সাংবাদিকদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন বন্ধের আহবান জানিয়েছে রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারস

সাংবাদিকদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন বন্ধের আহবান জানিয়েছে রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারস

নির্বাসিত হয়েও যেসকল সাংবাদিকরা নির্ভীক সাহসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যকলাপের সমালোচনা করছে তাদের ভয়-ভীতি দেখানো থেকে সরে আসতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রতি আহবান জানিয়েছে রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারস।

মঙ্গলবার বাংলাদেশে অব্যাহত সাংবাদিক দমন-নিপীড়ন ইস্যুতে দেয়া এক বিবৃতিতে এ আহবান জানায় সংস্থাটি। জাস্ট নিউজ পাঠকদের জন্য বিবৃতিটির অনুবাদ তুলে ধরা হল:

বাংলাদেশের যেসকল সাংবাদিক বিদেশে অবস্থান করে দেশের সংবাদ প্রচার করে যাচ্ছেন তাদের ভয় দেখাতে সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকে তাদের পরিবারের সদস্যদের উপর চাপ প্রয়োগ, জেল-মামলার হয়রানি এমনকি শারীরিক নির্যাতনও করছে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা। আর তাতে মদদ যোগাচ্ছে সরকার ।

রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারস এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিষয়ক প্রধান ডেনিয়েল ব্যস্টার্ড বলেন, "যে দলটি মুখে গণতন্ত্রের আদর্শের কথা বলে সেই দলের (আওয়ামী লীগ) কর্মী-সমর্থকদের দ্বারা প্রবাসে যেসকল সাংবাদিকরা কাজ করেন তাদের উপর সাম্প্রতিক নির্যাতনের যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত একটি বিষয়।"

আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হবার শুরু থেকে এই ১২ বছরে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের উপর এতে বেশী চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে যে এখন সেলফ সেন্সরশীপের বিষয়টি একটি স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ডেনিয়েল।

নির্বাসিত সাংবাদিকদের সকল রকমের সুরক্ষার আহবান জানিয়ে ডেনিয়েল আরও বলেন, "বাংলাদেশে যখন এসকল ঘটনা (সাংবাদিক নির্যাতন) ঘটে যাচ্ছে ঠিক তখনি বিদেশে থেকেও এসকল সাংবাদিকরা বাংলাদেশে বিষয়ে নিরপেক্ষভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেশের মানুষদেরকে তা দেখার সুযোগ করে দিচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষেই তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। খুবি গুরুত্বপূর্ণ এসকল সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সকল রকমের হয়রানি এবং ভীতি বন্ধ করতে আমরা আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাসহ দলটির সকল নেতাদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।"

বাংলাদেশ সরকারের সর্বশেষ টার্গেটের শিকার হয়েছিলেন নেত্র নিউজের সম্পাদক তাসনিম খলিল। ২০০৭ সালে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর নির্যাতনের স্বীকার হয়ে সুইডেনে পালিয়ে আসেন তিনি। এবছরের ১৮ই অক্টোবর ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের একটি মামলায় আদেশ দেয় যে বাংলাদেশে তাসনিম খলিলে সম্পত্তি তদন্তের জন্য বাজেয়াপ্ত করা হবে। একই আদালত সেপ্টেম্বর মাসে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে বসে।

ভয় দেখানোর নকশা

করোনাভাইরাস সংক্রান্ত প্রতিবেদনে সরকারের কর্মকান্ডের সমালোচনার করার দায়ে ভুল তথ্য প্রদান এবং দেশকে অপমানিত করার অভিযোগ এনে ১০ বছরের সাজা হতে পারে তাসনিম খলিলের। রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারসের তথ্য অনুসারে ২০২০ সালের মে মাসে একই মামলায় কার্টুনিস্ট আহমদ কবির কিশোর এবং লেখক মুশতাক আহমদকে গ্রেফতারের পর নির্যাতন করে পুলিশ।

দেশ থেকে পালিয়ে সুইডেনে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে নিজেকে নিরাপদ করার সুযোগ পেয়েছেন সাংবাদিক তাসনিম খলিল। মালমো শহরে থেকে স্বাধীন সাংবাদিকতার সুযোগ পেয়েছেন কিন্তু আহমেদ কবির কিশোরের ভাগ্যটা সেরকম ছিলোনা। কয়েকমাস ধরে বেআইনীভাবে জেলে রাখা এবং নির্যাতনের কারণে ফেব্রুয়ারি মাসে কারাগারে মারা যান তিনি।

