‘ইভিএম সেনাবাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে’

‘ইভিএম সেনাবাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে’

ঢাকা, ২৪ নভেম্বর (জাস্ট নিউজ) : বিএনপিসহ দেশের সকল প্রধান প্রধান সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলেগুলোর আপত্তি উপেক্ষা করে এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিতর্কিত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করতে চাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানিয়েছেন কয়টি কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হবে, সে সিদ্ধান্ত হবে দু-একদিনের মধ্যেই।

বাংলাদেশে এর আগে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে বিতর্কিত এই ইভিএম ব্যবহার হয়েছে। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবারই প্রথম ইভিএম ব্যবহার করতে চাচ্ছে বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন। তফসিল ঘোষণার সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ কে এম নুরুল হুদা জানিয়েছিলেন, শহরাঞ্চলের কিছু ভোট কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। তবে ইভিএম-এর বিরোধিতা করে আসছে বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ সকল প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। এমনকি ক্ষমতাশীন ১৪ দলেরও অনেক নেতা-কর্মীরা ইভিএম’র বিরোধীতা করে আসছেন।

বিএনপি’র উদ্যোগে ঢাকায় বৃহস্পতিবার এ নিয়ে একটি সেমিনারও হয়। সেখানে তারা দাবি করেন ইভিএম’র মাধ্যমে ভোটে কারচুপি সহজ। আর আওয়ামী লীগকে কারচুপির সুবিধা করে দিতেই ইভিএম ব্যবহারে অনঢ় রয়েছে বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন। তারা সেখানে একটি ভিডিও ডেমোনেষ্ট্রেশনও করে।

তবে ঠিক কতটি কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হবে এবং কোথায় কোথায় ব্যবহার হবে সেটা এখানো প্রকাশ করেনি নির্বাচন কমিশন।

শুক্রবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ কে এম নুরুল হুদা জানান, ‘এবারে আমরা পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম ব্যবহার করব। সীমিত আকারে কয়টি আসনের কয়টি কেন্দ্রে আমরা ব্যবহার করব, সেই সিদ্ধান্ত শনিবারে নেবো।’

নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘শনিবার কমিশনে ইভিএম নিয়ে বৈঠক আছে। ওই বৈঠকেই কতটি আসনের কতগুলো কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার হবে, তা চূড়ান্ত হতে পারে।’

বৃহস্পতিবার বিএনপির সেমিনারে দলটির তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম দাবি করেন, ‘ইভিএম-এ তিনভাবে কারচুপি হতে পারে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর সব ভোট একটি প্রতীকে দেখানো সম্ভব। গণনার সময় কোনো একটি প্রতীকে ভোট বেশি দেখানো সম্ভব। আর তৃতীয় হলো আগে থেকেই ভোটের ফল নির্ধারণ করে দেয়া সম্ভব।’ তবে কতটি কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করলে তা ভোটের ফলাফলে প্রভাব ফেলবে তা স্পষ্ট নয়।

বিএনপি’র নওগাঁ এলাকার নেতা এবং বিএনপি থেকে নির্বাচন করার প্রত্যাশী ফজলে হুদা বাবুল বলেন, ‘ইভিএম একটি যন্ত্র এবং এর পিছনে মানুষ থাকে। তাই তিনি ইচ্ছে করলে এর মাধ্যমে ফল প্রভাবিত করতে পারবেন। আর বাংলাদেশের মানুষ শিক্ষিত নয়। ফলে তাকে এর ব্যবহার বোঝানো এত সহজ নয়। ভারতেই এটা সফল হয়নি, বাংলাদেশে কিভাবে হবে।’

