উপজেলা নির্বাচনে ভোটের হাহাকার

এমন ভোট আগে দেখেনি বাংলাদেশ

এমন ভোট আগে দেখেনি বাংলাদেশ

ভোট কেন্দ্র, ভোট বাক্স, নির্বাচনী কর্মকর্তাসহ আয়োজনে কোনো কিছুর কমতি নেই। তবু দেখা মিলছেনা ভোটারের, এমন হাহাকার এর আগে দেখেনি বাংলাদেশ। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে যখন দেখা মিলছেনা ভোটারের তখন আয়েস কত প্রকার ও কি কি যেন তারি চর্চার নমুনা দেখা গেছে সোমবারের উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার ভোট গ্রহণের দিনটাতে। শুধু কি তাই কেন্দ্রের আঙ্গিনায় যেখানে ভোটারদের সারি থাকার কথা, তাদের পদচারণায় চারপাশ মুখর হবার কথা সেখানে অলস পাহারায় সঙ্গ দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ কুকুরগুলোও, কেন্দ্রের ছবিগুলো সে কথাই বলে।

প্রথম দফার নির্বাচনী ভোটের সাড়ায় হতাশ হবার পর এবার প্রশাসন আরেকটু আগ বাড়িয়ে মাইকে প্রচারণা চালিয়েছিলো যাতে ভোটাররা কেন্দ্রে আসে। সেই টনিকেও কোনো কাজ হয়নি। ভোট দেবার যে অনুপাত তাতে সহজেই বুঝা যায়, সরকার দলীয় ভোটাররাও যাচ্ছেননা ভোট দিতে। আর ভোটের এ পরিস্থিতিকে গণতন্ত্রের অশনি সংকেত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

৩০ ডিসেম্বরের ভোট কারচুপির পর থেকে প্রধান বিরোধীদল বিএনপিসহ অন্যদলগুলোর ভোট বর্জনের কারণে ভোটাররা আর সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনেই আস্থা পাচ্ছেননা। তারি প্রভাব পড়েছে উপজেলা নির্বাচনে।

বিভিন্ন উপজেলার ভোটের আজকের কিছু চিত্র পাঠকদের জন্য তোলে ধরা হলো:

ভোটারের অপেক্ষা কিন্তু ভোটার আসছে না

সকাল পৌনে ১০টা। বগুড়ার প্রাণকেন্দ্র সাতমাথার জিলা স্কুল জনমানব শূন্য। নিরাপত্তা প্রহরী কয়েকজন ব্রেঞ্চে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন। বুথের ভেতরে গিয়েও দেখা গেলো একই চিত্র। সবাই অপেক্ষা করছেন ভোটারের। কিন্তু কোন ভোটার আসছে না। ফলে গল্পগুজবেই সময় কাটিয়েছেন এজেন্ট এবং নির্বাচন কর্মকর্তারা। এই কেন্দ্রে মোট ভোটার ১৯৭৫। দুই ঘন্টায় ভোট পড়েছে মাত্র ৬টি।

একই চিত্র দেখা গেলো শহরের নারুলী উত্তরণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বগুড়া সদর উপজেলার সব চেয়ে বেশি ভোট এই কেন্দ্রে। মোট ভোটার ৬ হাজার। সাড়ে আটটা পর্যন্ত ওই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে মাত্র ১টি।

গাবতলী উপজেলার চকবোচাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার আবদুল মতিন জানান, সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে মাত্র ৪টি। এই কেন্দ্রে নৌকা মার্কা ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীদের এজেন্ট খুঁজে পাওয়া যায়নি।

শাজাহানপুর মাঝিড়া মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২ ঘন্টায় ১২৩ ভোট। মোট ভোটার ৩৬০৮। আদমদীঘি উপজেলার কুসুম্বী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার রবিউল আলম জানান, ২৭১৪ জন ভোটারের মধ্যে সকাল ৯টা পর্যন্ত শতকরা ১ দশমিক ৪৭ ভাগ অর্থাৎ ৪০ ভোট কাস্ট হয়েছে।

আদমদীঘি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে নৌকা মার্কার প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হওয়ায় এই উপজেলায় ভোট প্রদানে ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ একেবারেই কম। সারিয়াকান্দি উপজেলার নিজ বলাইল উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রেও একই চিত্র দেখা গেছে। এই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার হাবিবুর রহমান আকন্দ জানান, ৩৯৪০ ভোটের মধ্যে সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ২০ ভোট পড়েছে।

