যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন ২০২০

ভোটের রাতে হোয়াইট হাউসে রীতি ভাঙ্গা এক পার্টি

ভোটের রাতে হোয়াইট হাউসে রীতি ভাঙ্গা এক পার্টি

সারারাত ধরে হোয়াইট হাউসে ছিল টানটান উত্তেজনা। প্রেসিডেন্টের সব কর্মী এবং তার নির্বাচনী প্রচারণার কর্মকর্তারা প্রায় সারা রাত সেখানেই ছিলেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে থাকবেন কীনা, সেটা যখন নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, তখন একটা কাজই তারা করতে পারেন- কেবল অপেক্ষা করা আর মদ পান করে যাওয়া। প্রচুর পরিমাণে।

মঙ্গলবার সকালে হোয়াইট হাউসের নারী কর্মীরা কাজে এসেছিলেন উৎসবের পোশাক পরে। তাদের পরনে ছিল রিপাবলিকানদের লাল সোয়েটার, স্কার্ট, আর উঁচু হিলের জুতো। মনে হচ্ছিল তারা যেন পরস্পরকে টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে আগেই ঠিক করে নিয়েছেন, কে, কী পোশাক পরে কাজে আসবেন।

সারাদিন ধরে তারা নির্বাচনের খবর দেখেছেন এবং ফল কী হতে পারে সেটা নিয়ে ভেবেছেন।

এসবের পরও হোয়াইট হাউসে সবার মধ্যে কেমন যেন একটা উৎকণ্ঠা দেখা যাচ্ছিল। একজন কর্মী একটি বিয়ারের বোতল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে, বোতলের কাগজের লেবেলটি কিছুটা খুলে গেছে।

এই কর্মীরা কাজ করেন হোয়াইট হাউসের ওয়েস্ট উইংয়ে। যেটা কিনা হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্টের প্রশাসনের একেবারে মূল কেন্দ্র। সেখানে হোয়াইট হাউসের কর্মীদের দেখে মনে হচ্ছিল তারা বেশ নার্ভাস। যদিও অনেকে নিজেদের বলিষ্ঠ এবং আত্মবিশ্বাসী বলে দেখানোর চেষ্টা করছিলেন।

"আমরা খুব ভালো বোধ করছি", একজন আমাকে বললেন।

এই নারীকর্মী বলছিলেন ফ্লোরিডা থেকে যে রকম ফল আসতে শুরু করছে তাতে দেখা যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এগিয়ে আছেন।

"আমরা খুবই আশাবাদী", বেশ সতর্কভাবে বলছিলেন তিনি।

তার পেছনে যে টেলিভিশনের স্ক্রিন সেটির ভলিউম বাড়িয়ে দেয়া হলো। সেখানে নির্বাচনের অনেক আপডেট দেয়া হচ্ছে। সংবাদ পাঠক একটা 'সমাজতান্ত্রিক নৈরাজ্যের' হুঁশিয়ারি দিলেন। ডেমোক্র্যাটরা যদি নির্বাচনে জিতে তাহলে কী ঘটবে সেটা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তিনি।

একটি বুকশেলফে পড়ে আছে নিউইয়র্ক পোস্ট পত্রিকার একটা কপি। এই ঘরটিতে দামী মোমবাতির সুগন্ধ। পাশেই হোয়াইট হাউজের আর একটি অফিস কক্ষে একজন কর্মী তার সহকর্মীর কাঁধে চাপড় দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন।

হোয়াইট হাউসের আরেক জায়গায় তখন প্রেসিডেন্টের নির্বাচনী পার্টি শুরু হয়ে গেছে। শত শত লোককে সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। লাল সিল্কের কাপড় পরে আমন্ত্রিত অতিথিরা যখন আসতে শুরু করলেন, তখন উপরের আকাশ একেবারে পরিস্কার, অনেক তারা দেখা যাচ্ছে।

এই পার্টির আয়োজন করা হয়েছে অতীত ঐতিহ্য ভঙ্গ করে। নির্বাচনের রাতে প্রেসিডেন্ট যে হোয়াইট হাউসে কোন জমকালো পার্টির আয়োজন করতে পারবেন না, সেরকম কোনো আইন নেই। কিন্তু এর আগে আর কোন প্রেসিডেন্ট এরকম কাজ করেননি।