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এবার শহরাঞ্চলে ব্যবহার হবে। শহরাঞ্চলেও অধিকাংশ ভোটার শিক্ষিত নয়। তারা বস্তিবাসী ও খেটে খাওয়া মানুষ।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন-এর প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘ইভিএম ব্যবহারে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে। কারণ, এটা অংশীজনদের সামনে দেখানো হয়নি। উন্মূক্ত করা হয়নি। এক্সপার্ট নিয়ে মূল্যায়ন করা হয়নি। এর গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে জনমত যাচাইয়ের ব্যবস্থাও হয়নি। তাছাড়া আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থার মধ্যে অনেক সমস্যা আছে। সেগুলো সংশোধন না করে ইভিএম কেন? ইভিএম-এর ব্যবহার আমাদের সেনাবাহিনীকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে, কারণ, তারা ইভিএম প্রক্রিয়ায় যুক্ত।’

এরই মধ্যে ঢাকাসহ সব বিভাগীয় শহরে ইভিএম প্রদর্শনী করেছে নির্বাচন কমিশন। এটাকে ডেমোনস্ট্রেশন বলা যায় কিনা, জানতে চাইলে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘এটা তো পাবলিক শো। সাধারণ মানুষ ওই শো-র মাধ্যমে কিভাবে এর সমস্যা বুঝবে? ওখানে এক্সপার্ট ও অংশীজনদের ডাকা হয়নি।’

বৃহস্পতিবার সেমিনারে ইভিএম নিয়ে ডেমোনষ্ট্রেশন উপস্থাপনকারী বিএনপি'র তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম শুক্রবার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘ইভিএম সোর্স কোডের মাধ্যমে চালিত হয়। এই সোর্স কোড পরিবর্তন করে দিলে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে এটা ব্যবহার করে ফলাফল পরিবর্তন করে দেয়া যায়। আর এটার ভিতরে একটা চিপ থাকে, এই চিপ পরিবর্তন করে দিলে নতুন চিপে যে ডাটা থাকবে, তাই দেখাবে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশনকে এ নিয়ে এটা রিপোর্ট দেবো। আর আমরাই ইভিএম মেশিন চাইবো। আমরা ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেখিয়ে দিতে পারবো কতভাবে কারচুপি করা যায়। আমরা এটা সাধারণ মানুষকেও দেখাতে চাই। আমরা আগে বলেছিলাম। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তাদের কাছে গিয়ে দেখাতে বলে। আমরা এটা প্রকাশ্যে করে দেখাতে চাই।’

বিএনপি'র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীও বৃহস্পতিবার ইভিএম নিয়ে বিএনপি’র সেমিনারে কথা বলেন। তিনি শুক্রবার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমি তো বলেছি, এটা মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়ার একটা ব্যবস্থা। দেশের মানুষ এই জন্যই তো দেখেনি। এখানে পেপার ডকুমেন্ট নেই। মানুষ আগে এক হাতে ভোট দিত, এখন দু’হাতে ভোট দেবে। পৃথিবীর কোনো দেশে ইভিএম গ্রহণযোগ্য হয়নি।’

রিয়াজুল ইসলাম জানান, ‘ঐক্যফ্রন্টের নেতারা ইভিএম-এর বিরুদ্ধে মামলা করার কথাও বলেছেন। তারা মামলা করতে পারেন।’

এর জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার শুক্রবার বলেছেন, ‘যারা মামলা করবে, এটা তাদের ব্যাপার, আমার কিছু বলার নেই। আমরা ইভিএম সীমিত আকারে ব্যবহার করব। এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।’

আর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘বিএনপি ইভিএম-এর মাধ্যমে যে তিন স্তরের কারচুপির কথা বলেছে, সেটা তাদের ব্যাপার। তারাই সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে পরবে। ইভিএম-এ ভোটের সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনের। আমাদের দলের অবস্থান হলো, বাংলাদেশ তথ্য প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা ইভিএম কেন ব্যবহার করব না?’

নির্বাচন কমিশন এ পর্যন্ত ৩৫০টি ইভিএম কিনেছে। প্রায় দুই লাখ টাকা মূল্যে একেকটি ইভিএম মেশিন কিনতে কমিশনকে মোট সাত কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে। আর ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেড় লাখ ইভিএম কিনতে তিন হাজার ৮২৯ কোটি সাত লাখ টাকার প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

(জাস্ট নিউজ/এমআই/১২১২ঘ.)