঝে মাঝে এখনও বিভিন্ন রাজ্যে তারা জয়ী হচ্ছে। বিজেপির একজন এমপি স্বীকার করেছেন যে, অর্থনীতির অবনতি যদি আগামী বছরও জারি থাকে (২৪% সঙ্কুচিত হয়েছে), তাহলে সরকারের জন্য টিকে থাকা মুশকিল হবে। তিনি বলেন, “তারপরও কংগ্রেস এখানে সুবিধা নিতে পারবে না।”

২০২০ সালে বেশ কিছু ঘটনায় কংগ্রেসের মধ্যে সঙ্কট তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে বিজেপি। কিন্তু কংগ্রেসের পতনের সেটাই একমাত্র কারণ নয়, বললেন সিনিয়র সাংবাদিক রাশিদ কিদওয়াই। কংগ্রেসের ইতিহাস নিয়ে একটা বিশদ বই লিখেছেন তিনি। সোনিয়া গান্ধীর একটি জীবনীও লিখেছেন তিনি।

তিনি বলেন, “এমন ব্যক্তিরাও আছেন যারা দলের পরিণতি নিয়ে সত্যি সত্যিই চিন্তিত। আবার অনেকে আছেন, যারা নিরাপদ বোধ করছেন না। পরের এই গ্রুপটি মনে করে যে, রাহুল গান্ধী দায়িত্ব চালিয়ে গেলে তারা হয়তো বাদ পড়ে যেতে পারেন।”

আরেক পর্যবেক্ষক আজকের কংগ্রেসকে পুরনো আমলের ব্যবসায়িক পরিবারের সাথে তুলনা করেছেন। যেখানে কিনা মালিকানা ভাগ হয়ে যাওয়ায় ও মুনাফা ভাগাভাগির কারণে ব্যবসা ধ্বসে পড়ে। এই পর্যবেক্ষক বলেন, “পারিবারিক ব্যবসার মতোই কংগ্রেস এখন বড় হয়েছে। অনেক নেতা এখন তাদের ভাগ চান। কিন্তু মুনাফার আকার বছর বছর ছোট হচ্ছে।”

এরপর তৃতীয় একটি গ্রুপও এখানে রয়েছে। কিদওয়াই বলেন, এই গ্রুপ আসলে দলের ক্ষতি করতে চায়। এই অংশটিই সম্ভবত বিজেপির সাথে হাত মিলিয়েছে। বাস্তবতা সেটা হলেও, কেউই অবশ্য অস্বীকার করবেন না যে, সমস্যাটা হলো কংগ্রেস নেতাদের ব্যর্থতা। বহু বছর ধরে, তারা পুরোপুরি অকাজের মানুষদের তুলে ধরেছে। এখন তার মূল্য দিতে হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত রাজ্যসভার সাবেক কংগ্রেস এমপি দেব প্রসাদ রায় কংগ্রেস নেতাদের সম্পর্কে সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্ঞানী জাইল সিং-এর পর্যবেক্ষণের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। “নেতা দুই ধরনের: রাজ্য নেতা আর রাজ্যহীন নেতা।” প্রসাদ রায় বলেন, এই রাজ্যহীন নেতাদেরই প্রায়শ জাতীয় নেতা হিসেবে তুলে ধরা হতো, যেটা দলের ক্ষতি করেছে।

রাজ্যহীন এই নেতারা কংগ্রেসের জন্য একটা সমস্যা। কারণ গান্ধীরা যদি কোনো রাজ্যে মধ্যস্থতার জন্য, কোনো সঙ্কট মোকাবেলা করার জন্য নতুন দল পাঠান, বা নতুন কাউকে দলের মধ্যে পরিচয় করিয়ে দেন, তাহলেও এই রাজ্যহীন নেতারা বিপন্ন বোধ করেন।
কেদাই বলেন, “সম্ভবত পরিবারের মধ্যে বড় ধরনের একাধিক ট্রাজেডি ঘটে যাওয়ার কারণে গান্ধী পরিবার সামনে আসতে চায় না।” কিন্তু দলের বিষয়ে তাদের হস্তক্ষেপ ঠিকই রয়েছে। সে কারণে সব পক্ষই এখন একমত হয়েছে যে, দায়িত্ব না নিয়ে শাসন করার প্রক্রিয়াটা বন্ধ হতে হবে।

আসলে কারো নাম উল্লেখ না করে বিদ্রোহীরা উল্লেখ করেছেন যে, ২০১৯ সালের নির্বাচনের এমনকি ১৪ মাস পরেও নির্বাচনের পরাজয় নিয়ে সেই অর্থে কোন ‘বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা’ করা হয়নি। ফলে দলের কর্মী আর নেতারা ‘নৈতিক মনোবল’ হারিয়ে ফেলছেন। কেউ কেউ দল ছেড়েও যাচ্ছেন। তাদের মতে, নরেন্দ্র মোদির হাতেই সব ইস্যুর লাগাম থাকে। সব প্ল্যাটফর্মেই তিনি মানুষের নজর নিয়ন্ত্রণ করছেন।

