ব্যবসায়ী ও চলচ্চিত্র প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের গুলশানের বাসায় অভিযান চালিয়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। এখানে মিনি বার ও ক্যাসিনোর সরঞ্জাম পেয়েছেন তারা। এই ক্যাসিনোটিতে বাংলাদেশি মুদ্রায় নয়, খেলা হতো মার্কিন ডলারে।
এক সেন্ট থেকে একশ’ ডলারসম মূল্যের কয়েন উদ্ধার হয়েছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অভিযানে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ, গাঁজা, সিসা ও ক্যাসিনো সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। রোববার বিকালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক খুরশিদ আলমের নেতৃত্বে অভিযান চলে।
এ সময় নবীন মন্ডল ও পারভেজ নামে দুই কেয়ারটেকারকে আটক করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে আজিজ মোহাম্মদ ভাই পলাতক। বাসাটির দেখাশোনা করেন আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ভাই ও বোন।
বিকাল সাড়ে চারটা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত টানা অভিযান চলে। এরপর মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক ফজলুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ৬ ঘণ্টার অভিযানে এ দুটি বাড়ি থেকে ৩৯০ বোতল বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিলাতি মদ, ২৪ ক্যান বিয়ার, ৪ কেজি সিসা, ২০০ গ্রাম গাঁজা, ৩টি হুঁকা, ২শ’ গ্রাম গাঁজা ও ক্যাসিনো সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। অপর এক কর্মকর্তা বলেন, এ বাসায় ক্যাসিনো এবং ছাদে মিনি বার এবং মদের গুদামের সন্ধান পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন ক্যাসিনোতে অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এগুলোতে খেলা চলত বাংলাদেশি মুদ্রায়। কিন্তু এই বাসার ক্যাসিনোতে খেলা হতো ডলার দিয়ে। এখানে এক সেন্ট থেকে একশ’ ডলার সমমানের কয়েন পাওয়া যেত। এই কয়েন দিয়েই খেলা চলত। খেলা শেষে কয়েনের বিপরীতে ডলার দেয়া হতো। এতেই বোঝা যায়, এখানে হাইপ্রোফাইল মানুষ খেলতে আসতেন।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপপরিদর্শক মোশারফ হোসেন বলেন, ক্যাসিনোটিতে সব ধরনের আধুনিক সুবিধা রয়েছে, এটি খুবই সুসজ্জিত। এখানে যারা খেলতে আসতেন তাদের মদ থেকে শুরু করে সিসা, গাঁজাসহ চাহিদামতো সব ধরনের মাদক সরবরাহ করা হতো বলে জানান ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, ১১/এ এবং ১১/বি নম্বর দুটি ভবনে একযোগে অভিযান শুরু হয়। ১১/এ ভবনের ছাদে ছিল মদের মিনিবার। এখানে আলমারিতে সারিবদ্ধভাবে মদ সাজানো ছিল।
এছাড়া বিভিন্ন কক্ষে সিসা বারের সরঞ্জাম এবং ক্যাসিনোতে ব্যবহৃত কয়েন, কার্ড ও ঘুঁটি পাওয়া গেছে। অপর ভবনের চারতলার একটি কক্ষে পাওয়া গেছে বিপুল পরিমাণ মদ, সিসা ও বিয়ার।
বাড়ির কেয়ারটেকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১১/এ নম্বর পাঁচতলা বাড়ির চতুর্থতলায় থাকেন আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের এক স্ত্রী নওরীন মোহাম্মদ। একই ভবনের দ্বিতীয় তলায় তার ভাতিজা (মৃত রাজা মোহাম্মদ ভাইয়ের ছেলে) আহাদ মোহাম্মদ পরিবার নিয়ে থাকেন।
ওই ভবনের তৃতীয়তলা খালি ও পঞ্চমতলাটি তালাবদ্ধ। ১১/বি নম্বর ভবনের নিচতলা খালি থাকলেও দ্বিতীয়তলায় থাকেন আজিজের ছোট বোন সাকিনা মোহাম্মদের ছেলে সামাদ মোহাম্মদ।
তৃতীয়তলায় অপর ভাগ্নে ইয়াবা সম্রাট আমিন হুদার স্ত্রী মিতু হুদা, চতুর্থতলায় আমিন হুদার মা ও নূরজাহান মোহাম্মদ এবং পঞ্চমতলায় সাকিনা মোহাম্মদ থাকেন।
অবশ্য অভিযানের সময় সাকিনা মোহাম্মদ ছাড়া এসব পরিবারের কোনো সদস্যকেই পাওয়া যায়নি। সাকিনা মোহাম্মদের ফ্ল্যাটে কিছু না পাওয়ায় তাকে আটক করা হয়নি।
বাড়ির কেয়ারটেকার নবীন মন্ডল বলেন, মিনি বার ও মদের গুদামের মালিক আজিজের ভাগ্নে আহাদ। দুই দিন আগে আজিজের স্ত্রী নওরীন ও ভাগ্নে আহাদ বিদেশ চলে গেছেন। দুটি বাড়ির প্রায় সব সদস্যই মাসের বেশিরভাগ সময় বিদেশ থাকেন।
অপর কেয়ারটেকার পারভেজ জানান, মদের বার বা মদের গুদামে তাদের যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা ছিল। এজন্য এসব জায়গায় কি হতো তা তিনি জানেন না। তিনি আজিজ মোহাম্মদের নাম শুনলেও এই ভবনে তাকে কখনও দেখেননি।
প্রসঙ্গত, দেশের চলচ্চিত্র জগতের বহুল পরিচিত মুখ এবং আলোচিত-সমালোচিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই। নামের সঙ্গে ভাই শব্দটি তাদের বংশ পদবি। তাদের পরিবারের সবার নামের শেষেই এই পদবি আছে। তার বাবার নাম মোহাম্মদ ভাই। মায়ের নাম খাদিজা মোহাম্মদ ভাই।
১৯৪৭-এ দেশভাগের পর তাদের পরিবার ভারতের গুজরাট থেকে বাংলাদেশে আসে। পরিবারটি মূলত পারস্য বংশোদ্ভূত। তারা বাহাইয়ান সম্প্রদায়ের লোক। বাহাইয়ানকে সংক্ষেপে বাহাই বলা হয়।
উপমহাদেশের উচ্চারণে এই বাহাই পরবর্তী সময়ে ভাই হয়ে যায়। ধনাঢ্য এই পরিবার পুরান ঢাকায় বসবাস শুরু করে। ১৯৬২ সালে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের জন্ম হয় আরমানিটোলায়।
তিনি মূলত একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। প্রায় ১১টি ইন্ডাস্ট্রির মালিক তিনি। এছাড়া মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুরে রয়েছে তার উঁচুমানের রিসোর্ট।
১৯৯৬ সালে প্রতারণার মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ ও আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে বিএসইসি।
এই শেয়ার কেলেঙ্কারির মামলায় গত বছরের ২৯ আগস্ট আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা (ওয়ারেন্ট) জারি করেন ঢাকার একটি ট্রাইব্যুনাল। এখন তিনি পলাতক রয়েছেন।
এমজে/