মিস্টার ট্রাম্পের পূর্বসূরীরা, তারা হোক রিপাবলিকান কিংবা ডেমোক্রেট, নির্বাচনী প্রচারণা এবং সরকার পরিচালনার কাজ কর্মের মধ্যে তারা একটা সুস্পষ্ট দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। যাতে এই দুটির মাঝখানের সীমারেখাটা অনেক সময় অস্পষ্ট হয়ে না যায়।

প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগ্যান এবং বারাক ওবামা দুজনেই হোয়াইট হাউজের রুম ব্যবহার করেছেন তাদের রাজনৈতিক প্রচারণার পটভূমি হিসেবে। তবে তারপরও তারা একটা পরিষ্কার সীমারেখা টানার চেষ্টা করেছেন তাদের নির্বাচনী প্রচারণার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার কর্মকান্ডের মাঝখানে।

কিন্তু ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে নির্বাচনের রাতে সেই সীমারেখা যেন পুরোপুরি মুছে গেছে।

নির্বাচনের রাত হোয়াইট হাউসে এরকম একটি পার্টি আয়োজনের সিদ্ধান্ত শুনে অনেকেই আঁতকে উঠেছেন।

আমেরিকান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক গর্ডন অ্যাডামস তাদের একজন। ১৯৯৬ সালে তিনি জাতীয় নিরাপত্তা বাজেটের একজন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন।

সে বছর তিনি প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে আরকানসাসে ছিলেন নির্বাচনের রাতে। সেই রাতের পর গর্ডন অ্যাডামস অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে বিমানে ওয়াশিংটনে ফিরে এসেছেন এবং একটি চার্টার করা বাস তাদেরকে হোয়াইট হাউজে নামিয়ে দিয়েছিল।

"সেদিন হোয়াইট হাউস ছিল একেবারে শান্ত," বলছিলেন তিনি, "সেখানে কেউ ছিল না, সেখানে কেউ উৎসব করছিল না।"

প্রফেসর অ্যাডামস যখন শুনলেন যে নির্বাচনের রাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে পার্টি আয়োজন করতে যাচ্ছেন, সেটা শুনে তিনি খুশি হননি।

"এটা খুবই পীড়াদায়ক", বলছেন তিনি।

হোয়াইট হাউসের ইস্ট রুমে পার্টির মাধ্যমেই যে কেবল প্রেসিডেন্ট অতীতের ঐতিহ্য ভেঙ্গেছেন, তা নয়। তার নির্বাচনী কর্মকর্তারা হোয়াইট হাউসের মধ্যেই এক অফিস খুলে সেখান থেকে কাজ করেছেন।

এই 'ওয়ার রুম' স্থাপন করা হয় আইজেনহাওয়ার এক্সিকিউটিভ অফিস বিল্ডিং এর ঠিক উল্টো দিকে। সমালোচকরা বলছেন এ ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা হোয়াইট হাউস চত্বরের ভেতরে করা উচিত নয়।

তবে এসব সমালোচনার জবাবে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার টিমের একজন মুখপাত্র বলেছেন, হোয়াইট হাউসে এরকম নির্বাচনী রুম কোনভাবেই নিয়ম ভঙ্গ করে করা হয়নি। তিনি আরও বলেন, এজন্যে তো আমেরিকার করদাতাদের কোনো পয়সা খরচ হচ্ছে না।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেভাবে ওয়াশিংটনে সবকিছুকে নাড়িয়ে দিয়েছেন এবং বহু রীতি ভেঙ্গে ফেলেছেন, সেগুলো তার সমর্থকরা খুবই পছন্দ করেন। তার এই প্রথা বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গীই হয়তো তাকে পুননির্বাচিত করবে।

এই পার্টিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেও হাজির হলেন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে একটা বক্তৃতা দিলেন।

তিনি সেখানে নির্বাচনে জিতেছেন বলে মিথ্যে দাবি জানালেন।

‍"আমি যতদূর জানি এই নির্বাচনে আমরা এরই মধ্যে জিতে গেছি" বললেন তিনি। পার্টিতে থাকা লোকজন উল্লাসে চিৎকার করে উঠলো।

বাস্তবে কিন্তু এখনো লক্ষ লক্ষ ভোট গণনা বাকি। টেলিভিশনে যারা প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণা শুনেছেন তারা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের অভূতপূর্ব এক ভোটের রাতে এই বক্তৃতা তাদের কাছে খুবই খুবই বিরক্তিকর এক সমাপ্তি। যে রাতটি ছিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতই অনেক ধরনের বিস্ময়ে ভরা।