ইসরায়েলি হামলায় ইরানের হাসপাতালগুলোতে ‘রক্তবন্যা’

ইসরায়েলি হামলায় ইরানের হাসপাতালগুলোতে ‘রক্তবন্যা’

ইরানের রাজধানী তেহরানে ইসরায়েল হামলা চালানোর পর থেকেই ইমাম খোমেনি হাসপাতালে আহতদের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। তবে স্থানীয় সময় রবিবার (১৫ জুন) সন্ধ্যায় হামলার পর হাসপাতালটিতে হতাহতদের ঢল নামে। জরুরি বিভাগের বিভীষিকাময় এই পরিস্থিতিকে এক চিকিৎসক বর্ণনা করেছেন ‘রক্তস্নান’ হিসেবে।

দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলি হামলার ভয়বহতার কথা এভাবেই বর্ণনা করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই চিকিৎসক।

তিনি বলেন, ‘যেন এক রক্তস্নান শুরু হয়েছে আমাদের হাসপাতালে। চারদিকে শোকাতুর আত্মীয়-স্বজনের চিৎকার আর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে আমরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। অসংখ্য জীবন-সঙ্কটাপন্ন। আহত, ছোটখাটো আঘাত পাওয়া, এমনকি লাশ পর্যন্ত আনা হয়েছিল।’

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার সংঘর্ষ চতুর্থ দিনে গড়ালে ইরানের হাসপাতালগুলোতে একের পর এক হতাহতদের নিয়ে আসা শুরু হয়। হঠাৎ করে এমন পরিস্থিতিতে দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেকটা স্থবির হয়ে পড়ছে। রোগীর চাপ সামলাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আহতদের সংখ্যা বেড়ে চলায় নাজেহাল হয়ে পড়ছে তেহরানের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা।

সাক্ষাৎকারে ওই চিকিৎসক বলেন, ‘আমি শিশু, কিশোর, প্রাপ্তবয়স্ক, এমনকি বৃদ্ধদেরও আহত অবস্থায় হাসপাতালে আসতে দেখেছি। রক্তে ভিজে সন্তানকে নিয়ে ছুটে আসছেন মা। অনেক বাবা-মা তো বুঝতেই পারছেন না যে তারাও আহত। সন্তানকে কোল থেকে নামিয়ে রাখার পর যন্ত্রণায় কাতর হয়ে বসে পড়ছেন তারা।’

আহতদের মধ্যে উরুর হাড় ও কোমরের নরম টিস্যুতে ধাতব টুকরো প্রবেশ, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ এবং মারাত্মক আকারে দগ্ধ হওয়ার মতো আঘাতের চিহ্ন ছিল বলে জানান তিনি। ইসরায়েলের বোমার আঘাতে আহত হয়ে এবং বস্তুর ধারালো টুকরোর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মানুষজন হাসপাতালে ছুটে আসেন বলে জানান এই চিকিৎসক।

গত শুক্রবার (১৩ জুন) ভোরে ইরানের রাজধানী তেহরানসহ একাধিক স্থানে হামলা চালায় ইসরায়েল। ইসরায়েল ওই অপারেশনের নাম দেয় রাইজিং লায়ন। এর পরপরই পাল্টা হামলা শুরু করে ইরান। তারপর থেকেই উভয় দেশের মধ্যে সংঘাত বেড়েই চলেছে।

সোমবার (১৬ জুন) সকালে ইরানি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ২২৪ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-অধিভুক্ত হাসপাতালগুলোতে অন্তত ১ হাজার ২৭৭ জনকে ভর্তি করা হয়েছে।

তবে হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে জানান ইমাম খোমেনি হাসপাতালের ওই চিকিৎসক। তাদের হাসপাতালের আইসিইউতে আরও শয্যা বরাদ্দ করা হয়েছে এবং ছোটখাটো আঘাতপ্রাপ্তদের অন্য ক্লিনিকে পাঠানো হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, আহত বা নিহতের সংখ্যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু পোস্ট না করার জন্য আইসিইউ-কর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাদের ডিউটির তালিকা বিভাগীয় প্রধানদের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

নিহত ও আহতদের সংখ্যা জানতে চাইলে তেহরানের কর্তৃপক্ষ তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন তেহরানভিত্তিক এক সাংবাদিকও।

ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হোসেইন কেরমানপূর বলেন, আহতদের মধ্যে ৯০ শতাংশই বেসামরিক নাগরিক। যদিও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কেবল ইরান সরকারের মালিকানাধীন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাচ্ছেন বলে দাবি করেছেন।

গতকাল একটি বিমানঘাঁটিতে সফরকালে নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমরা যখন তেহরানের আকাশ নিয়ন্ত্রণে রাখি, তখন আমরা শুধু শাসকগোষ্ঠীর লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করি। ইরানের অপরাধী সরকার যেমন আমাদের নাগরিকদের, শিশু ও নারীদের হত্যা করতে আসে, আমরা তেমনটি করি না।’

অন্যদিকে, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সামরিক ঘাঁটি ও আবাসিক এলাকায় আঘাত হানার ফলে ইসরায়েলে অন্তত শিশুসহ ১৭ জন নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে ইসরায়েল। আর ইরানের কেরমানশাহর একটি হাসপাতালে ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে ইরান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তেহরানের পশ্চিমে অবস্থিত কারাজ শহরের একটি হাসপাতালের এক কর্মী জানান, ‘হাসপাতালে অনেক লাশ আছে, তবে তারা কারা সেটি আমি বলতে পারছি না। আমি শুধু যতটা সম্ভব জীবন বাঁচাতে চাই।’

আবাসিক এলাকায় হামলা চালানোর জন্য তিনিও ইসরায়েলের ওপর দোষারোপ করেন। এমনকি ইরান সরকারও বেসামরিকদের জীবনের প্রতি খুব একটা যত্নবান নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা খাওয়া-দাওয়ার সময় পর্যন্ত পাইনি। সকাল পার হলে আরও লাশ আসবে বলে ভয় হচ্ছে আমার।’

বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে দ্য গার্ডিয়ান বলেছে, সোমবার ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির জন্য মধ্যস্থতা করতে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আহ্বান করতে উপসাগরীয় দেশগুলোকে অনুরোধ করেছে ইরান। তবে সংঘাত থামার কোনো লক্ষণ এখনও দেখা যায়নি।

এদিকে, দুঃস্বপ্নের মতো এই যুদ্ধে আহতদের সেবা দিতে গিয়ে ভয়াবহ এক সময় পার করছেন ইরানের স্বাস্থ্যকর্মীরা।

ইমাম খোমেনি হাসপাতালের ওই চিকিৎসক বলেন, ‘গত তিন দিনের পরিস্থিতি আমাকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের ভয়ঙ্কর সব স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে। আঘাতগুলো ভয়ানক; আমার মনে হচ্ছে, আমরা যুদ্ধক্ষেত্রের পাশে কোনো অস্থায়ী হাসপাতালে কাজ করছি।’