দুই পুলিশ কর্মকর্তা মাদক পাচারে, প্রশ্নবিদ্ধ ওসি

দুই পুলিশ কর্মকর্তা মাদক পাচারে, প্রশ্নবিদ্ধ ওসি

মাদক চোরাচালানে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে গত এপ্রিলে ঢাকা রেলওয়ে থানার এসআই নজরুল ইসলাম এবং এটিএসআই রবিউল হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করে র‌্যাব। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হওয়ার পরও কোনো ব্যবস্থা নেননি ঢাকা রেলওয়ে থানার তৎকালীন ওসি ইয়াছিন ফারুক মজুমদার। এমনকি তিনি বিষয়টি দীর্ঘদিন গোপন রাখেন। রেলওয়ে পুলিশের তদন্তে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

ঢাকা রেলওয়ে সার্কেলের এএসপি ওমর ফারুক গত নভেম্বরের শুরুতে এই প্রতিবেদন রেলওয়ে পুলিশের সদর দপ্তরে জমা দেন। এই তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছে রেলওয়ে পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র। এরই মধ্যে মাদক চোরাচালানে জড়িত দুই কর্মকর্তাকে তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রেলওয়ে পুলিশের পশ্চিম বিভাগে সংযুক্ত করা হয়।

এদিকে মাদক মামলার তদন্ত করে এই দুই পুলিশ সদস্যের জড়িত থাকার অভিযোগে গত ১০ নভেম্বর আদালতে চার্জশিট জমা দেয় র‌্যাব-৪।

র‌্যাব জানায়, প্রযুক্তিগত তদন্তে উঠে এসেছে, এসআই নজরুল এবং এটিএসআই রবিউল মাদক চোরাচালানে সরাসরি জড়িত। তাদের সহযোগিতায় ট্রেনে করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে চোরকারবারিরা রাজধানীতে মাদকের চালান নিয়ে আসত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এএসপি ওমর ফারুক বলেন, ঢাকা রেলওয়ে থানার সাবেক ওসি ইয়াসিন ফারুকের বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগের বিষয়ে জানতে চায় রেলওয়ে পুলিশ সদর দপ্তর। আমি তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।

রেলওয়ে পুলিশ সূত্র জানায়, সাবেক ওসি ইয়াছিন ফারুক মজুমদারের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ ওঠার পর গত জুলাইয়ের শুরুতে

তদন্ত শুরু করেন এএসপি ওমর ফারুক। তিনি নভেম্বর মাসের শুরুতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। সেখানে উঠে আসে মাদক চোরাচালানে সরাসরি জড়িত জেনেও অধীনস্থ কর্মকর্তাদের তিনি নিয়ন্ত্রণ করেননি।

তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত এপ্রিলে এসআই নজরুল ও এটিএসআই রবিউলের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা করে র‌্যাব। ওই মামলায় তাদের ৫ এবং ৬ নম্বর আসামি করা হয়। তৎকালীন ওসি ইয়াছিন ফারুক মজুমদার বিমানবন্দর থানায় গিয়ে ওই থানার ওসির সঙ্গে আলোচনা করে মামলার এজাহারের কপি সংগ্রহ করেন। এজাহারে উল্লিখিত নজরুল এবং রবিউলের নাম ঠিকানা সম্পর্কে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ওসি এর সত্যতাও পান। তবে তিনি সুকৌশলে বিষয়টি গোপন করেন। ইয়াছিন ফারুক মজুমদার বর্তমানে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) কর্মরত। তিনি ৭ অক্টোবর ২০১৬ থেকে ১ জুলাই ২০১৯ পর্যন্ত ঢাকা রেলওয়ে থানার ওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