এক এমপি বলেন, “কংগ্রেস টুইটারের ঝড়কে বাস্তবের জনসমর্থনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে। টুইট দিয়ে বাস্তবের জনসংগঠনকে পাল্টানো যাবে না। বিজেপি হয়তো তাদেরকে টুইটারে সক্রিয় হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। কিন্তু বিজেপি একইসাথে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) মতো নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করে সমর্থকদের সংগঠিত করেছে।”

কিদওয়াই আরও বলেন, “আরএসএস ও তাদের ১৩৮টি সংগঠন বিভিন্ন সম্প্রদায়/জাতভিত্তিক সংগঠন যেমন আগারওয়াল সমাজ ও ক্ষত্রিয় সমাজের সাথে গভীরভাবে জড়িত, যেখানে কংগ্রেসের এ ধরনের কোন সাংগঠনিক যোগ নেই।”

ধর্মীয় রাজনীতি শক্তি বৃদ্ধি করে বহুগুণ। কংগ্রেস এই অস্ত্র ব্যবহার করে না, কারণ তাদের আদর্শ হলো সেক্যুলারিজম ও উদারতন্ত্র। ফলে শক্তিশালী এই ধর্মের অস্ত্র বিজেপি এককভাবে ব্যবহার করছে। কংগ্রেসের এটা বোঝা উচিত। উপযুক্ত কৌশল দিয়ে তাদের এটা মোকাবেলা করা উচিত।

প্রথম নির্বাচন থেকেই কংগ্রেসকে ধর্মীয় বিশ্বাস নির্ভর প্রচারণা মোকাবেলা করতে হয়েছে। কিদাই বলেন, “১৯৫২ সালে উত্তর প্রদেশের ফুলপুরের প্রথম নির্বাচনে জওহরলাল নেহরুকে গো-হত্যার বিরুদ্ধে আগ্রাসী প্রচারণার মোকাবেলা করতে হয়েছে।” নেহরুর প্রতিপক্ষদের মধ্যে একজন ছিলেন আরএসএসের প্রভুদত্ত ব্রহ্মচারি। প্রথম নির্বাচনেই তিনি নেহরুর পাঁচ ভাগের এক ভাগ ভোট পেয়েছিলেন।

কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠিত নব্য উদারবাদী রাজনীতির ভিত্তিতে অর্থনীতি যখন শক্তিশালী হচ্ছিল, তখন ২০ বছর আগে নতুন একটি হিন্দু ডানপন্থী সংগঠনের উত্থান হয়। কংগ্রেসের জন্য এটা ছিল একটি ধাক্কা। কিন্তু তারপরও আজ অব্দি ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে মোকাবেলার জন্য কংগ্রেস সুস্পষ্ট কোন রোডম্যাপ তৈরি করতে পারেনি।

দলের বিদ্রোহীরা ১১ দফা দাবি নিয়ে এসেছেন। এর মধ্যে একটি হলো দলীয় পদের জন্য অভ্যন্তরীণ নির্বাচন ও বিকেন্দ্রীকরণ। এটাকে বিবেচনায় নেয়া হবে কি না সেটা এখনও দেখার বিষয়।

তবে এই নিবন্ধ যখন প্রকাশিত হচ্ছে, তখন মনে হচ্ছে যে, কংগ্রেসের সব এখনও হারিয়ে যায়নি। অনেক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে এখন অজয় লাল্লুর কথা শোনা যাচ্ছে। কয়েক বছর আগে, নির্বাচনের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ উত্তর প্রদেশের দৃশ্যপটে তার আবির্ভাব হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে কেউ চিনতোই না। অজয় লাল্লু উত্তর প্রদেশে কংগ্রেসের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, যেই অঞ্চলে দলের অবস্থা সবচেয়ে দুর্বল।

তৃণমূল পর্যায়ের কর্মজীবি শ্রেণী থেকে উঠে আসা তরুণ কংগ্রেসম্যান লাল্লু বিরামহীনভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন ও লড়াই করেছেন। তাকে কারাগারে যেতে হয়েছে। অন্যভাবেও তাকে টার্গেট করা হয়েছে। উত্তর প্রদেশে দলের শাখা সরাসরি তত্ত্বাবধান করেন রাহুল আর তার বোন প্রিয়াঙ্কা। তাদের সরাসরি সমর্থনে তরুণ নেতা লাল্লু দ্রুত দরিদ্র মানুষের সমস্যাগুলোকে সেখানে রাজনীতির ইস্যু করে তুলেছিলেন।

এক সাক্ষাতকারে লাল্লু বলেছিলেন, “আরামকেদারা, ড্রইং রুমের রাজনীতির সময় চলে গেছে।” কংগ্রেসের এখন এই ধরনের আরও সৈন্য দরকার। আশাবাদীদের বিশ্বাস, গান্ধীরা নেতৃত্বে থাকা অবস্থায় এই ধরনের অনেক অজয় লাল্লুই দলে ভিড়বেন।

(শুভজিৎ বাগচির এই নিবন্ধ প্রথমে প্রকাশিত হয় সাউথ এশিয়ান মনিটরে। সেখান থেকে অনুদিত।)