সকাল ৯টায় শহরের ঝোপগাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ১০টি ভোট পড়েছে বলে জানান প্রিসাইডিং অফিসার আবদুল মতিন। এই কেন্দ্রে ২৩৩৫ ভোটার রয়েছে। এখানে নৌকা মার্কার এজেন্ট দেখা গেলেও বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীর মোটরসাইকেল মার্কার কোনো এজেন্ট নেই। শহরের মালতিনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। ভোটার উপস্থিতি না থাকার কারণে তারা নিজেদের মধ্যে খোশ গল্প করে সময় কাটাচ্ছেন।

প্রিসাইডিং অফিসার আলমগীর হোসেন জানান, ভোটার উপস্থিতি একেবারেই নাই। সকাল ৯টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে মাত্র ৪টি। 

৫ ঘণ্টায় আসেননি ১জনও

ফটিকছড়ি উপজেলার দু’টি কেন্দ্রে পাঁচ ঘণ্টায়ও ভোট দিতে আসেনি কোন ভোটার। ফলে ভোটের বাক্সগুলোও পড়ে আছে ফাঁকা। এ দুই কেন্দ্রের মোট ভোটার ৫৩৬০ জন।

কেন্দ্রগুলো হচ্ছে- কাঞ্চননগর রুস্তুমিয়া মুনিরুল ইসলাম দাখিল মাদ্রাসা ও শাহনগর উচ্চবিদ্যালয় ভোট কেন্দ্র। কাঞ্চননগর রুস্তুমিয়া মুনিরুল ইসলাম দাখিল মাদ্রাসা ভোট কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার আলমগীর কবির শাহনগর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো. ইব্রাহিম এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

আলমগীর কবির এ প্রসঙ্গে বলেন, আমারটা হচ্ছে মহিলা ভোট কেন্দ্র। সকাল ৮টা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হলেও দুপুর ১টা পর্যন্ত কোনো ভোটার কেন্দ্রে আসেনি। ফলে পাঁচ ঘণ্টায়ও একটি ভোট কাস্ট হয়নি। ভোটাররা কেন আসছে না সেটি তিনি জানেন না বলে জানান।
তিনি জানান, এ কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা ২ হাজার ৬৫০ জন। কিন্তু কোনো ভোটার না আসায় পোলিং এজেন্টরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। ফলে ব্যালট বাক্সগুলোও খালি পড়ে আছে।

কেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী গ্রামে মুন্নুজান বেগম নামে এক নারী ভোটার বলেন, গত এমপি নির্বাচনে ভোট দিতে পারিনি। উপজেলা নির্বাচনে ভোট দিয়ে কি লাভ? তাই এবারও ভোট দিতে কেন্দ্রে যাব না।

একইভাবে ফটিকছড়ি উপজেলার শাহনগর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রিজাইডিং অফিসার মো. ইব্রাহিম বলেন, আজ সকাল ৮টা থেকে পোলিং এজেন্টরা কেন্দ্রে ভোটগ্রহণের অপেক্ষায় থাকলে ভোটার নেই। দুপুর একটা পর্যন্ত এ কেন্দ্রে কেউ ভোট দিতে আসেনি। 

দুপুর পর্যন্ত ভোট পড়েনি একটিও!

মৌলভীবাজার পৌর শহরের কাশিনাথ আলাউদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজকেন্দ্রে সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৯টি বুথের মধ্যে দুটি বুথে ১টিও ভোট পড়েনি। এমনটি জানিয়েছেন কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা প্রিসাইডিং অফিসার নীলাদ্রি শেখর দাস।

তিনি বলেন, ভোটারদের অপেক্ষায় আছেন বুথের দায়িত্বে থাকা পোলিং অফিসাররা। তবে ওই সেন্টারের ৯টি বুথে ২ হাজার ৯৯৭ ভোটারের মধ্যে ২২ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। ওই কেন্দ্রের ৩নং ও ৯নং বুথে ১টিও ভোট পড়েনি।

শহরের পিটিআইসংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা প্রিসাইডিং অফিসার মো. মাজহারুল মজিদ জানান, তিন হাজার ৩৯০ ভোটের মধ্যে ৬২ ভোট পড়েছে।

বেলা সোয়া ১১টা পর্যন্ত পৌরসভা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে তিন হাজার ২০০ ভোটের মধ্যে ১১০টি ভোট পড়ে।

