জয়ের কাছাকাছি বাইডেন

জয়ের কাছাকাছি বাইডেন

যুক্তরাষ্ট্রে ৩ তারিখ নির্বাচন শেষ হওয়ার পর আমেরিকায় ৪ নভেম্বর রাতেও ভোট প্রক্রিয়া সম্পন্ন হল না। আর ফলাফল প্রকাশিত হলেও সমস্যা সহজে মিটবে বলে মনে হয় না। পুনর্গণনার দাবি উঠবে, লড়াই চলতে পারে আদালতেও।

সমীক্ষা বলেছিল ভোট শতাংশে জো বাইডেন এগিয়ে থাকবেন। সেখানে বিশেষ ভুল নেই। প্রায় সবসময়েই এগিয়ে থেকেছেন বাইডেন, এবং ভারতীয় সময় বৃহস্পতিবার সকালে তিনি আগের এক কিংবা দেড় শতাংশের ব্যবধান বাড়িয়ে আপাতত প্রায় আড়াই শতাংশ ভোটে এগিয়ে। ওবামার থেকেও বেশি ভোট পেয়ে জিততে চলেছেন তিনি। তবে সমীক্ষায় যে বেশ অনেকটা ব্যবধানের কথা বলা হয়েছিল অক্টোবর মাসে, তেমন কিন্তু আদৌ ঘটে নি। এখানে মনে রাখতেই হবে যে, কোনও নির্বাচনেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলে ভোট শতাংশ আর আসনের সম্পর্ক একেবারে গুলিয়ে যায়।

অর্থাৎ দেশ জুড়ে ভোট শতাংশে অনেক এগিয়ে থাকলেও লাভ নেই, বরং কম ব্যবধানে এক একটি রাজ্য জিতে নিয়ে সেখানকার সব আসন বগলদাবা করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখনও পুরো বিষয়টা পরিষ্কার না হলেও যে কটি রাজ্যে আসন বেশি এবং লড়াই হাড্ডাহাড্ডি সেটা বুঝতে কোন অসুবিধে নেই। আপাতত রাজ্যগুলো হল জর্জিয়া (১৬), মিশিগান (১৬), নেভাদা (৬), নর্থ ক্যারোলিনা (১৫) আর পেনসিলভেনিয়া (২০)। এগুলো বাদে বাইডেন এগিয়ে ২৪৮ আর ট্রাম্প এখনও ২১৪ তেই আটকে আছেন। বোঝাই যাচ্ছে এখনও সঠিক ফল জানতে বেশ কিছুটা সময় বাকি।

তবে ভীষণ লড়াই চলা রাজ্যগুলোর দিকে তাকিয়ে বাইডেন যে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা বেশি সেকথা বলতেই হচ্ছে। এই সময়টাতে সামনের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে ট্রাম্পের জেতার আশা কম। বিশেষ করে আরিজোনার ১১ আর উইসকনসিনের ১০ টা আসন চলে যাওয়ায় বাইডেনের সম্ভাবনা সত্যিই অনেকটা বেড়েছে। এই প্রসঙ্গে এই সময়ে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্কটা কষে ফেলা যাক। এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হলে তা হবে তত্ত্বের হিসেবে সবথেকে কম ব্যবধানে জেতা-হারার ফলাফল।

মিশিগানের ১৬ আর নেভাডার ৬ মিলে হয় ২২। এই দুই রাজ্যে ভালোই এগোচ্ছেন বাইডেন। ২৪৮ এর সঙ্গে ২২ যোগ করুন, পাবেন ২৭০। বাকি সব আসন ট্রাম্প সাহেব পেয়ে গেলেও পৌঁছবেন ২৬৮-তে। অর্থাৎ ফলাফল দাঁড়াবে বাইডেন ২৭০ বনাম ট্রাম্প ২৬৮। শুধু মার্কিন দেশ কেন? সম্ভবত বিশ্ব ইতিহাসে এমন কান ঘেঁষা ফল কখনো দেখা যায় নি।

আজ সকালের ফলাফল বলছে বাইডেন ২৬৪ আর ট্রাম্প ২১৪ আসনে এগিয়ে। নেভাডার ছটি আসনে জিতলেই বাইডেনের খাতায় রাষ্ট্রপতির সিলমোহর পড়ে যাবে। কিন্তু ভোটের অঙ্ক সেখানে কিছুটা হলেও কঠিন।

এর মধ্যে ট্রাম্প শিবির নাকি আশা করছে আরিজোনার দশটা আসন তারা আবার ফিরে পেতে পারেন। অন্যদিকে বাইডেন আবার ব্যবধান কমাচ্ছেন জর্জিয়াতে। সেখানে ১৬টা আসন। কুড়িটি আসন বিশিষ্ট পেনসিলভেনিয়া নিয়েও অস্পষ্টতা বর্তমান। অর্থাৎ এই মুহুর্তে বাইডেন জেতার দোরগোড়ায়, এমনকি তিনশোর কাছাকাছিও পৌঁছে যেতে পারেন তিনি। অন্যদিকে সামান্য হলেও কিছুটা আশা রয়ে গেছে ট্রাম্প শিবিরে। এখনও তাঁরা হাল ছেড়ে দিতে রাজি নন।