তাসনিম খলিলকে নিয়ে আরও বাড়তি উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। গত ৭ অক্টোবর দেশের অভিযোগগুলোই সামনে রেখে অল ইউরোপীয়ান আওয়ামী লীগ সুইডিশ পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করে। তবে সুইডিশ পুলিশ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছে।

গণমাধ্যমে সংবাদপ্রচারের প্রভাবে ভীত হয়ে এমনটা করেছে আওয়ামী লীগ। এর আরেকটা পরিকল্পনা এমন হতে পারে যে, সরকারের দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশে সরব হওয়ায় তাসনিমকে ভয় দেখাতে এটা করেছে। তাসনিম সম্প্রতি জানিয়েছেন বাংলাদেশে অবস্থানরত তার মাকে প্রায়ই হয়রানি করছে প্রশাসন। ২০২০ সালের এক টুইটে তাসনিম বলেন, "পুলিশ এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তারা প্রায়ই আমার বাসায় যায়। মাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে এবং বলে যে আমি নাকি দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছি।"

পরিবার টার্গেট করা

বাংলাদেশে সাংবাদিক পরিবারের সদস্যরা এখনও ক্ষমতাসীন দলের প্রতিশোধ স্পৃহার শিকার। আর তার সর্বশেষ ভুক্তভোগী হলেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক কনক সারওয়ারের বোন নুসরাত শাহরিন রাকা। গত ৫ অক্টোবর তিন সন্তানসহ তাকে ঢাকার একটি বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। মুক্তির ৩০ ঘন্টা আগে পুলিশ হেফাজতে ছিল তার তিন সন্তান। ১১ অক্টোবর তার জামিন আবেদন নাকচ করে দেয়া হয়। মিথ্যা অভিযোগ এনে মাদক এবং ডিজিটাল সিকিউরিট অ্যাক্ট মামলায় তাকে জেলে আটকে রাখা হয়েছে। অভিযোগ আনা হয়েছে তিনি নাকি বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণায় তার ভাইকে সহযোগিতা করছেন।

২০১৫ সালে ইটিভিতে কাজ করার সময় বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সংবাদ প্রচার করার দায়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। মুক্তির পর তিনি নিউইয়র্কে চলে আসেন যেখান থেকে কনক সারওয়ার নিউজ নামে একটি অনলাইন চ্যানেল পরিচালনা করছেন।

প্রশ্ন করায় মারধর

বিদেশের মাটিতেও কেউ সরকারের কোন সমালোচনা করলে তা সহ্য হয়না আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের। তারা মারপিঠ শুরু করে দেয়। এ ঘটনার পুনারবৃত্তি দেখা যায় ২২ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের একটি সংবাদ সম্মেলনে। শেখ হাসিনার জাতিসংঘ সফর নিয়ে এ সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সাংবাদিক সম্মলেনে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক টিভি নেটওয়ার্ক এনসিএন সাংবাদিক ফরিদ আলম যখন প্রধানমন্ত্রী সফরের বিশাল বহর নিয়ে প্রশ্ন করেন সাথে সাথে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজক এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাকে চারদিক থেকে ঘিরে আক্রমণ শুরু করে। এমনকি তার মোবাইল ফোন এবং ওয়ালেট ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা চালায়। এঘটনার পর থেকে আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাকে অব্যাহতভাবে হুমকি দিয়ে আসছে বলে রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারসকে জানিয়েছেন সাংবাদিক ফরিদ আলম।

নির্বাসিত সাংবাদিকদের নিয়ে বাংলাদেশের সরকার এতটাই আতংকে আছে যে নিরপেক্ষ সাংবাদিক এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা যেন দেশ ছাড়তে না পারেন তার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাংবাদিক রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারসকে জানিয়েছেন সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় পুলিশ তার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করেছে।

তিনি জানেন, "আমার পাসপোর্ট জব্দ করার মূল উদ্দেশ্য হল যেন দেশের বাইরে না যেতে পারি। দুর্নীতি এবং অনিয়ম নিয়ে শত শত প্রতিবেদন প্রকাশ করায় তারা এখন ভীত। পাসপোর্ট জব্দ করার ঘটনাটা একেবারেই নতুন। এর আগে তারা কখনো এমন সাহস দেখানোর সুযোগ পেতোনা।"

রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারসের মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০ এর মধ্যে ১৫২।

কেএল/