খ্যাতিমান সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ আর নেই

খ্যাতিমান সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ আর নেই

খ্যাতিমান সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবি এবং লেখক মাহফুজ উল্লাহ ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

শনিবার সকাল ১০টা ৫ মিনিটে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। মাহফুজ উল্লাহর মেয়ে নুসরাত হুমায়রা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

খ্যাতিমান এই সাংবাদিকের মরদেহ আজ মধ্যরাতের পর ঢাকায় পৌঁছাবে বলে পারিবারিকভাবে জানানো হয়েছে।

মাহফুজ উল্লাহর বড় ভাই অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মাহফুজ উল্লাহর মরদেহ আজ রাতে থাই এয়ারওয়েজের একটি বিমানে করে রাত ১২টা ৪০ মিনিটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমাবন্দরে পৌঁছাবে।’

জানাজা ও দাফনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘মাহফুজ উল্লাহর প্রথম জানাজা আগামীকাল রবিবার বাদ জহুর গ্রিনরোড ডরমেটরি মসজিদে অনুষ্ঠিত হবে। এরপর তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে জাতীয় প্রেসক্লাবে। সেখানে বাদ আসর দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। মাহফুজ উল্লাহ দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও সংবাদপত্র জগতের কর্মীরা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।’

আগামীকালই মাহফুজ উল্লাহর শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী তাকে মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে বলে জানা যায়।

কিডনি, ফুসফুস ও হার্টের বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছিলেন মাহফুজ উল্লাহ। গত ২ এপ্রিল সকালে ধানমণ্ডির গ্রিন রোডের বাসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হলে মাহফুজ উল্লাহকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখা‌নে তাঁকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়। প‌রে শারী‌রিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় গত ১০ এপ্রিল রাত ১১টা ৫২ মি‌নি‌টে মাহফুজ উল্লাহকে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ব্যাংককের হাসপাতালে নেওয়া হ‌য়।

খ্যাতিমান এই সাংবাদিক এবং লেখকের মৃত্যুতে দেশে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ।

শোকবার্তায় বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‌‌‌'মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে মরহুম মাহফুজ উল্লাহ সাহেবের বলিষ্ঠ ও সাহসী ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। স্বাধীন সাংবাদিকতায় বিশ্বাসী মরহুম মাহফুজ উল্লাহ বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার মহান ব্রতকে সামনে রেখে যেভাবে নিরলস কাজ করেছেন, সেটি তাঁর সতীর্থ সাংবাদিকরা চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে অনুসরণ করবেন বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।'

'মানুষের বাক-ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে তাঁর ধারালো লেখনি ও সাহসী উচ্চারণ দেশের মানুষের নিকট প্রশংসিত হয়েছিল। তাঁর লেখনি ছিল সবসময়ই সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার পক্ষে। তাঁর সততা, নিষ্ঠা ও কর্তব্যবোধ ছিল সর্বজনস্বীকৃত এবং প্রশ্নাতীতভাবে গৃহীত। সাংবাদিকতা জগতে তাঁর অবদান নি:সন্দেহে অনস্বীকার্য।'

তিনি বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের এই দু:সময়ে তাঁর মৃত্যু গণতন্ত্রকামী মানুষের হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করলো। তাঁর শুন্যতা সহজে পূরণ হবার নয়। পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করি তিনি যেন তাঁকে বেহেস্তবাসী করেন।'

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক শোকবার্তায় বলেছেন, ‘সরকারি ক্রোধের পরোয়া না করে গণতন্ত্রের পক্ষে তার উচ্চারণ ছিল শাণিত ও সুস্পষ্ট। বর্তমান দুঃসময়ে তার মতো একজন ঋজু ও দৃঢ়চেতা মানুষের বড়ই প্রয়োজন ছিল। দেশে ভয় ও শংকার বর্তমান পরিস্থিতিতে সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহর মতো মানুষের অনুপস্থিতি গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করবে।’

নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস শনিবার রাতে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লেখা এক শোকবার্তায় বলেন, সাংবাদিক ও লেখক মাহফুজ উল্লাহর আকস্মিক মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকাহত। জাতি একজন মূল্যবান প্রাণ হারালো। আমি তার শোকগ্রস্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি এবং তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তির জন্য পরম করুনাময়ের কাছে প্রার্থনা করছি।

জাতীয় প্রেস ক্লাব সভাপতি সাইফুল আলম ও সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন এক বিবৃতিতে প্রবীণ সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ-এর মৃত্যুতে গভীর শোক এবং দু:খ প্রকাশ করেছেন। নেতৃবৃন্দ মরহুমের শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।

মৃত্যুর খবর পেয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু চৌধুরী, বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ, ডা. এ. জেড. এম. জাহিদ হোসেন, জহির উদ্দিন স্বপন, শ্যামা ওবায়েদসহ আরো অনেকেই তার গ্রিন রোডের বাসায় যান।

মাহফুজ উল্লাহ ১৯৫০ সালের ১০ মার্চ নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যা ও সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে ঊনসত্তরের ১১ দফা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তী কালে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্র রাজনীতির কারণে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে তাঁকে ঢাকা কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

ছাত্রাবস্থাতেই মাহফুজ উল্লাহ সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বাংলাদেশের একসময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রার জন্মলগ্ন থেকেই তিনি এ পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মাঝে চীন গণপ্রজাতন্ত্রে বিশেষজ্ঞ হিসেবে, কলকাতায় বাংলাদেশ উপদূতাবাসে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় বাংলা ও ইংরেজি দৈনিকে কাজ করেছেন তিনি। রেডিও ও টেলিভিশনে অনুষ্ঠান উপস্থাপনাও করেছেন।

মাহফুজ উল্লাহ আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত একজন সক্রিয় পরিবেশবিদ এবং বাংলাদেশে তিনিই প্রথম পরিবেশ সাংবাদিকতা শুরু করেন।

বিভিন্ন বিষয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় লেখা মাহফুজ উল্লাহর বইয়ের সংখ্যা অর্ধ শতাধিক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো President Zia of Bangladesh : A political Biography, ULFA & THE INSURGENCY IN ASSAM, যাদুর লাউ, যে কথা বলতে চাই, অভ্যুত্থানের ঊনসত্তর, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন : গৌরবের দিনলিপি (১৯৫২-৭১)।

এমজে/এমআই/জিএস