আমেরিকায় বেশ কিছু রাজ্য আছে যেখানে ভোট না হলেও চলে। যেমন নিউ ইয়র্ক কিংবা ক্যালিফোর্নিয়া। সেখানে প্রায় সবসময়েই জেতে ডেমোক্র্যাটরা। তেমনই ওহায়ো বা কেনটাকিতে বিপুলভাবে জেতে রিপাবলিকান। অর্থাৎ তারা সব সময়েই হয় রিপাবলিকান অথবা ডেমোক্র্যাটদের দিকে ঝুঁকে আছেন। তাঁদের নিয়ে আলোচনা কম। অন্য দিকে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ সেইসব রাজ্য, যেখানে সামান্য শতাংশের ব্যবধানে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। এগুলিই সুইং স্টেট। দোদুল্যমানতার শেষে এঁরা কোন দিকে ঘেঁষবেন তার ওপরই নির্ভর করবে সামগ্রিক ভোটের ফল। মনে রাখতে হবে, বেশি ভোট পেলেই কিন্তু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়া যায় না। তা হলে গতবার হিলারি ক্লিনটনই কুর্সিতে বসতেন। কিন্তু সিকি কোটির বেশি ভোট পেয়েও (যা নাকি ২ শতাংশের বেশি) তিনি হারেন আসনের হিসেবে। এ বারেও সেই একই কথা। সেই কারণেই সমীক্ষা বলেছিল দু’শতাংশের মত ভোটে বাইডেন এগিয়ে থাকলেও তিনি একেবারেই নিশ্চিন্ত নন।

কারণ কম ভোট পেয়েও হিসেব করে কয়েকটি রাজ্যে জিতে গেলেই রিপাবলিকানদের পোয়া বারো। সেই হিসেবে নাকি তিন-চার শতাংশ ভোটে বাইডেন এগিয়ে থাকলেও আসনের হিসেবে লড়াই হাড্ডাহাড্ডি। আর মতদানের হিসেবে ৫ শতাংশের মতো বেশি থাকলে তবেই নিশ্চিত হতে পারতেন বাইডেন। তেমনটা এখনও হচ্ছে না। সেই সঙ্গে খবর পাওয়া যাচ্ছে বেশ কিচ্ছু রাজ্যে ভোট গণনা নিয়ে যথেষ্ট অশান্তি হবে। ভোটের সম্পূর্ণ ফলাফল আসতে কয়েকদিন লেগে যেতে পারে এমন আশঙ্কাও রয়েছে।

বিষয়টা যে বেশ জটিল, সেটা বোঝা যাচ্ছে। কারণ গণনা শুরুর দিনের রাত ১২টা পার হলেও জেগে ছিল দুই যুযুধান পক্ষ। এই পর্যায়েই মাঝরাতে বক্তব্য রেখেছেন বাইডেন। দাবি করছেন, তিনিই জিতবেন। আবার গভীর রাতে টুইট করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিযোগ, সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও ডেমোক্র্যাট সমর্থকরা ভোট দিচ্ছেন অনেক জায়গায়। একে তিনি বলছেন ‘ভোট চুরি’। পাশাপাশি সেই মাঝরাতেই ট্রাম্পও ঘোষণা করেছেন তিনিই জিতছেন। একইসঙ্গে অবশ্য গণনা বন্ধের দাবিতে আদালতে যাওয়ার হুমকিও ফের দিয়েছেন তিনি।

কোভিডের হানায় বাকি বিশ্বের মতই আমেরিকাও নাজেহাল। বেকারত্ব আকাশ ছুঁচ্ছে। কালো মানুষের প্রতি অবিচারে ফুঁসছে বড় অংশের মানুষ। মার্চ এপ্রিলে সাধারণ করদাতাদের কাছে কিছু ডলার পৌঁছলেও, তারপর থেকে কিন্তু খুব বেশি কিছু ভাবতে পারেননি ট্রাম্প সাহেব। ভোটের আগে জনগণের কাছে কোভিড প্রতিষেধক পৌঁছে দিতে পারলে হয়তো অনেকটা ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা ছিল বর্তমান প্রেসিডেন্টের। তেমনটাও ঘটেনি। ফলে সোজা ভাবনায় ট্রাম্পের হেরে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সমীক্ষাও তাই বলছিল গত দু’মাস ধরে। কিন্তু একেবারে শেষের দিকে কোলাকুলি সেয়ানে সেয়ানে।

মনে রাখতে হবে, বিপুল সংখ্যক মানুষ ভোট দিয়েছেন এই নির্বাচনে। যা অনেক সময়েই ক্ষমতা বদলের লক্ষণ। তবে হেরে গেলে নির্বাচনী ফলাফল না মেনে নেওয়ার যে রেওয়াজ, তা সাধারণত পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর। এবার সেই ছোঁয়াচ যুক্তরাষ্ট্রেও লেগেছে। এতটাই বিভাজনের রাজনীতি ঢুকে পড়েছে সে দেশে যে ট্রাম্প হেরে গেলে নাকি হোয়াইট হাউস না ছেড়ে আইনি লড়াইতে নামবেন। বাইডেনও তেমনটাই বলছেন। যাই হোক, সে সব রাজনীতির ভবিষ্যৎ। আপাতত খেলা শুধু সংখ্যার।