করোনা ভাইরাস ভ্যারিয়্যান্ট: কোত্থেকে আসে, কেন ঘটে রূপান্তর

করোনা ভাইরাস ভ্যারিয়্যান্ট: কোত্থেকে আসে, কেন ঘটে রূপান্তর

ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়্যান্ট, ইউকে ভ্যারিয়্যান্ট, দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়্যান্ট, ব্রাজিল ভ্যারিয়্যান্ট - করোনাভাইরাসের এরকম অনেক ভ্যারিয়্যান্টের কথা আমরা শুনছি।

এগুলো করোনাভাইরাসের হাজার হাজার ধরনের মধ্যে মাত্র কয়েকটি ভ্যারিয়্যান্ট।

করোনাভাইরাসের এরকম হাজার হাজার ধরন বা ভ্যারিয়্যান্ট সারা বিশ্বেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, সময়ের সঙ্গে সব ভাইরাসেরই পরিবর্তন ঘটে। সার্স-কোভ টু ভাইরাসও এর ব্যতিক্রম নয়।

বাংলাদেশে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর-এর ভাইরোলজিস্ট তাহমিনা শিরিন বলছেন, করোনাভাইরাস হচ্ছে আরএনএ ভাইরাস। এরকম একটি ভাইরাস থেকে যখন অনেক ভাইরাস তৈরি হয় তখন তাদের মধ্যে আপনা আপনিই কিছু পরিবর্তন ঘটে।

"প্রতিদিন ভাইরাস তৈরি হচ্ছে এবং তৈরি হওয়ার সময় যে পরিবর্তন ঘটছে সেটাকেই বলা হয় মিউটেশন বা রূপান্তর," বলেন তিনি।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাকৃতিক কারণেই ভাইরাসের মধ্যে পরিবর্তন ঘটে। অনেক সময় বেঁচে থাকার জন্যও নিজের মধ্যে তারা পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকে যাকে বলা হয় "সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট।"

তাহমিনা শিরিন বলছেন, "মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা বা ইমিউনিটিকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যও তারা এই পদ্ধতি গ্রহণ করে থাকে।"

কিন্তু ভাইরাসের তো মানুষ কিম্বা পশু পাখির মতো কোনো মস্তিষ্ক বা ব্রেন নেই। এটা তো চিন্তাভাবনা করতে পারে না। তাহলে এই পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা ভাইরাসটি কিভাবে বুঝতে পারে?

তাহমিনা শিরিন বলছেন, "জেনেটিক উপাদানের মধ্যে এই পরিবর্তন হয়। ব্যাকটেরিয়ারও তো কোনো ব্রেইন নেই কিন্তু তাদের মধ্যে এন্টি-মাইক্রোবিয়াল রেজিসটেন্স কেন হয়? সব একই মেকানিজম। বেঁচে থাকার জন্য তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন ঘটে।"

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই রূপান্তরের কারণে ভাইরাসের ভেতরেও কিছু পরিবর্তন ঘটে।

"ভাইরাস যখন মানব দেহে বা কোনো হোস্টের ভেতরে প্রবেশ করে তখন সেখানে রিসেপ্টর বা গ্রাহক থাকতে হয়। করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন ওই রিসেপ্টরের সাথে গিয়ে লাগে এবং তারপরেই ভাইরাসটি ভেতরে ঢুকে। রূপান্তরের ফলে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের পরিবর্তন ঘটে," বলেন ভাইরোলজিস্ট তাহমিনা শিরিন।

উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি ইউকে ভ্যারিয়্যান্টের কথা উল্লেখ করেন। বলেন, এই ভ্যারিয়্যান্টের স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তনের কারণে এর সংক্রমণ করার ক্ষমতা বেড়ে গেছে।

এছাড়াও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কারণে কিম্বা টিকা গ্রহণের পরে মানুষের শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হয়, ভাইরাসের পরিবর্তনের কারণে এই এন্টিবডিও সেই ভ্যারিয়্যান্টকে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাসটি প্রথম পাওয়া যাওয়ার পর থেকে গত প্রায় দেড় বছরে এর মধ্যে এরকম হাজার ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে।

তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন এসব পরিবর্তনের ফলে নতুন নতুন যে ধরন তৈরি হয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগই শুধুমাত্র 'বাহক', তাতে চরিত্রের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।

বিজ্ঞানীরা এসব নতুন নতুন ভ্যারিয়‌্যান্ট নিয়ে গবেষণা করছেন। করোনাভাইরাসের টিকাকে কার্যকর করতে হলে এসব ভ্যারিয়‌্যান্ট সম্পর্কে জানা জরুরি। কারণ সব টিকা সব ভ্যারিয়্যান্টকে একইভাবে মোকাবেলা করতে পারে না। আর একারণে করোনাভাইরাসের এই রূপান্তর বা মিউটেশন জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু নতুন নতুন এসব ভ্যারিয়্যান্ট কোত্থেকে আসে? এগুলো কী ধরনের? কেনোই বা ভাইরাসের এধরনের রূপান্তর বা পরিবর্তন ঘটে?

বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোনো ভাইরাস একজন মানুষ কিম্বা হোস্টের শরীরে প্রবেশ করার পর যখন কোষ সংক্রমিত করতে শুরু করে তখন তার নিজেরও কপি বা অনুলিপি তৈরি করতে শুরু করে, যাতে করে এটি 'ডমিনোর' মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে।

এই পরিবর্তনের সময়ে তৈরি হয় ভাইরাসের হাজার হাজার কপি। আর এই কাজটা তাকে করতে হয় খুব দ্রুত।

এই দ্রুত পরিবর্তনের চাপে পড়ার কারণে ভাইরাসের পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় কিছু ত্রুটি দেখা দেয় এবং এসব ত্রুটিই জেনেটিক মিউটেশন বা জিনগত রূপান্তর।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, রূপান্তরিত ভাইরাসটি আগের ভাইরাসের তুলনায় খারাপ হয় কিনা সেটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। অনেক সময় এই পরিবর্তন ভাইরাসটির নিজের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে।

তাহমিনা শিরিন বলছেন, "মিউটেশনের জন্য ভাইরাসের ক্ষতি করার তীব্রতা যেমন বেড়ে যেতে পারে তেমনি সেটা কমেও যেতে পারে।"

বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসের এই নতুন নতুন ভ্যারিয়্যান্টের ফলে এর বিরুদ্ধে লড়াই করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। তারা বলছেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত যেসব টিকা তৈরি হয়েছে সেগুলো ১০০ ভাগ নিরাপত্তা দিতে পারছে না। এর পাশাপাশি বিভিন্ন ভ্যারিয়্যান্টের কারণে সেই নিরাপত্তা আরো দুর্বল হয়ে পড়েছে।

"এমনিতেই টিকাগুলো ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ নিরাপত্তা দিচ্ছে। কিন্তু ভ্যারিয়্যন্টের কারণে সেটা আরো কমে গেছে," বলেন তাহমিনা শিরিন।

তবে সব ভ্যারিয়্যান্টের ক্ষমতা একরকম নয়। কোনো ভ্যারিয়্যান্ট দ্রুত ছড়াতে পারে। আবার কখনও তার ক্ষতি করার ক্ষমতাও বেড়ে যেতে পারে।

তবে এসব নির্ভর করে ভাইরাসের কোন জায়গায় মিউটেশন হয়েছে এবং কী ধরনের পরিবর্তন হয়েছে এধরনের বিষয়ের ওপর।