তদন্ত প্রতিবেদনে এএসপি ওমর ফারুক উল্লেখ করেন, পুলিশ সদস্য হিসেবে এসআই নজরুল এবং এটিএসআই রবিউলের অপরাধ দমন এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করার কথা। অথচ তাদের বিরুদ্ধে মাদক চোরাচালানে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। তাদের এমন ঘৃণিত কর্মকা- পুলিশ বাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে। ইয়াছিন ফারুক ওসির মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে তার অধীনস্থদের সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান এবং দৈনন্দিন কাজের তদারকি করেননি। তাদের নিয়ন্ত্রণ না করে উল্টো মাদক চোরাচালানে জড়িত থাকার বিষয়টি গোপন রাখেন। এটি তার দায়িত্বে অবহেলা এবং অসদাচরণের শামিল।

এ বিষয়ে ঢাকা রেলওয়ে থানার সাবেক ওসি ইয়াছিন ফারুক মজুমদার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তদন্তের বিষয়ে তিনি কিছু জানতেন না। তাকে না জানিয়ে এবং তার কোনো বক্তব্য না নিয়ে এএসপি ওমর ফারুক তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিয়েছেন।

রেলওয়ে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৩ এপ্রিল সকাল ৭টায় চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ওয়ান আপ মেইল ট্রেনটি বিমানবন্দর স্টেশনের ৪ নম্বর লাইনের ২ নম্বর প্ল্যাটফরমে থামে। ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, র‌্যাব ৪-এর ৫-৬ জন সাদা পোশাকে ৩ জন আসামিসহ ৪টি ব্যাগে ৪৫ কেজি গাঁজা উদ্ধার করে ট্রেন থেকে নামেন। এ সময় ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই নজরুল পাশেই ছিলেন। উদ্ধার হওয়া গাঁজা সম্পর্কে তার কাছে তথ্য ছিল কিনা এ বিষয়ে তিনি র‌্যাব সদস্যদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা করেননি। কমলাপুর থানার এটিএসআই রবিউল ওই ট্রেনের ডিউটিতে ছিলেন। তার পরও তিনি গাঁজা উদ্ধার করতে পারেননি। এসআই নজরুল সাধারণ ডায়েরি (জিডি) মূলে তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি তৎকালীন ওসি ইয়াছিন ফারুককে জানান। কিন্তু ওসি কোনো ব্যবস্থা নেননি। কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকেও বিষয়টি জানাননি। পরদিন ১৪ এপ্রিল র‌্যাব ৪-এর পরিদর্শক গোলাম ইয়াজদানী এসআই নজরুল ও এটিএসআই রবিউলসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন। মামলা দায়েরের দুই মাস ১০ দিন পর ২৩ জুন র‌্যাব ৪-এর পরিচালকের অফিসের একটি চিঠির মাধ্যমে বিষয়টি রেলওয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবগত হন।

মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মদন সরকার, ইউসুফ আলী, মজিবুর রহমান এবং রাশেদ নামে চার মাদক কারকারি ঘটনার দিন চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ওয়ান আপ মেইল ট্রেনে গাঁজার বড় চালান নিয়ে আসেন। তাদের চালানটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে নিয়ে আসা হয়। মাদকের চালানটি নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে সরাসরি সহায়তা করেন ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তা। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সেদিন তিনজনকে ৪৫ কেজি গাঁজাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে দুই পুলিশ কর্মকর্তার নাম উঠে আসে। পরে তদন্তেও তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাব ৪-এর কর্মকর্তা এসআই আবু সাঈদ বলেন, গ্রেপ্তার তিন আসামি, রেলওয়ে পুলিশের দুই কর্মকর্তাসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে ১০ নভেম্বর আদালতে চার্জশিট দিয়েছি। তদন্তে মাদক চোরাচালানে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। বিশেষ করে প্রযুক্তিগত তদন্তে মাদককারবারিদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের তথ্য মিলেছে। এ চক্রটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকা থেকে মাদক নিয়ে আসত। উদ্ধার হওয়া চালানটি ঢাকায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে দুই পুলিশ কর্মকর্তার সহযোগিতার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানান।সূত্র : আমাদের সময়

এমজে/