শফিক রেহমান

‘কখনো ভাবিনি যে এই ভালোবাসা দিবস এত বড় রূপ নেবে’

‘কখনো ভাবিনি যে এই ভালোবাসা দিবস এত বড় রূপ নেবে’

বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকের আগে কখনো ‘ভ্যালেন্টইন্স ডে’ উদযাপনের কথা শোনাই যায় না। এরকম একটি দিন যে তখন পশ্চিমা দুনিয়ায় পালিত হতো, সেই খবরও জানতেন খুব কম মানুষ। বাংলাদেশে এই দিনটিকে ‘ভালোবাসা দিবস’ হিসেবে উদযাপনের রীতি চালু করার কৃতিত্ব যাকে দেয়া হয়, তিনি হচ্ছেন সাংবাদিক শফিক রেহমান।

তাঁর সম্পাদিত যায় যায় দিন পত্রিকা ১৯৯৩ সালে প্রথম এই দিনটিকে উপলক্ষ করে বিশেষ ‘ভালোবাসা সংখ্যা’ বের করেছিল। দিনে দিনে বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবস রীতিমত উৎসবে রূপ নিয়েছে। বিবিসি বাংলার পুলক গুপ্তের কাছে তিনি বর্ণনা করেছেন কিভাবে প্রথম তিনি ভালোবাসা দিবস উদযাপনের কথা ভেবেছিলেন-

‘আমার প্রিয় একজন শিল্পী হচ্ছেন মান্না দে। শুধু তিনি নন, আরো অনেক প্রিয় শিল্পী আর গীতিকারের গাওয়া গানের কিছু কলি আমি আমার ঢাকার বাড়ির দেয়ালের বাইরে লিখে রেখেছিলাম। একদিন দেখি, এক ফোকলা দাঁতের বৃদ্ধ ফেরিওয়ালা, প্রায় অর্ধ উলঙ্গ, দাঁড়িয়ে এই লেখাগুলো পড়ছিলেন। তার মাথায় একটা ঝাঁকায় শিশি-বোতল থেকে নানা কিছু।’

আমি তখন বাইরে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি যে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই লেখাগুলো পড়লেন, বলুনতো, কোন লেখা আপনার সবচেয়ে ভালো লাগলো। তখন তিনি বললেন, এই কথাগুলো তার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে-

‘হৃদয় আছে যার, সেই তো ভালোবাসে
প্রতিটি মানুষের জীবনে প্রেম আসে।’

ফেরিওয়ালার মুখে একথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমার মনে হলো, একজন গরীব মানুষ, সে এই কথা বললো? এর মানে তারও জীবনে নিশ্চয়ই প্রেম এসেছিল। আমরা যারা সমাজের উপরের তলার মানুষ, আমরা যারা লিখি, তারা হয়তো বুঝি না, আমাদের সাধারণ মানুষের জীবনে কিভাবে প্রেম আসে। তখন আমি ঠিক করলাম বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবাসার মানে বোঝাতে হবে।

১৯৯৩ সালে আমি তখন ঢাকায় যায় যায় দিন পত্রিকাটি প্রকাশ করছি। সেবছরের ১৪ই ফেব্রুয়ারী ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ সামনে রেখে আমরা একটি বিশেষ সংখ্যা বের করার পরিকল্পনা করি। আমরা পাঠকদের কাছে লেখা আহ্বান করি। আমি তখন বলেছিলাম, একটি দিনে প্রতিটি মানুষের অন্তত সবার কাছে ভালোবাসাটা প্রকাশ করা উচিত।

আমি তখন ভেবেছিলাম, এই যে আমাদের দেশে এবং উপমহাদেশে এত সহিংসতা ঘটছে, এর অবসান ঘটাতে ভালোবাসা দরকার।

এই ভালোবাসা দিবস শুধু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নয়, সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া উচিত। অর্থাৎ বাবা-মার সঙ্গে ছেলে-মেয়ের, দাদা-দাদীর সঙ্গে নাতি-নাতনির, এমনকি বাড়িওয়ালার সঙ্গে ভাড়াটের। পুলিশের সঙ্গে পাবলিকের, যদি সম্ভব হয়। আমি মনে করেছি এতে দেশে সহিংসতা কমে আসবে।

আমি তখন পাঠকদের কাছে তাদের অভিজ্ঞতা চেয়ে পাঠালাম। আমি পাঠকদের কাছ থেকে বিপুল সাড়া পাই। ঠেলাগাড়িওয়ালা, রিকশাচালক, তাদের লেখা পর্যন্ত আমি পেতাম। অনেক লেখা আমার কাছে আসতো, বস্তা বস্তা।

বলতেই হবে, বাঙ্গালি আসলেই প্রেমিক। নইলে এত লেখা আমরা কেমন করে পেতাম।

ঢাকায় বসন্ত উৎসব। এখন ভ্যালেন্টাইন্স ডে আর পহেলা বসন্ত একই দিনে উদযাপিত হচ্ছে। আমাদের যায় যায় দিনের প্রথম ভালোবাসা সংখ্যা ছিল ৩২ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে ১৬ পৃষ্ঠা বরাদ্দ রেখেছিলাম পাঠকদের জন্য। সেখানে আমি ব্যাখ্যা করেছিলাম সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে কি ছিল। তবে আমি পাঠকদের বলেছিলাম, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই দিবসটি কীভাবে উদযাপন হওয়া উচিৎ।

আমি চেয়েছিলাম, সব ধরণের ভালোবাসার সম্পর্ক যেন এই ভালোবাসা দিবসে স্মরণ করা হয়।

আমি বহুবছর লণ্ডনে থাকার সুবাদে জানতাম, এখানে কীভাবে ভ্যালেন্টাইন্স ডে উদযাপিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে আমি এই নামের পরিবর্তে ভালোবাসা দিবস দিয়েছিলাম ইচ্ছে করে। ভ্যালেন্টাইন্স ডে বললে অনেকে বলবে এটা খ্রীষ্টানদের ব্যাপার, বলবে আমি এটা ধর্মীয় দিকে টেনে নিয়ে গেলাম।

যে সপ্তাহে আমাদের ভালোবাসা সংখ্যা বের হয়, ঐ একই সপ্তাহে বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তাদের প্রথম ভালোবাসা সংখ্যা প্রকাশ করে। সেজন্যে অনেকে বলেন, আমি টাইম ম্যাগাজিনের চেয়ে একটু এগিয়ে ছিলাম।

আমি কিন্তু ভাবিইনি যে এই ভালোবাসা দিবস এত বড় আকার ধারণ করবে। বাঙ্গালি যেন এটারই অপেক্ষায় ছিল। এর কারণও আছে। বাংলাদেশে অন্য যেসব উৎসব হয়, সেগুলো হয় ধর্মীয় নয়তো কোন রাজনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে জড়িত। অথবা নববর্ষের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু ভালোবাসা দিবস ছিল সেদিক থেকে আলাদা।

এখন তো ১৪ই ফেব্রুয়ারীতে বহুলোক বিয়েও করছে। এই দিনটি বাংলাদেশে অনেক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। যশোরে এক দিনেই নাকি বিক্রি হয় ১২ কোটি টাকার ফুল। এতটা যে হবে ভাবিনি। আমার ধারণা এটি আরো বড় হবে, কারণ এটাকে আমি পারিবারিক রূপ দেবার চেষ্টা করেছি।’