হাফিজা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে বেলা ১১টা পর্যন্ত তিন হাজার ৫৮৫ ভোটের মধ্যে ১২৮টি ভোট পড়ে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার রাজনগর, কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা, কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলায়ও ভোটারের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ ভোট নিয়ে ভোটারদের তেমন আগ্রহ নেই।

ভোটার নেই তাই ঘুমে নিরাপত্তা কর্মীরা

সোমবার বেলা পৌনে ২টা। চলছে পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোটগ্রহণ। বগুড়া শহরের মধ্যে নারুলী উত্তরণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল একটি স্কুলের মধ্যেই চারটি কেন্দ্র।

এই কেন্দ্রের মাঠ পুরোটাই ফাঁকা। দায়িত্বরত আনসার সদস্য বেঞ্চের ওপর ঘুমাচ্ছেন। বগুড়া সদর উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোটারের ভোটকেন্দ্র এটি। এখানকার মোট ভোটার ৯ হাজার ৪৪৭টি। বেলা পৌনে ২টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টায় এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে মাত্র ২৮৪টি।

নারুলী উত্তরণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের একটি অংশের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিখিল চন্দ্র বসাক। তিনি জানালেন, তার কেন্দ্রে ২৮৪৪ জন মহিলা ভোটার। বেলা পৌনে ২টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ২৪টি। ভোটার উপস্থিতি একেবারেই কম।

তার পাশের কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মাহবুব আলম জিলানী। তার কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা ২০৪৯ জন। সবাই পুরুষ। বেলা পৌনে ২টা পর্যন্ত তার কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ১০৯টি। তার কেন্দ্রেও ভোটার উপস্থিতি কম।

অন্য কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আব্দুল কাদের। তার কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা ২২০০ জন। সবাই মহিলা ভোটার। বেলা পৌনে ২টা পর্যন্ত তার কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৫০টি।

এই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা একেএম নাজমুল হুদা জানান, তার কেন্দ্রে পুরুষ ভোটার সংখ্যা ২৬৫৪ জন। বেলা পৌনে ২টা পর্যন্ত তার কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ১০০টির মতো।

ভোটকেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত আনসার সদস্যদের একজন আব্দুর রহিম। তিনি বলেন, কেন্দ্রে ভোটার নাই, বসে থেকে কাজ নাই। চোখে ঘুম, তাই কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছেন। প্রচণ্ড রোদের সঙ্গে গরম আবহাওয়া। কেন্দ্রে ভোটার না থাকায় অলস সময় পার করছি আমরা। এই অবস্থায় একটু ঘুম পাওয়ারই কথা।

ফাঁকা কেন্দ্রগুলোতে ভোট গ্রহণের দায়িত্বে নিয়োজিতরা খোশগল্প করে সময় কাটাচ্ছেন। কয়েকটি কেন্দ্রে দেখা গেছে, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা/কর্মচারী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ছাড়া কেউ নেই। এমনকি নৌকা ছাড়া অন্য প্রার্থীদের এজেন্টও খুঁজে পাওয়া যায়নি এসব ভোট কেন্দ্রে।

খাগড়াছড়িতে ভোটার নেই, আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

সকাল সাড়ে ৯টায় খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ভোটারশূন্য।

কেন্দ্রের বাইরে কয়েকজন ভোটার জানান, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী থাকলেও এমন ঠাণ্ডা ভোট আর দেখেনি। সকাল ৯টায় মাটিরাঙ্গার সাপমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কেন্দ্রে বেশ কয়েকজন নারী ভোটার থাকলেও পুরুষ ভোটার চোখে পড়েনি।

তবে এ সময় কেন্দ্রে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য ভোটকেন্দ্র পাহারা দিচ্ছে। এ ছাড়া র‌্যাব ও পুলিশের টহল টিমের একটি বহর কেন্দ্রটি পরিদর্শন করে।

এদিকে ভোট সুষ্ঠু করতে নিরাপত্তা জোরদার করেছে প্রশাসন। পুলিশ, বিজিবির পাশাপাশি স্টাইকিং ফোর্স হিসেবে মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনী।

প্রতি উপজেলায় দুই প্লাটুন করে বিজিবি মোতায়েন আছে। দীঘিনালা, পানছড়ি ও লক্ষ্মীছড়ি উপজেলাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে সেখানে আরও দুই প্লাটুন করে অতিরিক্ত বিজিবি মোতায়েন রয়েছে।

এমজে/এমআই/জিএস